নৌকার দেশে কেন ‘নৌকাসংকট’

সিলেটে নিরাপদ আশ্রয়ে যেতে তীব্র নৌকার সঙ্কটে পড়ে বানভাসি মানুষ
ছবি: প্রথম আলো

ঘটনা-১
১০ কিলোমিটার দূরের বন্যাকবিলত একটি গ্রাম থেকে অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রীকে সিলেট শহরে নিয়ে আসতে চেয়েছিলেন তাঁর স্বামী। স্বাভাবিক সময়ে এই পথটুকু নৌকায় যেতে ৮০০ থেকে ১ হাজার টাকা খরচ হয়। নৌকার মাঝিরা ভাড়া চেয়েছেন ৫০ হাজার টাকা। তিনি ৪০ হাজার টাকা পর্যন্ত দিতে রাজি হলেও নৌকার মাঝিরা রাজি হননি।

ঘটনা-২
গোয়াইনঘাট উপজেলার একটি হাওর অঞ্চল থেকে ফুফু ও ফুফাতো ভাইবোনদের উদ্ধার করতে গিয়ে নৌকা খুঁজে পাচ্ছিলেন না এক ব্যক্তি। কয়েক ঘণ্টা অপেক্ষার পর মাঝারি আকৃতির একটি নৌকা জোগাড় হয়, যার মাঝি ছিলেন ১৭-১৮ বছরের এক তরুণ। বিশাল হাওর পাড়ি দিয়ে, কখনো বইঠা বেয়ে, কখনো নৌকা ঠেলে তিনি সবাইকে জায়গামতো পৌঁছে দেন। কিন্তু এর বিনিময়ে তিনি কোনো টাকা নিতে রাজি হননি। অনেক জোরাজুরি করে তরুণটির হাতে ৫০০ টাকা গুঁজে দিয়েছেন ওই ব্যক্তি।

সিলেট ও সুনামগঞ্জে ভয়াবহ বন্যার মধ্যে মূলধারার গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সেখানকার বাসিন্দাদের দুঃখ-দুর্দশার বহু রকম খবর এসেছে। এই খবরগুলোর মধ্যে মানুষের সুযোগসন্ধানী কর্মকাণ্ড যেমন রয়েছে, তেমনি রয়েছে মানবিকতার দৃষ্টান্তও। বন্যাকবলিত এলাকায় একটি বড় ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে নৌকার অভাব এবং অস্বাভাবিক ভাড়া। কোনো কোনো এলাকায় নৌকার ভাড়া স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে ৫০ গুণ পর্যন্ত বেড়েছে। স্থানীয়ভাবে তৈরি ডিঙি স্বাভাবিক দামের চেয়ে পাঁচ–ছয় গুণ বেশি দামে বিক্রি হচ্ছে।

বন্যায় আটকে পড়া মানুষের জন্য ত্রাণসহায়তা নিয়ে সিলেট শহর থেকে অনেকেই আশপাশের গ্রামগুলোতে যাওয়ার চেষ্টা করলেও অতিরিক্ত নৌকাভাড়ার কারণে তাঁরা পিছিয়ে আসতে বাধ্য হচ্ছেন। ত্রাণ কার্যক্রম ও উদ্ধার তৎপরতার জন্য স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে চার–পাঁচ গুণ বেশি ভাড়া দিতে রাজি হলেও অনেকেই নৌকা পাচ্ছেন না। সরকারি কর্মকর্তারা স্বীকার করেছেন, নৌকার সংকট থাকায় পানিবন্দী মানুষের কাছে পৌঁছানো কঠিন হয়ে পড়েছে। একটি আন্তর্জাতিক সংস্থায় কর্মরত এক বন্ধু জানালেন, তাঁদের সহকর্মীরা বন্যার্ত মানুষের মধ্যে খাবার, পানি বিশুদ্ধকরণের উপকরণ ইত্যাদি বিলি করার জন্য প্রস্তুতি নিয়ে বসে ছিলেন, কিন্তু নৌকা খুঁজে পাননি। এই ভয়াবহ বন্যার মধ্যে নৌকা ছাড়া উদ্ধার তৎপরতা কিংবা ত্রাণ পৌছানো—কোনোটাই সম্ভব নয়।

বাংলাদেশ যেমন ছিল নদীমাতৃক দেশ, একই রকমভাবে তা নৌকারও দেশ ছিল। কিন্তু কয়েক দশক ধরে নদী, খাল, বিল, হাওর, জলাভূমি ভরাট হয়ে যাওয়ায় এবং এগুলোর মধ্যে নানা রকম স্থাপনা তৈরি হওয়ায় দেশে নৌপথের পরিমাণ দিন দিন কমছে। একই রকমভাবে কমছে নৌকার ব্যবহারও। বড় নদ-নদীগুলোতে বিলাসবহুল লঞ্চ বা স্টিমার চলাচল করলেও অনেক ছোট বা শাখা নদী নৌকা চলাচলের অনুপযোগী হয়ে পড়েছে।

অর্থনীতির ‘চাহিদা-জোগান তত্ত্ব’ অনুযায়ী নৌকার এই ভাড়া ও মূল্যবৃদ্ধি অস্বাভাবিক নয়। কিন্তু নদীমাতৃক বাংলাদেশে সিলেট ও সুনামগঞ্জের হাওর এলাকায় নৌকার ‘অভাব’ হলো কেন? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে দেখা গেল, দেশের অন্যান্য এলাকার মতো সিলেট ও সুনামগঞ্জেও ছোটখাটো অনেক নদ-নদীতেও এখন বছরের বেশির ভাগ সময় পানি প্রায় থাকেই না। কোনো কোনো নদ–নদীর ওপর সেতু হওয়ায় পারাপারের জন্য নৌকার ব্যবহার নেই। একইভাবে হাওর এলাকার মধ্য দিয়ে অনেক ‘দৃষ্টিনন্দন’ রাস্তা হওয়ায় অনেক মাঝি নৌকা চালানো বাদ দিয়ে হ্যালো বাইক বা অটোরিকশা চালানো শুরু করেছেন।

আগে মানুষের দৈনন্দিন জীবনে নৌকার যে প্রয়োজনীয়তা ছিল, তা যেন অনেকটাই ফুরিয়ে গেছে। ওই এলাকায় পর্যটকদের নিয়ে ঘুরে বেড়ানোর জন্য যেসব নৌকা চলাচল করে, সেগুলো আবার বেশ ‘ব্যয়বহুল’ এবং সেগুলোর মালিকেরা যাত্রীদের কাছ থেকে বেশি ভাড়া রাখতেই অভ্যস্ত। বন্যার সময় সুযোগ বুঝে অতিরিক্ত ভাড়া নেওয়া তাঁদের জন্য অস্বাভাবিক নয়। যেভাবে প্রান্তিক কৃষকের হাত থেকে কৃষি ফড়িয়া, মজুতদার, করপোরেট কোম্পানির হাতে চলে যাচ্ছে, তেমনি অনেক ক্ষেত্রে ছোট-বড় ব্যবসায়ী, স্থানীয়ভাবে প্রভাবশালী ব্যক্তিরা এখন এসব নৌকার মালিক বা ইজারাদার। যেকোনো দুর্যোগ, দুর্ঘটনা, মহামারি কিংবা মানুষের নিত্যপ্রয়োজনের সুযোগকে কাজে লাগিয়ে বেশি মুনাফা করাই তাঁদের প্রধান উদ্দেশ্য।

আরও পড়ুন

আবহমান বাংলাকে বোঝাতে গিয়ে বহুদিন ধরে এখানকার শিল্পী-সাহিত্যিকেরা তাঁদের ক্যানভাসে যে ছবি এঁকেছেন, লেখায় যে বর্ণনা দিয়েছেন কিংবা মনে মনে যে দৃশ্যকল্পের কথা ভেবেছেন, তার মধ্যে নৌকা একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। নৌপথ যেমন একসময় ছিল এ অঞ্চলে চলাচল বা যাতায়াতের প্রধান মাধ্যম, তেমনি নৌকাই ছিল মানুষের প্রধান বাহন। পাঁচ-ছয় দশক আগেও মফস্বল ও গ্রামের প্রায় প্রতিটি বাড়ির পুকুরঘাটে এক বা একাধিক নৌকা বাঁধা থাকত। শুধু শিল্প-সাহিত্যের উপাদান হিসেবে নয়, নৌকার সম্পর্ক তখন মানুষের জীবনের প্রয়োজনের সঙ্গেও! এ কারণে এ অঞ্চলের গুরুত্বপূর্ণ সংস্থা, সংগঠনের মনোগ্রাম, রাজনৈতিক দলের প্রতীক হিসেবে নৌকাকে বেছে নেওয়া হয়েছিল। এমনকি আমাদের মুক্তিযুদ্ধেও নদ–নদী এবং নৌকার বিশেষ ভূমিকা রয়েছে।

বাংলাদেশ যেমন ছিল নদীমাতৃক দেশ, একই রকমভাবে তা নৌকারও দেশ ছিল। কিন্তু কয়েক দশক ধরে নদী, খাল, বিল, হাওর, জলাভূমি ভরাট হয়ে যাওয়ায় এবং এগুলোর মধ্যে নানা রকম স্থাপনা তৈরি হওয়ায় দেশে নৌপথের পরিমাণ দিন দিন কমছে। একই রকমভাবে কমছে নৌকার ব্যবহারও। বড় নদ-নদীগুলোতে বিলাসবহুল লঞ্চ বা স্টিমার চলাচল করলেও অনেক ছোট বা শাখা নদী নৌকা চলাচলের অনুপযোগী হয়ে পড়েছে।

নৌকা আমাদের শিল্প-সাহিত্যের উপজীব্য, সংস্কৃতির অংশ কিংবা ব্যক্তিগতভাবে কারও কারও ভালো লাগার বিষয় হওয়া সত্ত্বেও দখল ও উন্নয়নের ‘জাঁতাকলে’, নদীতে-খালে-বিলে পানির অভাবে সেই নৌকা এবং নৌকার প্রকৃত মাঝির সংখ্যা দিন দিন কমছে। তাই বন্যা বা জলোচ্ছ্বাসের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময় পানিবন্দী মানুষকে উদ্ধারে নৌকার জন্য আজ আমাদের এত হাহাকার।

  • মনজুরুল ইসলাম সাংবাদিক

আরও পড়ুন