বাংলাদেশ সরকার কি আনুষ্ঠানিকভাবে ‘মাদকের বিরুদ্ধে যুদ্ধ’ ঘোষণা করেছে? সেই যুদ্ধের কৌশল প্রণয়নে কি প্রচলিত আইনকে ধর্তব্যের মধ্যে নেওয়া হয়েছে? মাদকের ভয়াবহতার কারণে যাঁরা সরকারের অঘোষিত, কিন্তু ইতিমধ্যে প্রযুক্ত কৌশলের পক্ষে যুক্তি হাজির করছেন, তাঁরা কী পৃথিবীর অন্যত্র এই ধরনের কথিত ‘ওয়ার অন ড্রাগসের’ পরিণতি বিষয়ে অবহিত হয়েই তাতে সোৎসাহে সম্মতি দিচ্ছেন? গত কয়েক দিনের ঘটনাপ্রবাহ এবং সরকারের উচ্চপর্যায়ের ব্যক্তিদের বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে এই প্রশ্নগুলো বিবেচনা করা দরকার হয়ে পড়েছে।
বাংলাদেশে মাদকের সহজলভ্যতা এবং তার ভয়াবহ প্রতিক্রিয়া বিষয়ে আলোচনা কয়েক বছর ধরেই অব্যাহত থেকেছে, সরকারের পক্ষ থেকে এই বিষয়ে কথাবার্তাও বলা হয়েছে। কিন্তু এই ভয়াবহ মহামারির মতো প্রবণতা মোকাবিলায় কার্যকর কোনো ধরনের সাফল্য অর্জিত হয়নি। বিগত বছরগুলোতে অন্য যেকোনো মাদকের চেয়ে ইয়াবার ব্যবহার বেড়েছে তার সহজলভ্যতার কারণে; প্রায়ই আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী হাজার হাজার ইয়াবা বড়ি উদ্ধার করে বলেও খবর দেখা যায়। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের হিসাব অনুযায়ী, ২০১৭ সালে চার কোটি ইয়াবা বড়ি জব্দ করা হয়েছে (ডেইলি স্টার, ১২ মে ২০১৮)। সংবাদপত্রের নিয়মিত প্রতিবেদনের বাইরে অনুসন্ধানী প্রতিবেদনগুলোতে যে চিত্র উঠে এসেছে, তা কেবল সমস্যার ভয়াবহতাই নয়, এর সঙ্গে যুক্ত কারা এবং কীভাবে তাঁরা তাঁদের এই বাণিজ্য অব্যাহত রাখতে সক্ষম হচ্ছেন, সেগুলোও সুস্পষ্টভাবে বলা হয়েছে।
এই রকম একটা প্রেক্ষাপটেই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যখন বলেন যে ‘মাদকের বিরুদ্ধে অভিযান কিন্তু শুরু হয়ে গেছে’ (বিডিনিউজ ২৪,২০ মে ২০১৮), তখন বুঝতে হয় যে সরকার সুনির্দিষ্টভাবে বিভিন্ন দিক বিবেচনায় নিয়ে কৌশল নির্ধারণ করেই মাদকবিরোধী অভিযান শুরু করেছে। প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, ‘আমরা সমস্ত আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, গোয়েন্দা সংস্থা এবং র্যাবকে বিশেষ দায়িত্ব দিয়েছি। যেখানেই মাদক, সেখানেই কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে এবং সেই কঠোর ব্যবস্থা নিচ্ছি।’ প্রধানমন্ত্রী গত জানুয়ারি মাসে পুলিশকে এবং ৩ মে র্যাবকে জঙ্গিবিরোধী অভিযানের মতোই মাদকের বিরুদ্ধে অভিযানে নামতে নির্দেশ দেন। প্রধানমন্ত্রীর এই বক্তব্যে কৌশলের দিকটি আমাদের কাছে স্পষ্ট-‘আমরা যেমন জঙ্গিবাদকে দমন করেছি’। র্যাবের মহাপরিচালক বেনজীর আহমেদ গত সপ্তাহেই বলেছেন, ‘হু এভার, হোয়াট এভার, হয়ার এভার-কেউ আমাদের অপারেশনের বাইরে নয়। মাদকের শিকড়-বাকড়সহ তুলে নিয়ে আসব।’
সরকারের গৃহীত কৌশলের ‘কার্যকর’ রূপ আমরা দেখতে পাই গত কয়েক দিনে মাদকের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত হওয়ার উপর্যুপরি ঘটনা থেকেই। সরকারের কথিত এই অভিযানে এক সপ্তাহে ২৭ জন ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত হয়েছেন; রোববার রাত থেকে সোমবার সকাল পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টার চেয়ে কম সময়ে নিহত হয়েছেন ৯ জন। এসব কথিত বন্দুকযুদ্ধের বিষয়টি এখন কারোরই অবোধ্য নয়। এগুলো হচ্ছে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড। যেভাবেই এগুলো সংবাদপত্রে প্রচারিত হোক না কেন, এগুলোর বিশ্বাসযোগ্যতা যে নেই, তা কথায় কথায় ‘অপরাধীদের’ ‘ক্রসফায়ারে দেওয়ার’ দাবির মধ্যেই প্রমাণিত।
কোনো ব্যক্তি আইনসংগতভাবে বিচার-প্রক্রিয়ার মাধ্যমে দোষী প্রমাণিত না হওয়া পর্যন্ত যে তিনি নিরপরাধ, বিচার-প্রক্রিয়ার মাধ্যমেই কেবল একজন শাস্তি পেতে পারেন এবং সেই শাস্তি দেওয়ার জন্য যে আলাদা কাঠামো সংবিধানে নির্ধারিত আছে, তার বাইরে যাওয়ার অর্থ, এটি হচ্ছে বেআইনি এবং বিচারবহির্ভূত ব্যবস্থা। বাংলাদেশে কার্যত এগুলো প্রায় বিস্মৃত। ভিন্নমতের মানুষ, সরকারবিরোধী রাজনৈতিক কর্মীদের বিরুদ্ধে এই ধরনের ব্যবস্থা প্রযুক্ত হওয়ার দীর্ঘ ইতিহাস আছে, কিন্তু তা গত এক দশকে কেবল মাত্রার দিক থেকে বেড়েছে এবং নির্বিচারভাবে ব্যবহৃত হয়েছে তা-ই নয়, একে স্বাভাবিক বলেই প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে।
রাষ্ট্রের চোখে অপরাধী বলে বিবেচিত হলেই কোনো ব্যক্তির সাংবিধানিকভাবে প্রদত্ত অধিকার লঙ্ঘনের যে ধারা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, ‘মাদকের বিরুদ্ধে যুদ্ধ’-এর মধ্যে তারই প্রকাশ ঘটছে। মাদক ব্যবসায় জড়িত ব্যক্তিদের অপরাধ ছোট করে দেখানো কিংবা তাঁদের আইনের আওতায় আনার বিরোধিতা করা-এই কথাগুলো বলার উদ্দেশ্য নয়। দুর্ভাগ্যজনক হচ্ছে, এই নিয়ে আলোচনার বদলে একধরনের মানুষের মধ্যে এই ধরনের অভিযানকে বৈধতা দেওয়ার প্রবণতা লক্ষণীয়।
তথাকথিত ‘মাদকের বিরুদ্ধে যুদ্ধের’ এক ভয়াবহ রূপ আমরা প্রত্যক্ষ করছি ফিলিপাইনে ২০১৬ সালের আগস্ট মাস থেকে। প্রেসিডেন্ট রদ্রিগো দুতার্তে ক্ষমতায় আসার পর মাদকের ‘বিরুদ্ধে অভিযানে’ দেশটির পুলিশ ও সেনাবাহিনী এযাবৎ ১২ হাজারের বেশি মানুষকে হত্যা করেছে। এই ভয়াবহ আইনবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের প্রধান শিকার হচ্ছেন দরিদ্র লোকজন। প্রেসিডেন্ট দুতার্তে এই অভিযানের জন্য গর্ব বোধ করেন বলেই বিভিন্ন সময় বলেছেন। তাঁর এই ব্যবস্থার বিরুদ্ধে কথা বলার জন্য দেশের সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি মারিয়া সেরেনোকে তাঁর পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে এই মাসের ১১ তারিখে। প্রেসিডেন্ট তাঁকে ‘শত্রু’ বলে ঘোষণা করার পর তাঁকে অপসারণ করা হলো।
বিচারপতি সেরেনো এসব অভিযানকে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বলেই বিবেচনা করেছেন। এই ধরনের হত্যাকাণ্ডের বিষয়ে তদন্তের কারণে সিনেটর লেইলা দ্য লিমাকে আটক করে তাঁর বিরুদ্ধে মাদকদ্রব্যের অভিযোগ দায়ের করা হয়েছে, যে অভিযোগ তিনি অস্বীকার করেছেন। ফিলিপাইনের ক্ষেত্রে আমরা দেখতে পাচ্ছি যে দুই বছর ধরে অব্যাহত অভিযানের পরও মাদক বিষয়ে কোনো নাটকীয় উন্নতি হয়নি, কিন্তু সমাজে, বিশেষত দুতার্তের সমালোচক এবং দরিদ্র জনগোষ্ঠীর মধ্যে ভীতির পরিবেশ তৈরি হয়েছে।
২০০৬ সাল থেকে মেক্সিকোর সরকার, প্রেসিডেন্ট ফিলেপে কেলডোরেন এবং তাঁর উত্তরসূরি এনরিকে পেনা নেটো এই ধরনের অভিযান চালিয়ে এসেছেন। তাতে প্রাণ হারিয়েছেন হাজার হাজার মানুষ। তবে প্রতিদ্বন্দ্বী মাদক ব্যবসায়ীদের সংঘাতের জেরে নিহত হওয়ার সংখ্যা অনেক, ২০১৭ সালে কমপক্ষে ৩০ হাজার মানুষ নিখোঁজ হয়েছে। সরকার দাবি করে যে এঁদের মাদক ব্যবসায়ীরা তুলে নিয়ে গেছেন; কিন্তু অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়, ইউনিভার্সিটি অব মিনেসোটা এবং ল্যাটিন আমেরিকান সোশ্যাল সায়েন্স ইনস্টিটিউটের গবেষণায় দেখা গেছে, ৪৭ শতাংশ ঘটনা ঘটিয়েছে সরকারি বাহিনী। সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে এই ধরনের একটি মামলা এখন ইন্টার-আমেরিকান কোর্ট অব হিউম্যান রাইটসে বিচারাধীন, কেননা মেক্সিকোর আদালতে এর বিচার সম্ভব হয়নি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ১৯৭০-এর দশক থেকে কথিত ‘ওয়ার অন ড্রাগসের’ ফলে হাজার হাজার নাগরিককে কারাগারে আটক থাকতে হচ্ছে, এই সংখ্যার একটা বড় অংশই হচ্ছেন কৃষ্ণাঙ্গরা। ২০১০ সালে প্রকাশিত দ্য নিউ জিম ক্রো গ্রন্থে মিশেল আলেক্সান্ডার দেখিয়েছেন যে যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরে ‘ওয়ার অন ড্রাগস’ কার্যত কারাবন্দীর সংখ্যাই বাড়িয়েছে।
এসব উদাহরণ আমাদের দেখিয়ে দেয় যে ওয়ার অন ড্রাগসের ফল কাদের ভোগ করতে হয় এবং তার পরিণতি আদৌ ইতিবাচক হয় না। বাংলাদেশের সরকার যখন আইনের প্রতি ভ্রুক্ষেপ না করে বিচারবহির্ভূত ব্যবস্থার মাধ্যমে সমাধানের কৌশল বেছে নিয়েছে, তখন উদ্বিগ্ন হওয়ার আরও কারণ রয়েছে। গত এক দশকে বিচারবহির্ভূত হত্যার কোনো বিচার তো হয়ইনি, উপরন্তু সরকার তা অস্বীকার করে আসছে; এই ব্যবস্থার শিকার হয়েছেন ভিন্নমতাবলম্বীরা এবং কথিত অপরাধীরা। এগুলো সমাজে ভীতি তৈরি করেছে, আইনের শাসনের বদলে ভয়ের সংস্কৃতির বিস্তার ঘটিয়েছে। এই অভিযান যে আগামী দিনে রাজনৈতিক কারণে ব্যবহৃত হবে না, সেটির রক্ষাকবচ কোথায়? দ্বিতীয়ত, প্রায়ই অভিযোগ ওঠে যে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা কাউকে আটক করতে চাইলে তাঁদের পকেটে-ব্যাগে-হাতে ইয়াবা ধরিয়ে দেন বা হুমকি দেন। এই ক্ষেত্রে যে তার অন্যথা ঘটছে না, সেই নিশ্চয়তা কে দিতে পারে?
এসব কথা বলার অর্থ এই নয় যে মাদকের বিরুদ্ধে অভিযান চালানো যাবে না, কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, মাদক ব্যবসায়ীরা যাঁদের আনুকূল্যে এই ব্যবসা চালাতে পারছেন, তাঁদের বিষয়ে কোনো রকম পদক্ষেপ না নিয়ে কেবল নির্বিচার হত্যাকাণ্ডের পথ সরকার বেছে নিচ্ছে কেন? এই ধরনের ব্যবসার রাজনৈতিক আশ্রয়দাতাদের বিষয়ে সরকার কঠোর হতে না পারলে এখন যাঁদের হত্যা করা হচ্ছে, তাঁদের বিকল্প তৈরি হতে বেশি সময় লাগবে না। ফলে সমস্যার খুব একটা সমাধান হবে, এমন আশা করার কারণ দেখি না।
আলী রীয়াজ: যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির সরকার ও রাজনীতি বিভাগের ডিস্টিংগুইশড প্রফেসর
আরও পড়ুন...