জাতীয় সংসদ নির্বাচনের এখনো বছর দুই বাকি। কিন্তু এখনই নির্বাচন নিয়ে আলোচনা সবখানে। বিরোধী শিবিরের কথায় মনে হতেই পারে, দেশে নির্বাচন ছাড়া আর কোনো বিষয় নেই। নতুন নির্বাচন কমিশন গঠন, সে–সংক্রান্ত আইন প্রণয়ন, সার্চ কমিটি গঠন, নির্দলীয়-নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন ইত্যাদি নিয়ে রাজনীতির মাঠ সরগরম। আচ্ছা, নির্বাচন কি সত্যিই এতটা গুরুত্বপূর্ণ? কোনো সরকার যদি সামনে নির্বাচন না দেখে, তাহলে কী হতে পারে? কোনো সরকার যদি নিশ্চিত থাকে, মানুষের ভোট নয় বরং তার ক্ষমতায় যাওয়ার কিংবা থাকার মূল শক্তি আসলে প্রশাসন, বিভিন্ন বাহিনী, দলীয় ক্যাডার, তখন তার ফল কী হয়? এ প্রশ্নগুলোর উত্তরে যাওয়ার আগে দুটি ঘটনার উল্লেখ করছি।
ভারতে দুটি ঘটনা সম্প্রতি খুবই আলোচিত হয়েছে। সাম্প্রতিকটি হচ্ছে সংসদকে প্রায় পুরোপুরি পাশ কাটিয়ে একরকম ‘গায়ের জোরে’ যে নতুন কৃষি আইন করা হয়েছিল (লাখ লাখ কৃষকের মাসের পর মাস আন্দোলন, অনেক কৃষকের প্রাণহানির মুখেও প্রত্যাহার করা হয়নি যে আইনগুলো), ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি হঠাৎ সেটি প্রত্যাহার করেছেন। খুব দায়সারাভাবে লিখিত বিবৃতি দিয়ে নয়; রীতিমতো জাতির উদ্দেশে ভাষণ দিয়ে, করজোড়ে ক্ষমা চেয়ে। সাত বছরের প্রধানমন্ত্রিত্বের সময়ে এ নিয়ে দুবার ক্ষমা চাইলেন তিনি (আগেরবার চেয়েছিলেন করোনায় একেবারে বিধ্বস্ত হয়ে)। একজন ভীষণ শক্তিশালী শাসকের ব্র্যান্ডিং তৈরি করা প্রধানমন্ত্রী মোদির জন্য নিঃসন্দেহে এ এক বিশাল ধাক্কা। অপর ঘটনাটি এর কয়েক দিন আগের। বিশ্বে জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির মুখে যখন অন্যান্য দেশে দাম বাড়ানো হলো, ভারতে তখন দাম কমানো হয়েছিল।
ভারতে জ্বালানির মূল্য যখন কমানো হয়েছিল, তার ঠিক আগে কয়েকটি রাজ্যের লোকসভার উপনির্বাচনে ৩টি আসনের মধ্যে ১টি, আর বিধানসভার ২৫টির মধ্যে ৯টি আসনে জয়ী হয় বিজেপি। অন্য দলের হাতে থাকা আসন বিজেপি জিততে তো পারেইনি, বরং হারিয়েছে নিজেদের হাতে থাকা বেশ কয়েকটি আসন। আবার আগামী ফেব্রুয়ারিতেই পাঞ্জাব, উত্তর প্রদেশসহ ভারতের পাঁচটি প্রদেশের বিধানসভার নির্বাচন। যার মধ্যে বলা হচ্ছে উত্তর প্রদেশের বিধানসভায় সংখ্যাগরিষ্ঠতা না পেলে পরবর্তী জাতীয় নির্বাচনে জেতার সম্ভাবনা ক্ষীণ। এটাই নির্বাচনের ম্যাজিক, যে ম্যাজিক সরকারের চরিত্র নির্ধারণ করে দেয়, চরিত্র পাল্টে দেয়, এমনকি ইচ্ছার বাইরে গিয়ে হলেও শাসককে অনেক সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য করে।
বাংলাদেশে সরকারকে জব্দ করতে বিরোধী দলের মূল অস্ত্র যেমন নির্বাচন, তেমনি সরকারের কাছে সব সমস্যার দাওয়াই হলো উন্নয়ন। এই তথাকথিত উন্নয়নের বয়ান সামনে এনেই সরকার চায় তার ম্যান্ডেটহীনভাবে ক্ষমতায় থাকাকে যৌক্তিক ভিত্তি দিতে। মুশকিল হলো উন্নয়ন বলতে সরকার বোঝে কেবল অবকাঠামোগত উন্নয়ন। এর সঙ্গে সুশাসন, ন্যায়বিচার নিশ্চিতকরণ, দুর্নীতি দূরীকরণ, বৈষম্য কমানো, সাধারণ মানুষের কল্যাণসাধনের দূরতম কোনো সম্পর্ক নেই; যদিও উন্নয়নের সংজ্ঞায় এসব অন্তর্ভুক্ত হয়েছে অনেক আগেই। এ–সংক্রান্ত সূচক প্রকাশকারী স্বনামধন্য নানা বৈশ্বিক সংস্থার প্রতিবেদনে বাংলাদেশের অবস্থান দীর্ঘদিন থেকে একেবারে তলানিতে। সম্প্রতি প্রকাশিত আরেকটি প্রতিবেদনে একই প্রবণতা দেখা যাচ্ছে।
মুশকিল হলো উন্নয়ন বলতে সরকার বোঝে কেবল অবকাঠামোগত উন্নয়ন। এর সঙ্গে সুশাসন, ন্যায়বিচার নিশ্চিতকরণ, দুর্নীতি দূরীকরণ, বৈষম্য কমানো, সাধারণ মানুষের কল্যাণসাধনের দূরতম কোনো সম্পর্ক নেই; যদিও উন্নয়নের সংজ্ঞায় এসব অন্তর্ভুক্ত হয়েছে অনেক আগেই।
মার্কিন সংস্থা ‘মিলেনিয়াম চ্যালেঞ্জ করপোরেশন’ দরিদ্র কিন্তু সুশাসন নিশ্চিত করার চেষ্টা করা এবং জনগণের কল্যাণ নিশ্চিত করতে সদিচ্ছা থাকা দেশগুলোকে আর্থিক সহায়তা দিয়ে থাকে। এ কর্মসূচির আওতায় দুটি শ্রেণির একটিতে ১০ কোটি থেকে ৪০ কোটি এবং অপরটিতে ৫০ কোটি মার্কিন ডলার থেকে বিভিন্ন অঙ্কের অনুদান দেওয়া হয়। বাংলাদেশ এ তহবিল পাওয়ার জন্য বেশ কয়েক বছর ধরে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।
তিনটি ক্ষেত্রের মোট ২০টি বিষয়ে দেশগুলোর ‘স্কোরকার্ড’ দেওয়া হয় প্রতিবছর। এর মধ্যে ন্যূনতম যোগ্যতা অর্জন করতে পারলে সেটা সবুজ এবং ব্যর্থ হলে সেটা লাল রং দিয়ে নির্দেশ করা হয়। এ বছর বাংলাদেশ মোট ১৬টি বিষয়ে ন্যূনতম যোগ্যতা অর্জন করতে পারেনি, অর্থাৎ লাল। ন্যায়ানুগ শাসনের ক্ষেত্রে দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণ, রাজনৈতিক অধিকার, সরকারের কার্যকারিতা, তথ্যের স্বাধীনতা, আইনের শাসন, সিভিল লিবার্টি (ন্যায়বিচার পাওয়া, মতপ্রকাশ, সমাবেশ করা, ধর্ম পালন ইত্যাদির স্বাধীনতা) এ সব কটিতে লাল স্কোর করেছে বাংলাদেশ। জনগণের জন্য বিনিয়োগের ক্ষেত্রে টিকাদানের হার এবং মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষায় মেয়েদের যুক্ত হওয়া ছাড়া অন্যান্য বিষয়, যেমন স্বাস্থ্য খাতে ও প্রাথমিক শিক্ষায় সরকারি ব্যয়, প্রাকৃতিক সম্পদ রক্ষা, শিশুস্বাস্থ্যে লাল স্কোর করেছে বাংলাদেশ। অর্থনৈতিক স্বাধীনতার ক্ষেত্রে অর্থনৈতিক নীতি, ঋণপ্রাপ্তির সহজলভ্যতা, নারী ও পুরুষের সমতা, জমির অধিকার ও প্রাপ্যতা, বাণিজ্য নীতিমালা, নিয়ন্ত্রণমূলক কাজের মান সব লাল। সবুজ কেবল ব্যবসায়িক স্টার্টআপ আর মূল্যস্ফীতিতে।
ওপরের এই তিন মূল ক্ষেত্র এবং তাতে অন্তর্ভুক্ত বিষয়গুলো লক্ষ করলে এটি স্পষ্ট যে বাংলাদেশ যে চার বিষয়ে সবুজ স্কোর পেয়েছে, সেগুলো আর সব কটির তুলনায় অনেকটাই কম গুরুত্বপূর্ণ। ২০২১ সালের প্রতিবেদনে লাল ছিল ১৩টি সূচক। এ ছাড়া ২০২০ সালে ছিল ১২টি, ২০১৯ সালে ছিল ১১টি। অর্থাৎ পরিস্থিতি ক্রমাগত খারাপ থেকে খারাপতর হয়েছে। এখানে উল্লেখ করতে চাই, বিএনপি শাসনের শেষ দুই বছর লাল সূচক ছিল যথাক্রমে সাত ও পাঁচটি বিষয়ে।
দেখা যাচ্ছে, নেপাল ৩, ভুটান ৪, ভারত ৬, ভিয়েতনাম ৭, পাকিস্তান ১১, মিয়ানমার ১৩ ও আফগানিস্তান ১৪টি ক্ষেত্রে লাল স্কোর পেয়েছে। বহু বৈশ্বিক সূচকে আমাদের চেয়ে নিচে অবস্থান করে আমাদের মুখরক্ষা করা আফগানিস্তানও এ ক্ষেত্রে আর আমাদের নিচে নেই। ওদিকে আফগানিস্তান ছাড়া আর সব দেশ ‘দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণ’ সূচকে সবুজ। হ্যাঁ, পাকিস্তানের মতো সমালোচিত দেশ কিংবা সামরিক জান্তাশাসিত পুরো মাত্রার গৃহযুদ্ধের মুখোমুখি মিয়ানমারও দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণে সচেষ্ট আছে। শুধু নেই আমরা। দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা দূরেই থাকুক, দুর্নীতি বরং ক্রমাগত বাড়ছে। কারণ, ক্ষমতাসীন সরকার আর তাদের সহযোগীরা হয়ে পড়েছে প্রতিটি দুর্নীতির অংশ।
অনেকে আমার সমালোচনা করতে গিয়ে বলেন, আমি নাকি ‘গরুর রচনা’র মতো সবকিছুকেই নির্বাচনের দিকে নিয়ে যাই। একটা দেশে নির্বাচন যখন ঠিক থাকে, তখন বাধ্য হয়েই সরকারকে দুর্নীতি দমন, সুশাসন নিশ্চিতকরণ, মানবাধিকার, ন্যায়বিচার, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, জনগণের জন্য সামাজিক সুরক্ষা নিশ্চিত করার মতো কাজ করতেই হয়। এর চমৎকার এক উদাহরণ হতে পারে সাবসাহারান আফ্রিকার দেশ বতসোয়ানা। মানুষের মুখ চেয়ে সরকারকে এমন সব সিদ্ধান্ত নিতে হয় কিংবা সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসতে হয়, যা হয়তো তার গোষ্ঠীস্বার্থবিরোধী। এই কষ্ট তাকে সইতে হয় কেবল নির্বাচন মাথায় রেখে। এটাই নির্বাচনের ম্যাজিক।
রুমিন ফারহানা বিএনপিদলীয় সাংসদ ও হুইপ এবং বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী