নির্বাচনে সেনা মোতায়েনের প্রসঙ্গ একটি পুরোনো বিতর্ক বাংলাদেশে। নতুন করে প্রসঙ্গটি আলোচনায় এসেছে বর্তমান নির্বাচন কমিশনের দুজন সদস্যের সাম্প্রতিক বক্তব্যের কারণে। প্রথমে নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদার বলেন, নির্বাচনে সেনা মোতায়েন করা হবে। তবে তা ঠিক কী প্রক্রিয়ায় হবে, তা তিনি স্পষ্ট করে বলেননি। প্রক্রিয়ার বিষয়ে নির্বাচন কমিশন সিদ্ধান্ত নিয়েছে, তা–ও তিনি দাবি করেননি। পরের দিন প্রধান নির্বাচন কমিশনার বলেছেন, নির্বাচনে সেনা মোতায়েনের সিদ্ধান্ত হয়নি। তবে নির্বাচনে সেনাবাহিনী থাকতে পারে কি না, এ ব্যাপারে কথাবার্তা চলছে।
তাঁদের এ বক্তব্য পরস্পরবিরোধী মনে হতে পারে। কিন্তু আসলে তাঁদের বক্তব্যের মধ্যে দূরত্ব খুব একটা নেই। নির্বাচনে সেনাবাহিনী মোতায়েন নিয়ে তাঁদের মধ্যে কথাবার্তা হচ্ছে, এটি দুজনের কথায় স্পষ্ট। কিন্তু সেনা মোতায়েনের প্রক্রিয়ার বিষয়ে তাঁরা সিদ্ধান্তের পর্যায়ে গেছেন, এটি প্রধান নির্বাচন কমিশনার নাকচ করেছেন। দুই নির্বাচন কমিশনারের বক্তব্যে তারপরও কিছু দ্বিধা বা অস্পষ্টতা রয়েছে। এটি বিষয়টির স্পর্শকাতরতা এবং একে ঘিরে নানা মতবিরোধের ইঙ্গিত বহন করে।
২.
বাংলাদেশে নির্বাচনে সেনাবাহিনীকে নিয়োগ নিয়ে নানা মহলের নানা মত রয়েছে। সেনাবাহিনীকে শুধু স্ট্রাইকিং ফোর্স হিসেবে নিয়োগ করতে রাজি আছে আওয়ামী লীগ। এর মানে হচ্ছে, ভোটকেন্দ্রে তাদের উপস্থিতি থাকবে না। সেখানে বেআইনি সমাবেশ, গোলযোগ বা অরাজকতা হলে প্রয়োজনবোধে কেবল প্রশাসনিক ম্যাজিস্ট্রেট তাদের ডাকতে পারবেন পরিস্থিতি মোকাবিলার জন্য। ফৌজদারি কার্যবিধির ১২৯-১৩১ ধারা অনুসারে সামরিক বাহিনীকে এভাবে ডাকলে এ জন্য অন্য কোনো আইন পরিবর্তনের প্রয়োজন নেই। এভাবে ডাকা সামরিক বাহিনী ১৩১ ধারা অনুসারে উপযুক্ত ক্ষেত্রে কাউকে গ্রেপ্তার পর্যন্ত করতে পারে। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে, অতীতে বহু নির্বাচনে এমন পরিস্থিতি হলেও সেনা বা অন্য কোনো সামরিক বাহিনীকে ডাকা হয়নি। স্ট্রাইকিং ফোর্স তাই আসলে লোকদেখানো একটি বিষয় বলে অনেকে মনে করে।
আওয়ামী লীগের বিপরীতে বিএনপির দাবি বহুভাবে ভিন্ন। সেনাবাহিনীকে শুধু ভোটকেন্দ্রে মোতায়েন নয়, তাকে বিচারিক ক্ষমতা দেওয়ারও দাবি করেছে বিএনপি। সেনাবাহিনীকে বিচারিক ক্ষমতা অতীতে কোনো জাতীয় নির্বাচনে দেওয়া হয়নি এবং এটি বিচার–দর্শনের পরিপন্থী বলে এই দাবির পক্ষে মত নেই অন্য অনেকের।
সেনাবাহিনীকে নিয়োগপ্রক্রিয়ার ক্ষেত্রে তাই গ্রহণযোগ্য বিবেচ্য বিষয়টি হচ্ছে ভোটকেন্দ্রে তাদের মোতায়েনের প্রশ্নটি। ভোটকেন্দ্রে
তাদের মোতায়েনের প্রস্তাব বিএনপি করেছে, করেছে জাতীয় পার্টি, বাম দলগুলোর বৃহত্তর অংশটিসহ সংখ্যাগরিষ্ঠ রাজনৈতিক দল, অধিকাংশ নাগরিক সমাজের প্রতিনিধি ও সাবেক নির্বাচন কমিশনাররা। তাঁরা এই দাবি নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে সংলাপ চলাকালে করেছিলেন। অন্যদিকে আওয়ামী লীগ ও তার অনুগত কয়েকটি দল এর বিরোধিতা করেছে, একে অপ্রয়োজনীয় বলে অভিহিত করেছে। তাদের বক্তব্য পুলিশ, র্যাব, বিজিবি দিয়েই সুষ্ঠু নির্বাচন করা সম্ভব। তারা এ ক্ষেত্রে আইনি প্রতিবন্ধকতার কথাও বলে থাকে।
৩.
নির্বাচনকালে সামরিক বাহিনী মোতায়েনের জন্য এই মুহূর্তে দেশে কোনো আইন নেই। সেনা মোতায়েন করতে হলে, নির্বাচন কমিশনের সচিবের বক্তব্য অনুসারে, দেশের সংবিধান, গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ (আরপিও) ও ফৌজদারি কার্যবিধির পরিবর্তন প্রয়োজন। কিন্তু এ জন্য আসলে সংবিধানের কোনো পরিবর্তনের প্রয়োজন নেই। প্রয়োজন শুধু আরপিওর অধীনে সংজ্ঞায় নির্বাচনকালে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী হিসেবে সেনাবাহিনীকে অন্তর্ভুক্ত করা। চাইলেই এটি করার ক্ষমতা বর্তমান সংসদের রয়েছে, সংসদ অধিবেশন না থাকলে এটি রাষ্ট্রপতিও করতে পারেন আগামী সংসদ নির্বাচনের আগে যেকোনো সময়।
সমস্যা তাই আইনে নয়, সমস্যা আইন প্রণয়নের পক্ষে নীতিগত সিদ্ধান্ত গ্রহণে। এই সিদ্ধান্ত সরকারই কেবল গ্রহণ করতে পারে। কিন্তু নির্বাচন কমিশন জোরের সঙ্গে দাবি তুললে এই দাবি অগ্রাহ্য করা সরকারের জন্য কঠিন হবে। অতীতে ২০১১ সালে দুটো উপনির্বাচনে নির্বাচন কমিশন সেনা মোতায়েনের দাবি তুলেছিল। আইনে নেই এই কথা বলে সরকার তাতে কর্ণপাত করেনি। নির্বাচনকালে সেনা মোতায়েনের প্রয়োজন অনুভব করলে কমিশনের তাই উচিত হবে সরকারকে এখন থেকেই গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ সংশোধন করতে বলা। বর্তমানে যেভাবে সবার অংশগ্রহণে নির্বাচনের জন্য চাপ সৃষ্টি হচ্ছে, তাতে নির্বাচন কমিশন বললে সরকারের পক্ষে এটি উড়িয়ে দেওয়া সহজ হবে না।
প্রশ্ন হচ্ছে, কমিশন এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করার প্রয়োজন অনুভব করছে কি না?
আমি মনে করি, এটি করা উচিত।
৪.
নির্বাচনকালীন আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ভালো না থাকলে মানুষ ভোটকেন্দ্রে আসে না। এই সুযোগে ব্যালট বাক্সে ভুয়া ভোট ভরে নির্বাচনে জেতা অনেক সহজ হয়ে পড়ে। কাজটি করার অনেক বেশি সুযোগ থাকে ক্ষমতাসীন দলের। ক্ষমতাসীন দলের প্রতি অনুগত বা তাদের পছন্দের লোক থাকেন প্রশাসনে বা পুলিশে। দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন হলে নির্বাচনকালে তাঁরাই থাকেন মূল দায়িত্বে। ব্যালট বাক্সে ভুয়া ভোট পড়ার মহোৎসব শুরু হলেও সাধারণত তাঁরা বাধা দেন না। তাঁদের কেউ কেউ নিজে এসব কাজে সহায়কের ভূমিকা পালন করেন, এমনও দেখা গেছে অতীতের নির্বাচনগুলোতে।
ভোটের আগে নির্বাচনী এলাকাগুলোতে পুলিশ বিরোধী দলের নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে নানা পদক্ষেপ গ্রহণ করেও নির্বাচনকে প্রভাবিত করতে পারে। বর্তমান সরকারের আমলে বিভিন্ন রাজনৈতিক মামলায় ঢালাওভাবে বিএনপির জোটের নেতা-কর্মীদের অভিযুক্ত করা হয়েছে। নির্বাচনের সময় এ সুযোগ কাজে লাগিয়ে পুলিশের পক্ষে ব্যাপক গ্রেপ্তার ও এলাকাছাড়ার ভীতি তৈরি করা সম্ভব। পুলিশের মধ্যে যেভাবে দুর্নীতি ও অপহরণের মতো অপরাধ প্রবণতার খবর আমরা পাই, তাতে মনে হয়, নির্বাচনকালে গ্রেপ্তার–বাণিজ্যে মেতে ওঠাও তাদের কারও কারও পক্ষে সম্ভব। আবার সরকারের পক্ষে সম্ভব বিচার বিভাগের ওপর হস্তক্ষেপ করে গ্রেপ্তারকৃত ব্যক্তিদের ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত করা।
সেনাবাহিনী নির্বাচনের কয়েক দিন আগে থেকে ভোটকেন্দ্রে মোতায়েন থাকলে, বিশেষ করে বিরোধী দলের নেতা-কর্মীরা অন্যায় হয়রানির ভয় থেকে অনেকাংশে মুক্ত থাকেন। সরকারি দলের বিভিন্ন মাস্তান বাহিনীর পক্ষেও স্বেচ্ছাচারিতা করার আত্মবিশ্বাস কমে যায়। এর কারণ হচ্ছে, সেনাবাহিনী দেশের একমাত্র প্রতিষ্ঠান, যেখানে দলীয় বিবেচনায় নিয়োগের সুযোগ নেই। দলীয় বিবেচনায় সেখানে গুরুত্বপূর্ণ পদে পদায়নের কিছু সুযোগ রয়েছে, কিন্তু নিয়োগের সুযোগ এখনো নেই বললেই চলে। সেনাবাহিনী নির্বাচনকেন্দ্রে মোতায়েন থাকলে তাই সরকারি হোক, বিরোধী দলের হোক, সন্ত্রাসীদের পক্ষে তাণ্ডবলীলা চালানোর সাহস হয় না।
নির্বাচনকালে সেনাবাহিনী নিয়োগ তাই নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে অনুষ্ঠানের বিরাট একটি শর্ত পূরণ করতে পারে। নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে সাম্প্রতিককালে নাগরিক সমাজের সংলাপকালেই দেখেছি দলমত–নির্বিশেষে অধিকাংশ সম্মানিত ব্যক্তি নির্বাচনকালে সেনা মোতায়েনের পক্ষে বলেছিলেন। সেখানে যে দুজন অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা সেনা নিয়োগের বিরোধিতা করেছিলেন, তাঁরাও কোনো গ্রহণযোগ্য যুক্তি দিতে পারেননি। যেমন তাঁরা বলেছেন, সেনাবাহিনী থাকলে পুলিশ ঠিকমতো কাজ করবে না। ১৯৯১ থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত নির্বাচনে দেখা গেছে, সেনাবাহিনী থাকলে বরং পুলিশ তার সঠিক ভূমিকাটি পালন করে। তাঁরা এও বলেছেন, অতীতে ক্ষমতা দখলে সেনাবাহিনীর হস্তক্ষেপের ঘটনা বিবেচনায়ও সেনাবাহিনীকে দূরে রাখা উচিত। কিন্তু সঠিক তথ্যটি হচ্ছে, অন্তত নির্বাচনকালে দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে সেনাবাহিনী কখনো রাষ্ট্রক্ষমতায় হস্তক্ষেপ করেনি। এ সময়ে অনুষ্ঠিত চারটি নির্বাচনের দুটিতে আওয়ামী লীগ ও দুটিতে বিএনপি জয়লাভ করে। সেনাবাহিনীর কোনো হস্তক্ষেপ বা অনিরপেক্ষতার অভিযোগ এই তথ্যেই অনেকাংশে নাকচ হয়ে যায়।
সেনা মোতায়েনের বিরোধিতা করে আরও দুটো বিষয় বলা হয় মাঝে মাঝে। এক. সেনা মোতায়েন করলে তাদের মধ্যে ‘সিভিল ভাইস’ ঢুকে যেতে পারে। দুই. এটি দেশের ইমেজের জন্য ভালো নয়। আমার কথা হচ্ছে, সেনাবাহিনীকে যদি নানা ধরনের ব্যবসা-বাণিজ্যে জড়ানো যায়, যদি তাদের দিয়ে দুর্যোগ এমনকি যানজটকালে কাজে লাগানো যায়, তাহলে শুধু নির্বাচনকালে সপ্তাহখানেক মোতায়েনে তাদের মধ্যে এসব ভাইস ঢোকার ভয় কেন? সেনাবাহিনী অতীতের চারটি নির্বাচনে ভোটকেন্দ্রে থাকার কারণে দেশে বা বিদেশে তাদের ইমেজের কোনো ক্ষতি হয়নি। এমনকি এসব নির্বাচন ও সেনাবাহিনী আন্তর্জাতিকভাবেও প্রশংসিত হয়েছে।
নির্বাচনকালে সেনা মোতায়েন শুধু একটি পক্ষের জন্যই ক্ষতিকর হতে পারে। সেটি হচ্ছে কারচুপি বা ভুয়া নির্বাচনের প্রত্যাশিত পক্ষ। সেনা নিয়োগে অসুবিধা হবে শুধু তাদেরই। আমি মনে করি, শুধু এ কারণে হলেও নির্বাচনকালে সেনাবাহিনী মোতায়েন করা উচিত।
৫.
আমাদের অবশ্য মনে রাখতে হবে, নির্বাচনকালে সেনাবাহিনী বা সামরিক বাহিনী মোতায়েনই একমাত্র সমাধান নয়। সুষ্ঠুভাবে নির্বাচনের আরও বহু শর্ত রয়েছে। যেমন নির্ভুল ভোটার তালিকা, প্রচার-প্রচারণায় সমান সুযোগ, মামলা-হামলা-হয়রানি থেকে প্রার্থী, পোলিং এজেন্ট ও দলের গুরুত্বপূর্ণ সংগঠকদের রক্ষা করা, কালোটাকার ব্যবহার প্রতিরোধ, সংখ্যালঘুদের জন্য বিশেষ নিরাপত্তা, ভোট সঠিকভাবে গণনা করে তা সঠিকভাবে প্রকাশের নিশ্চয়তা ইত্যাদি।
নির্বাচনকালে সেনা নিয়োগের সিদ্ধান্ত তাই সুষ্ঠু নির্বাচনের একমাত্র নিশ্চয়তা নয়। তবে এটি সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানে সদিচ্ছার প্রমাণবাহী একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। এ বিষয়ে যত তাড়াতাড়ি কমিশন একটি ইতিবাচক অবস্থান নিতে পারবে, ততই তা নির্বাচনব্যবস্থার প্রতি লুপ্তপ্রায় আস্থা ফিরিয়ে আনার জন্য মঙ্গলজনক হবে।
আসিফ নজরুল: অধ্যাপক, আইন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।