ভোট ঘরের দরজায় কড়া নাড়ছে। প্রচার–প্রচারণা তুঙ্গে উঠেছে। এ সময় সেটাই স্বাভাবিক। নির্বাচনের সময় প্রার্থীরা মাঠে নামবেন, ভোট চাইবেন—ভোটাররাও তাই চান। সেখানে প্রতিশ্রুতির ফুলঝুরি ফোটানো হচ্ছে। নির্বাচন ঘিরে মানুষের মনে সবচেয়ে বড় উদ্বেগ আর উৎকণ্ঠা হচ্ছে নির্বাচনী পরিবেশ সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ থাকবে কি না। কারণ, মাঝেমধ্যেই সহিংসতার ঘটনা মানুষের উদ্বেগ–উৎকণ্ঠাকে বাড়িয়ে তুলছে। কোনো কোনো জায়গায় সহিংসতা হচ্ছে।
নির্বাচন নিয়ে যে বিষয়টি সবার আগে মনে আসে, তা হলো প্রার্থীরা ভোটারদের কাছে নানা প্রতিশ্রুতি ও ইতিবাচক বক্তব্য দিয়ে ভোটারদের মন জয় করার চেষ্টা করবেন। তবে কোথাও কোথাও আমরা পেশিশক্তির ব্যবহার দেখছি, কোথাও কোথাও অর্থবিত্তের খেলা দেখতে পাচ্ছি। এটি কাম্য নয়।
আবার আমরা নির্বাচনী প্রচার-প্রচারণায় সুবাতাস বওয়ারও কিছু খবর দেখতে পাচ্ছি। উদাহরণ দিয়ে বলা যায় সিলেট-১ আসনের কথা। সেখানে নৌকা প্রতীকে নির্বাচন করছেন এ কে আবদুল মোমেন। এই আসনে বিএনপির প্রার্থী খন্দকার আবদুল মুক্তাদীর। প্রধান দুই দলের প্রার্থীরা একসঙ্গে বসেছেন, কথা বলেছেন।
ঢাকা-৩ আসনে বিএনপির ধানের শীষের প্রার্থী গয়েশ্বর চন্দ্র রায় এবং আওয়ামী লীগের নৌকা প্রতীকের প্রার্থী বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ। গত মঙ্গলবার বিএনপির ধানের শীষের প্রার্থী গয়েশ্বর চন্দ্র রায় আক্রান্ত হয়েছিলেন। নসরুল হামিদ তাঁকে দেখতে গেছেন। হামলার প্রতিবাদও করেছেন। বলেছেন, এই হামলা কাম্য নয়। দোষীদের গ্রেপ্তার করা হবে।
গাজীপুর-৪ আসনে নৌকা প্রতীকের প্রার্থী মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক ও প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের মেয়ে সিমিন হোসেন রিমির এলাকায় নির্বাচনী সুবাতাস বইছে। সেখানে বিএনপির ধানের শীষের প্রার্থী রিয়াজুল হান্নান। বিএনপির প্রার্থীর পোস্টার ছিঁড়ে ফেললে তিনি সরাসরি যোগাযোগ করছেন সিমিন হোসেন রিমির কাছে। এটাই তো দেশের সাধারণ জনগণ চায়। সাধারণ মানুষের এটাই চাওয়া। তাদের চাওয়া, আমাদের প্রার্থীরা আমাদের কাছে ভোট চাইবেন। তর্ক–বিতর্ক হবে। এর মধ্য দিয়ে জনগণ নিশ্চিন্তে নিরাপদে তাঁদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করে মনের মতো প্রতিনিধি নির্বাচন করবেন।
বাংলাদেশের এসব নির্বাচনী এলাকায় প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বীদের মধ্যে সৌহার্দ্য ও সম্প্রীতির সুন্দর একটা পরিবেশ তৈরি হয়েছে দেখে সারা দেশের মানুষের মধ্যে প্রত্যাশা বেড়ে যায়। দেশের মানুষ কিন্তু এ ধরনের ইতিবাচক উদাহরণগুলোর দিকেই তাকিয়ে থাকে। এসব আসনের প্রার্থীরা যদি পারেন, তাহলে অন্যরাও নিশ্চয় এমন সুন্দর সম্প্রীতির নজির গড়তে পারবেন!
প্রার্থীদের মধ্যে প্রতিযোগিতা ও প্রতিদ্বন্দ্বিতা থাকবেই। কিন্তু প্রতিদ্বন্দ্বিতা প্রায়শই হিংসা, বিদ্বেষ, হানাহানিতে গিয়ে গড়ায়। এতে রাজনীতির মাঠে বিষবাষ্প ছড়ায়।
এ ধরনের নেতিবাচক কর্মকাণ্ড সবচেয়ে বেশি প্রভাবিত করে নারী ও তরুণ ভোটারদের। বিশেষত যাঁরা এবার প্রথম ভোটার হয়েছেন, তাঁরা কিন্তু এটা দেখে খোদ রাজনীতির প্রতিই বীতশ্রদ্ধ হয়ে পড়তে পারেন। এমনটা হলে রাজনীতি ও দেশের জন্য বিরাট ক্ষতি হয়ে যাবে।
রাজনীতিতে প্রতিদ্বন্দ্বিতা থাকবেই, কিন্তু সেটা অসুস্থ হতে হবে কেন? রাজনীতি হবে প্রতিযোগিতামূলক। কোনো বিষবাষ্প যেন রাজনীতিকে আক্রান্ত না করে, প্রার্থীদের কাছে এটিই আমাদের আবেদন। আমরা আশা করছি, আগামী নির্বাচনের মধ্য দিয়ে সাধারণ ভোটাররা তাঁদের পছন্দসই জনপ্রতিনিধি নির্বাচন করতে পারবেন।
সিলেট-১, ঢাকা-৩, গাজীপুর-৪ আসনের মতো ইতিবাচক উদাহরণগুলোর খবর শুনলেই তখন মনে হয়, আহা রে, সারা দেশের নির্বাচনেই যদি সৌহার্দ্য ও সম্প্রীতির এমন দৃশ্য দেখা যেত। তাহলে তো আমরা মাথা উঁচু করে বলতে পারতাম, আমাদের গণতন্ত্রের যাত্রা সমুন্নত আছে। আমরাও পারি।
বাংলাদেশে যেসব স্থানে প্রার্থী ও তাঁদের সমর্থকেরা নজির স্থাপন করছেন, আমরা সবাই কামনা করি, তাঁদের মতোই সারা দেশে নির্বাচনে শান্তি ও সৌহার্দ্যের পরিবেশ বিরাজ করুক। বাস্তবে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে গোলমাল বাধে সমর্থকদের মধ্যে। সমর্থকদের আরও ধৈর্যের পরিচয় দিতে হবে। আমরা শান্তিপূর্ণ একটি নির্বাচন করতে পারলে বাংলাদেশের নাগরিক হিসেবেই তো গর্ব করতে পারব।
রাশেদা কে চৌধূরী সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ও গণসাক্ষরতা অভিযানের নির্বাহী পরিচালক
* লেখাটিতে প্রকাশিত বক্তব্য লেখকের নিজস্ব