নির্বাচনী ডঙ্কায় বিপন্ন পরিবেশ
সমস্যাটা বছরজুড়েই, তবে তা তুঙ্গে ওঠে নির্বাচনের কানাড়া বাজলে। দূষণ কত ধরনের আর কোন মাত্রায় হতে পারে, তা স্বাধীন বাংলার মানুষ হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে। যাঁরা এই সর্বনাশা কাণ্ডের আসল নায়ক, তাঁরা আবার দেশ উদ্ধারের শ্রেষ্ঠ সন্তান। মুখে তাঁদের উন্নয়নের ফুলঝুরি। আর উন্নয়নের সে দুধের নহর আমজনতার ঘরে ঘরে বিলি করার ইস্পাতদৃঢ় সংকল্প তাঁদের। শুধু সেখানেই তাঁরা থামেন না, অন্য কেউ যে মানুষের আদৌ কোনো মঙ্গল কামনা করতে পারে, সেটাও তাঁরা মানতে নারাজ। এসব লোকের স্বদেশপ্রেম, দলপ্রেম আর মানবপ্রেম এতই প্রবল যে তামাম দুনিয়ায় তাঁদের জুড়ি নেই।
ইহজগতে কেউ সামান্য স্বস্তিতে থাকুক, তা সইতে নারাজ এই মহা দেশপ্রেমিক, মহা মানবপ্রেমিকের দঙ্গল। এরা আসলে উৎপীড়নে বিশ্বাসী। অপরকে পীড়ন করার যে মজা মাস্তানরা দাঁত বের করে প্রকাশ করে, এরা তাদেরও বড় তরফ।
এখন ভোটের মৌসুম। ভাগ্য তবু ভালো, এবারে মৌসুম লেগেছে শুধু রাজধানী ঢাকার দুই সিটিতে। দেশের ১৭ কোটি আদমসন্তানের মাত্র দেড় কোটি এই অসীম উৎপীড়নের সরাসরি শিকার আপাতত। বাকি সাড়ে ১৫ কোটি মানুষ ভোটযন্ত্রণা থেকে অন্তত দূরে আছে। তারও কি জো আছে? টেলিভিশন আর ইউটিউবের হামলা এখন ঘরের ভেতরে সেঁধিয়ে সারা দিনরাত। মানুষ যাবে কোথায়?
নাগরিকেরা অবশ্য বিলক্ষণ জানেন, উৎপীড়নকারীরা এখন ভোটারকুলের ভোটকেন্দ্রে যাওয়ার তকলিফ থেকে মুক্তি দিয়েছেন। আমরা এমন এক মহান নির্বাচন কমিশন পেয়েছি যে তারা ভোটারকুলের মুশকিল আসানের সেরা নিদান আবিষ্কার করে গিনেস ওয়ার্ল্ড রেকর্ডসে সোনার হরফে বাংলাদেশের নাম লেখাতে পারে। সে তরজা এখন থাক। এখন আবার এ দেশে কার কত শত কোটির মান, তা নিয়ে আদালত প্রায়ই গরম হয়ে ওঠে।
আমরা যারা দেড় কোটি গুনাহগার এই ঢাকা শহরে স্রেফ পেটের দায়ে বাস করতে বাধ্য হচ্ছি, তাদের ওপর কর্তাদের সেবার নমুনা কিছু বয়ান করি। তার আগে বলে নিই, পশ্চিমের কিছু বেতমিজ উঠেপড়ে লেগেছে আমাদের এই স্বর্গতুল্য দেশটির গিবত গাইতে। তাদের যেন একটাই কাজ, তামাম দুনিয়ার সবচেয়ে দূষিত দেশের ফর্দে আমাদের দেশের নাম, বিশেষ করে তিলোত্তমা রাজধানী ঢাকার নাম সবার শীর্ষে বসিয়ে দেওয়ার। তাতে অবশ্য আমরাও বুক ফুলিয়ে বলতে পারি, দেখো, দেখো, আমরাই অনেক খাতে সবার সেরা। দুর্নীতিতে সেরা, মানি লন্ডারিংয়ে সেরা। নদী–বন দখলে সেরা। লুটপাটেও সেরা। কেন্দ্রীয় ব্যাংক একমাত্র আমরাই লুট করে ফিলিপাইনের ক্যাসিনোয় পাঠিয়ে দুনিয়ার নাম্বার ওয়ান।
কিন্তু হালফিল আমরা নতুন সেরার তালিকায় উঠেছি, যেটা নিয়ে তামাম দুনিয়ার মাথা বিগড়ে যাওয়ার জোগাড়। দূষণ। আমাদের পানি, আমাদের বাতাস, আমাদের মাটি দুনিয়ার সবচেয়ে বেশি খারাপ। আমাদের খাবার দুনিয়ায় সবচেয়ে বিষাক্ত। এখানে রাস্তায় খুন খারাবি হয়। ঘরে-বাইরে, পথেঘাটে, বাসে-লঞ্চে, ট্রেনে নারী-শিশু বলাৎকারের ঘটনা ঘটে। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রনেতাদের কেউ কেউ শত বলাৎকারের রেকর্ডের অধিকারী। র্যাগিং হয় না, এমন কলেজ–বিশ্ববিদ্যালয় এখন খুঁজে পাওয়া কঠিন। এসব মহৎ কর্মে মান্যবর প্রক্টর, ভিসিগণ উদার মনে সহযোগিতা করেন। অর্ধচন্দ্র ছাড়া কোনো ভিসি স্বীয় পদ ছাড়েন না।
এমন সেরা দেশে যখন গণতন্ত্রের ডঙ্কা বেজে ওঠে, তখন আমরা কবরের মানুষকেও আমাদের অতি দামি সুখবরগুলো শোনাতে ভুলি না। এযাবৎ ইহুদি-নাসারা-খ্রিষ্টানরা যত যন্ত্র বানিয়েছে, আমরা তার সব কটি একসঙ্গে বাজিয়ে যে অর্কেস্ট্রা সৃষ্টি করি, তা বেটোফেন, মোৎজার্ট, তানসেন স্বপ্নেও ভাবেননি। সে গগনবিদারী অর্কেস্ট্রা চলে ২৪ ঘণ্টা। কোনো শিশু দুনিয়ায় এসে মুষ্টিবদ্ধ হাত তুলে নিজের অধিকার ঘোষণা করবে, সে গুড়ে বালি। তার কান্না হারিয়ে যায়, যেমন ঘরে কিংবা হাসপাতালে মর মর মানুষগুলোর শেষ কথাগুলো হারিয়ে যায় উন্নয়ন আর প্রতিশ্রুতির কাড়া-নাকাড়ায়। পরীক্ষার্থীর লেখাপড়া শিকেয় উঠেছে। শব্দদূষণের রেকর্ডে তো আমাদের ধারেকাছে কেউ নেই।
আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী শব্দের সহনীয় মাত্রা ২০ ডেসিবেল। কিন্তু ভোটের আগেও ঢাকায় শব্দদূষণের মাত্রা রয়েছে ১২০ ডেসিবেল বা তারও বেশি। ডয়চে ভেলে জানিয়েছে, ২০২১ সালের মধ্যে ঢাকার তিন ভাগের এক ভাগ মানুষ কোনো না কোনো বধিরতার শিকার হবে। হৃদ্রোগ ও অন্যান্য মানসিক রোগের শুমার আমার অজানা।
নগরজুড়ে এখন নেতা বানানোর নিশান উড়ছে। পাঁচিলে–দেয়ালে পোস্টার সাঁটার দিন ফতে। তাই সেসব নিশানের জায়গা এখন প্রায় আসমানে, ঝুলন্ত হয়ে। দড়িতে ঝুলে জানান দিচ্ছে তিলোত্তমা রাজধানী আরও কত রূপসী হচ্ছে। বেরসিক নির্বাচন কমিশন ভোটভিক্ষার আরজিগুলো শুধু কালো রঙে রাঙানোর কানুন জারি না করলে এই ভোট মৌসুমে তিলোত্তমা ঢাকা যে বিশ্বসুন্দরীর তকমা পেত, সেটা হলফ করে বলা যায়। দেশটা এমনিই ঝড়-বাদলের। এখন এই মাঘের শীতে ঝড়-বাদল না থাকলে কী হবে? ঘন কুয়াশায় কাগজের ফর্দ থাকে কতক্ষণ! পোস্টারের গায়ে পরিয়ে দেওয়া হয়েছে পলিথিনের জামা। আরজিনামারও তো আবরু রক্ষার দায় আছে ভবিষ্যতের নগরকর্তাদের! তা দেশে বে-আবরু আদমসন্তানের শুমারি যা-ই বলুক না কেন।
আমরা বেশ মৌজে আছি। নগরজুড়ে এখন জামাপরা ভোটভিক্ষার আরজিনামা দড়িতে দড়িতে ঝুলছে। এর একটা প্রতীকী অর্থ আছে। হবু কর্তারা জানিয়ে রাখছেন, বাপুরা, গদিনশিন হতে পারলে তোমাদেরও আমরা এমন করে গলায় দড়ি দিয়ে ঝুলিয়ে রাখব। এই দূষিত নগরে তোমরা ফুরফুরে হাওয়া খাবে আর মৌজ করবে।
ভাবছি, কত শত টন কাগজ এখন ঢাকায় হাওয়া খাচ্ছে? তার গায়ে যে জামা হয়েছে, তার ওজনও নিছক কম হবে না! পরিবেশ নিয়ে যাঁরা কাজ করেন, তারা হয়তো হিসাব করে বলতে পারবেন, এই শত শত টন কাগজ তৈরিতে কত শত টন গাছ বলি হয়েছে। আর এই টন টন পলিথিনের দূষণ থেকে মুক্ত করতে উঠতি ধনী বাংলাদেশের কী বিপুল পরিমাণ কড়ি গুনতে হবে। স্বাস্থ্যের যে ক্ষতি হবে, তার হিসাব করার কেউ আছেন নিশ্চয়। কত কত ওষুধ কোম্পানির পকেটে কত শত কোটি টাকা বেমালুম ঢুকে যাবে, তারও একটা নিকাশ করলে মন্দ হয় না।
পরিবেশের এই যে সর্বনাশ, তার দায় কার? দুনিয়ার কোন প্রান্তে এখন পোস্টার সেঁটে, মাইক ফুঁকে ভোটভিক্ষার কানুন আছে কি না, আমার জানা নেই। তবে এটুকু জানি, বাড়ির পাশে পশ্চিম বাংলা আর স্বাধীন বাংলাদেশে কেবল এই সর্বনাশা দস্তুর জারি আছে। ভারতের অন্য কোনো রাজ্যে নেই। বিলবোর্ড, প্যানা সাইন, ব্যানার, পোস্টার, মাইকে কর্তাভজার যে চর্চা পশ্চিম বাংলা আর বাংলাদেশে শানশওকতের সঙ্গে জারি আছে, তাও দুনিয়ার সেরা স্বৈরতন্ত্রী কোনো মুলুকে নেই।
ভারতে মহাপ্রতাপশালী বিজেপি সরকারের হামানদিস্তায় পিষে মরতে মরতেও ছাত্র-জনতা ‘আজাদি’ ‘আজাদি’ শোর তুলেছে। তাদের গলায় একটাই আওয়াজ, ‘হাম দেখেঙ্গে...’ । যেমন আমরা একদিন গাইতাম, ‘জয় বাংলা...’। সে ‘জয় বাংলা’ শুধু আওয়াজ ছিল না, ছিল স্বাধীনতার অভয়মন্ত্র। সময় এসেছে, ডিজিটাল বাংলাদেশে পোস্টারবিহীন, মাইকবিহীন, রাজপথে সভা-সমাবেশবিহীন নির্বাচন করার, দলীয় সভা করার। ভোটে মাইক ব্যবহার নিষিদ্ধ করতে হবে। নির্বাচন কমিশন সব প্রার্থীর জন্য অভিন্ন প্রচারের ব্যবস্থা করবে, নির্দিষ্ট কিছু স্থানে, একই রকম, একই গুরুত্বে। অপচয় বন্ধ হবে, নাগরিক জীবনে কিছুটা হলেও শান্তি ফিরবে, শহর–নগর পরিচ্ছন্ন থাকবে।
আমিরুল আলম খান: যশোর শিক্ষা বোর্ডের সাবেক চেয়ারম্যান
[email protected]