নির্বাচন যখন টিভি চ্যানেলেরও পরীক্ষা
ব্রিটিশ সম্প্রচারমাধ্যমের নিয়ন্ত্রক সংস্থা অফকম প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসনের কনজারভেটিভ পার্টির একটি অভিযোগ সরাসরি নাকচ করে দিয়েছে। কনজারভেটিভ পার্টির অভিযোগটি ছিল চ্যানেল ফোর টেলিভিশনের বিরুদ্ধে। চ্যানেল ফোর এ রকম যে বিতর্কের আয়োজন করেছিল তার মূল বিষয় ছিল জলবায়ু পরিবর্তনের সংকট ও তা মোকাবিলা। প্রধানমন্ত্রী জনসন এবং ব্রেক্সিট পার্টির নাইজেল ফারাজ বিতর্কে অংশ নেননি। চ্যানেল ফোর বিতর্কের মঞ্চে দুটি বরফের ভাস্কর্য প্রতিস্থাপন করে—যার একটিতে লেখা ছিল কনজারভেটিভ পার্টি এবং অন্যটিতে ব্রেক্সিট পার্টির নাম। কনজারভেটিভ পার্টি চ্যানেল ফোরের এই সিদ্ধান্তকে রাজনৈতিক পক্ষপাতমূলক বলে অভিহিত করে বিষয়টি তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য অফকমের কাছে নালিশ জানায়।
নালিশ জানানোর আরও একটি কারণ ছিল। বিতর্ক শুরুর সময়ে সেখানে দলটির পক্ষে হাজির হয়েছিলেন পরিবেশমন্ত্রী মাইকেল গোভ। তাঁর সঙ্গে বরিস জনসনের বাবা সিনিয়র জনসনও ছিলেন। তাঁদের দাবি ছিল কনজারভেটিভ পার্টির পক্ষে জলবায়ু পরিবর্তনের বিষয়ে সবচেয়ে ভালো বলতে পারবেন পরিবেশমন্ত্রী এবং এ কারণে তাঁকে সুযোগ দেওয়া উচিত। সিনিয়র জনসন দাবি করেন যে প্রধানমন্ত্রী ব্যস্ততার কারণে আসতে পারেননি। অফকমের কাছে পেশ করা নালিশে বলা হয় যে কনজারভেটিভ পার্টির অবস্থান তুলে ধরার সুযোগ না দিয়ে ভোটারদের বঞ্চিত করা হয়েছে এবং তা নির্বাচনকালীন সম্প্রচার রীতির সুস্পষ্ট লঙ্ঘন।
বলে রাখা ভালো, ব্রিটেনে নির্বাচনের সময়ে সম্প্রচারমাধ্যমগুলোকে সুনির্দিষ্ট নীতিমালা মেনে চলতে হয়। নির্বাচনের তারিখ ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে সব দলকে তাদের বক্তব্য তুলে ধরার জন্য সমান সুযোগ দিতে হয়। এই নীতিমালা বাণিজ্যিক রেডিও-টিভির জন্যও প্রযোজ্য। রাজনৈতিক দলের বিজ্ঞাপন এবং ভোটের প্রচারের বিজ্ঞাপনের ক্ষেত্রেও কড়াকড়ি নিয়ন্ত্রণ রয়েছে। দলগুলো বিনা মূল্যে নির্দিষ্ট সময়ের জন্য বিজ্ঞাপন দিতে পারে।
সংবাদপত্রগুলোর ক্ষেত্রে অবশ্য এ রকম নিয়ন্ত্রণ নেই এবং প্রতিটি পত্রিকাই প্রকাশকদের রাজনৈতিক বিশ্বাস ও সমর্থনের আলোকে দলগুলোর পক্ষ অবলম্বন করে। পত্রিকাগুলোর এই দলীয় পক্ষপাতের কারণেই সম্প্রচারমাধ্যমের নিরপেক্ষতা ও ভারসাম্য বজায় রাখার বিষয়টিকে বিশেষভাবে গুরুত্ব দেওয়া হয়। পত্রিকার প্রচারসংখ্যার তুলনায় টিভি-রেডিওর শ্রোতাসংখ্যা বহুগুণ বেশি হওয়াতেই এই ব্যবস্থা।
অফকম কনজারভেটিভ পার্টির অভিযোগ বাছবিচার করে মঙ্গলবার বলেছে, চ্যানেল ফোরের সিদ্ধান্ত ন্যায্য ছিল। কেননা, অন্যান্য দলের নেতারা শুধু দলীয় প্রধানদের মধ্যে বিতর্কে রাজি হয়েছিলেন। প্রধানমন্ত্রী জনসনের বদলে গলতে থাকা বরফের ভাস্কর্য প্রতিস্থাপনের সম্পাদকীয় সিদ্ধান্তেও নিরপেক্ষতার শর্ত লঙ্ঘিত হয়নি। তাঁর অনুপস্থিতি বোঝানোর জন্য এটা খুব ছোট একটা পদক্ষেপ ছিল অভিহিত করে অফকম বলেছে, ভাস্কর্যগুলো তারা অনুপস্থিত রাজনীতিকদের আদলেও করতে পারত। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় আইনের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত স্বাধীন নিয়ন্ত্রক সংস্থার এই সিদ্ধান্ত অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ এবং সুদূরপ্রসারী। গণমাধ্যমে জবাবদিহি এড়ানোর কৌশল অনুসরণের আগে এখন থেকে রাজনীতিকেরা, বিশেষ করে যাঁরা ক্ষমতায় আসীন তাঁরা সম্ভবত দ্বিতীয়বার ভাবতে বাধ্য হবেন।
চ্যানেল ফোর বিবিসির মতো নয়, আবার পুরোপুরি বাণিজ্যিক টেলিভিশন বলতে যা বোঝায় তা–ও নয়। এটি জাতীয় প্রতিষ্ঠান অর্থাৎ আইন দ্বারা পরিচালিত। কিন্তু এর অর্থায়ন বিবিসির মতো নয়। বিবিসি চলে টেলিভিশনের জন্য সবাই যে বার্ষিক লাইসেন্স ফি দেন, সেই টাকায়। আর চ্যানেল ফোর চলে বাণিজ্যিক আয়ে। জাতীয় প্রতিষ্ঠান হিসেবে এর বর্তমান লাইসেন্স আগামী ২০২৪ সালে নবায়নের কথা, যা আগামী পার্লামেন্টের মেয়াদেই হবে। জলবায়ু বিতর্কে বরিস জনসনের অনুপস্থিতি বোঝাতে বরফের ভাস্কর্য ব্যবহার করায় ক্ষুব্ধ কনজারভেটিভ পার্টি চ্যানেল ফোরের ভবিষ্যৎ লাইসেন্স নবায়নের বিষয়ে হুমকি দিয়েছে বলে খবর দেয় বাজফিড নামের একটি অনলাইন। মুহূর্তের মধ্যে এই হুমকি বিতর্কের ঝড় তোলে। প্রধানমন্ত্রী জনসন বলতে বাধ্য হন যে এ রকম কোনো পরিকল্পনা তাঁদের নেই।
চ্যানেল ফোরের সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী জনসন এবং তাঁর দলের টানাপোড়েনের ইতিহাসটা আরও একটু পুরোনো। গত আগস্টে এডিনবরার টেলিভিশন উৎসবে চ্যানেল ফোরের বার্তাপ্রধান ডরোথি বায়ার্ন বরিস জনসনকে ‘মিথ্যুক’ অভিহিত করে প্রশ্ন রেখেছিলেন যে তিনি প্রধানমন্ত্রী হলে সাংবাদিকদের কী করা উচিত। কেউ মিথ্যা বলছেন জানার পরও আমরা কি দর্শকদের বলব না যে সেটি মিথ্যা? এই বক্তব্যে কনজারভেটিভ পার্টির নেতারা তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করেছিলেন।
বিস্ময়ের ব্যাপার হচ্ছে বিবিসিও এবার বিতর্কের বাইরে নেই। বিবিসির বিরুদ্ধে এবারই প্রথম জাতীয় প্রতিষ্ঠানের পরিবর্তে সরকারি প্রতিষ্ঠানের মতো ক্ষমতাসীন দলের প্রতি পক্ষপাতের জোরালো অভিযোগ উঠেছে। আর এসব অভিযোগ নাকচ করা সহজ নয় এবং তার জবাব দিতে বিবিসিকে নাকাল হতে হয়েছে। নির্বাচন ঘোষণার আগেই গত ১১ নভেম্বর প্রধানমন্ত্রী হিসেবে বিশ্বযুদ্ধে নিহতদের স্মরণে সিনোটাফে শ্রদ্ধা নিবেদনের সময় তিনি ফুলের মালা উল্টোভাবে বেদিতে রাখলেও বিবিসি সেটির বদলে পুরোনো একটি ছবি ব্যবহার করে। অভিযোগ ওঠে, প্রধানমন্ত্রী জনসনের ইমেজ রক্ষার জন্যই বিবিসি এমনটি করেছে। বিবিসি এই ভুল স্বীকার করতে বাধ্য হয়।
নির্বাচনের সময়সূচি ঘোষণার পর কয়েক দিন প্রধানমন্ত্রী জনসন যেখানেই গেছেন, সেখানেই সাধারণ মানুষের তোপের মুখে পড়েছেন এবং সেগুলো প্রচারের ক্ষেত্রে বিবিসি যথেষ্ট সংযম দেখায়। ফলে পক্ষপাতের অভিযোগ আবারও জোরদার হয়। এরপর ২২ নভেম্বর বিবিসির বিশেষ আয়োজন কোশ্চেন টাইম: লিডারস স্পেশালে জনসনের কাছে একজন দর্শক জানতে চাইলেন ক্ষমতাসীনদের সত্য বলা কতটা গুরুত্বপূর্ণ? এই প্রশ্নে তিনি যখন বলেন যে এটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ, তখন মিলনায়তনে অবিশ্বাসের হাসির রোল পড়ে যায়। কিন্তু বিবিসি তার খবরে ওই অংশটুকু সম্পাদনা করে বাদ দেয়। এ নিয়ে সমালোচনার ঝড় উঠলে প্রথমে বিবিসি সময়স্বল্পতার কারণে সম্পাদনার যৌক্তিকতা তুলে ধরে। কিন্তু তাতে বিতর্কের অবসান না হওয়ায় বিবিসি শেষ পর্যন্ত ভুল স্বীকার করে দুঃখ প্রকাশ করে।
প্রযুক্তির কল্যাণে সোশ্যাল মিডিয়ার যে বিকাশ এবং প্রসার ঘটেছে, তাতে বিশ্বজুড়ে সাংবাদিকতা ও গণমাধ্যম ক্রমেই নতুন নতুন চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ছে। ব্রিটেনও এ ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম নয়। নির্বাচন হচ্ছে রাজনীতিকদের জন্য আস্থা ও বিশ্বাসযোগ্যতার পরীক্ষা। কিন্তু সম্প্রচারমাধ্যমকেও এবার যে কঠিন পরীক্ষার মুখে পড়তে হয়েছে, তা ব্রিটিশ রাজনীতিতে একটি নতুন মাত্রা যোগ করেছে।
কামাল আহমেদ: সাংবাদিক