এবারের তিন সিটি করপোরেশনের নির্বাচন নিয়ে অনেক সমালোচনা হয়েছে। এই লেখার প্রসঙ্গ শুধুই গণমাধ্যম। অনেকে ভাবতেন, দেশের অন্য কোথাও ভোট ডাকাতি হলেও ঢাকা শহরে তা কখনো সম্ভব হবে না। কারণ, ঢাকায় রয়েছে ২৫টি টিভি চ্যানেলের অন্তত দুই শতাধিক সাংবাদিক ও ক্যামেরা। বিভিন্ন সংবাদপত্রের শত শত সাংবাদিক ও ক্যামেরাম্যান। অ্যামেচার বা ফ্রিল্যান্স ফটোসাংবাদিক ও ক্যামেরাম্যান তো আছেই। মোবাইল ফোন ক্যামেরাম্যানদের হিসাব এখানে ধরছি না। সেটা সারা দেশে রয়েছে। এত এত ক্যামেরা ও সাংবাদিকদের চোখের সামনে ঢাকা শহরে ভোট-সন্ত্রাস করা সম্ভব হবে না বলে মনে হতো। এসব ভোট ডাকাতি বা ভোট-সন্ত্রাস উপজেলায় বা অন্য শহরে সম্ভব।
কিন্তু গত ২৮ এপ্রিল ঢাকার দুই সিটি ও চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের নির্বাচনে আমাদের এই ধারণা ভুল প্রমাণিত হয়েছে। ভোট-সন্ত্রাসীরা গণমাধ্যমকে তোয়াক্কা করেনি। ২৯ এপ্রিলের অন্তত ছয়টি গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় দৈনিকের রিপোর্টে বলা হয়েছে: ঢাকা ও চট্টগ্রামে অনেক ভোটকেন্দ্রে সাংবাদিকদের ঢুকতে দেওয়া হয়নি। অনেকের ভিডিও ক্যামেরা ভেঙে দেওয়া হয়েছে। অনেকের স্টিল ক্যামেরাও ভেঙে দেওয়া হয়েছে বা ছবি ডিলিট করতে বাধ্য করা হয়েছে। অনেক সাংবাদিককে মারধর করা হয়েছে।
তবে আমাদের সৌভাগ্য, গণমাধ্যমকর্মীদের ওপর এত সন্ত্রাস ও আক্রমণের পরও ঢাকা ও চট্টগ্রামের বহু সাংবাদিক ও রিপোর্টার সাহসিকতার সঙ্গে তাঁদের দায়িত্ব পালন করেছেন। তাঁদের অভিনন্দন জানাই। ২৮ এপ্রিল বিভিন্ন টিভি চ্যানেলের লাইভ কভারেজ, সংবাদচিত্র, নির্বাচন পর্যালোচনা (টক শো) ইত্যাদির মাধ্যমে ঢাকা ও চট্টগ্রামের নির্বাচন প্রহসন অনেকটাই প্রতিফলিত হয়েছে। বেশির ভাগ সাংবাদিক, আলোচক ও নির্বাচন বিশেষজ্ঞ ২৮ এপ্রিলের নির্বাচনকে তামাশা বলেই বর্ণনা করেছেন। সংযুক্ত ভিডিওচিত্র তাঁদের বক্তব্যকে আরও জোরদার করেছে। এটা হলো গণমাধ্যমের শক্তি ও ইতিবাচক দিক।
ভোট-সন্ত্রাসীরা জানত, যদি ভোটকেন্দ্রে গণমাধ্যম তাদের শতকরা ১০০ ভাগ দায়িত্ব পালন করতে পারে, তাহলে ভোট ডাকাতির যে চিত্র মিডিয়ায় উঠে আসবে তা হবে ভয়াবহ। প্রধান নির্বাচন কমিশনার শত বক্তৃতা দিয়েও তা ঢাকতে পারবেন না। এই প্রহসনের নির্বাচন বাতিল করা ছাড়া তাঁদের কোনো উপায় থাকবে না। তাই ভোট সন্ত্রাসীরা গণমাধ্যমকে ঠিকভাবে কাজ করতে দেয়নি। সন্ত্রাসীদের পেশিশক্তির কাছে সাংবাদিক ও ক্যামেরাম্যানরা পরাজিত হয়েছেন। এ ক্ষেত্রে গণমাধ্যমকর্মীদের সহায়তা করতে পারত পুলিশ, র্যাব ও নির্বাচনী কর্মকর্তারা। প্রথমত, সব কেন্দ্রে পুলিশ, র্যাব ছিল না। অনেক কেন্দ্রে পাহারারত পুলিশ ও দায়িত্ব পালনরত ভোট কর্মকর্তারা সাংবাদিককে রক্ষা না করে ভোট–সন্ত্রাসীদের সহায়তা করেছে। এই যখন ভোটকেন্দ্রের অবস্থা তখন সাংবাদিক ও ক্যামেরাম্যানরা পেশাগত দায়িত্ব পালন করবেন কীভাবে? এবারের নির্বাচনে পুলিশ যেভাবে ভোট-সন্ত্রাসীদের সহযোগী হয়েছে, অতীতে তেমন দেখা যায়নি।
এবারের সিটি নির্বাচন প্রমাণ করেছে ক্যামেরা বা গণমাধ্যম নয়, আসলে বাস্তবে মাস্তান ও সন্ত্রাসীরাই শক্তিশালী। আর সন্ত্রাসীরা যদি ক্যামেরা ভেঙেই দিতে পারে, তাহলে ক্যামেরা আর সত্য চিত্র দেখাবে কী করে? আর পুলিশ ও নির্বাচনী কর্মকর্তা যদি ভোট-সন্ত্রাসের সহযোগী হয়, তাহলে এই নিরস্ত্র সাংবাদিক ও ক্যামেরাম্যানকে রক্ষা করবে কে? এ ব্যাপারে নির্বাচন কমিশন যদি ‘নিরপেক্ষ’ ভূমিকা পালন করে ও ভোটের দিন জমা দেওয়া লিখিত অভিযোগ পড়ার সময় না পায়, তাহলে ভোট-সন্ত্রাস বন্ধ করবে কে?
দেশের বিভিন্ন সংবাদপত্র, ম্যাগাজিন, টিভি চ্যানেল, এফএম রেডিও কর্তৃপক্ষ সবাইকে এই পরিস্থিতি পর্যালোচনা করার জন্য অনুরোধ করছি। সন্ত্রাসীরা যদি মিডিয়াকে বলপূর্বক বের করে দিতে পারে, ক্যামেরা ভেঙে দিতে পারে, তাহলে মিডিয়ার ভূমিকা বলে আর কিছু থাকে কি? এ রকম আচরণ করেও সিটি নির্বাচন যদি আইনি সমর্থন পেয়ে যায় তাহলে এই দৃষ্টান্ত অনুসরণ করে ভবিষ্যতে দুর্নীতিবাজ, জঙ্গি, রাজনৈতিক সন্ত্রাসী, টেন্ডারবাজ, স্থানীয় মাস্তান, চাঁদাবাজ এ রকম দুশ্চরিত্রের সবাই মিডিয়া কর্মীর ওপর বলপ্রয়োগ করার সাহস পাবে। তাঁর ক্যামেরা ভেঙে দেওয়ার সাহস পাবে। তখন নিরস্ত্র সাংবাদিক কী করবেন? এ ব্যাপারে একটা কৌশল নির্ধারণের জন্য সব পেশাজীবী সাংবাদিককে আলোচনায় বসতে হবে। সাংবাদিক ইউনিয়ন এ ব্যাপারে নেতৃত্ব দেবে কি না সন্দেহ। দলনিরপেক্ষ পেশাজীবী সাংবাদিকদের এই পরিস্থিতি পর্যালোচনা করতে হবে।
কোনো সংবাদপত্র, টিভি বা রেডিও ভোটের দিনের বিকৃত ছবি বা ভুল তথ্যসংবলিত খবর প্রকাশ করলে তাও নিন্দনীয়। গণমাধ্যম কোনো দলের বা প্রার্থীর পক্ষে কাজ করতে পারে না। যারা করছে তাদের পাঠক, দর্শক চেনেন। আমাদের ধারণা, বেশির ভাগ গণমাধ্যম দলনিরপেক্ষ ও সত্যনিষ্ঠ। সে জন্য ভোট-সন্ত্রাসীরা ভোটকেন্দ্রে সাংবাদিকদের ওপর চড়াও হয়েছে।
আরেকটা অদ্ভুত মানসিকতা লক্ষ করা যাচ্ছে। তাহলো: যারা ভোটের দিনের প্রকৃত চিত্র তুলে ধরেছে, তাদের ‘সরকারবিরোধী’ বা ‘আওয়ামীবিদ্বেষী’ বলে সমালোচনা করা হচ্ছে। এসব পত্রিকা বা টিভি নির্বাচনের কী কী ভুল তথ্য দিয়েছে বা কী কী বানোয়াট ছবি প্রকাশ বা প্রচার করেছে, তা কোনো সমালোচক তুলে ধরছেন না। তাঁরা ঢালাওভাবে ‘আওয়ামীবিদ্বেষী’ বলে প্রচার করে পাঠককে বিভ্রান্ত করছেন। আমরা মনে করি, কোনো পত্রিকা বা টিভির ভুল তথ্য প্রচার বা বিকৃত ছবি প্রকাশের অধিকার নেই।
অমিতাভ চৌধুরী
কলকাতার খ্যাতনামা সাংবাদিক অমিতাভ চৌধুরী ২ মে প্রয়াত হয়েছেন। বাংলা সংবাদপত্র ও সাংবাদিকতাকে যাঁরা আধুনিক রূপ দিয়েছেন, তাঁদের মধ্যে অমিতাভ চৌধুরীর নাম উল্লেখযোগ্য। ষাটের দশকে কলকাতার আনন্দবাজার পত্রিকার বার্তা সম্পাদকের দায়িত্ব গ্রহণের পর যেমন আনন্দবাজারকে তিনি জনপ্রিয়তার শীর্ষে নিয়ে গিয়েছিলেন, তেমনি বাংলা সাংবাদিকতার একটি টেকসই আধুনিক
রূপ দিতে পেরেছিলেন। সঙ্গে আরও ছিলেন সন্তোষ কুমার ঘোষ, গৌরকিশোর ঘোষ, নিখিল সরকারসহ আরও কয়েকজন নিবেদিতপ্রাণ সাংবাদিক। সেই আনন্দবাজার পত্রিকা এখনো পশ্চিমবঙ্গে বাংলা সাংবাদিকতায় নেতৃত্ব দিচ্ছে। অমিতাভ চৌধুরী বিশ্বভারতীর ছাত্র ও পরে শিক্ষক ছিলেন। রবীন্দ্র অন্তঃপ্রাণ। রবীন্দ্রনাথ বিষয়ে কয়েকটি বইও লিখেছিলেন। তবে তাঁর সাংবাদিকতা জীবন নিয়ে স্মৃতিচারণামূলক বই সংবাদের নেপথ্যে (১৯৮১) একটি উল্লেখযোগ্য বই। বইটি সাংবাদিকেরা পড়লে উপকৃত হবেন। পেশাদারি সাংবাদিকতা পেশা সম্পর্কে বহু কিছু জানা যায় এই বই পড়ে। একজন জুনিয়র রিপোর্টার থেকে তিনি কী করে এত বড় জাঁদরেল সাংবাদিক হয়েছিলেন, সেই সংগ্রামের কথাও জানা যায় এই বই পড়ে। অমিতাভ চৌধুরীর মৃত্যুর সঙ্গে আধুনিক বাংলা সাংবাদিকতার একটি অধ্যায়ের অবসান হলো।
ফয়েজ আহ্মদ স্মারকগ্রন্থ
খ্যাতনামা সাংবাদিক, সাহিত্যিক ও সংগঠক ফয়েজ আহ্মদ স্মরণে বাংলা একাডেমি একটি স্মারকগ্রন্থ প্রকাশ করেছে। সম্পাদনা করেছেন সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী ও কামাল লোহানী। আমাদের দেশের সাংবাদিকতায় ফয়েজ আহ্মদ একটি বর্ণাঢ্য নাম। পঞ্চাশের দশকের শুরুতে রিপোর্টার পদে কাজ শুরু করে তিনি একাধিক সাপ্তাহিক ও জাতীয় সংবাদ সংস্থার প্রধান সম্পাদক হয়েছিলেন। ষাটের দশকে আজাদ ও ইত্তেফাক পত্রিকার চিফ রিপোর্টার হিসেবে তিনি ব্যাপক খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। ইতিহাসখ্যাত ‘আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা’ কভার করে তিনি বহু পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলেন। স্বাধীনতাপূর্ব কালে সাপ্তাহিক স্বরাজ ও পরে বঙ্গবার্তা সম্পাদনা তাঁর আরেকটি উল্লেখযোগ্য কীর্তি। সাহিত্যজগতেও তাঁর বড় অবদান রয়েছে। পঞ্চাশের দশক থেকে তিনি একজন ছড়াকার হিসেবে প্রতিষ্ঠিত। আশির দশকে এরশাদবিরোধী আন্দোলন, জাতীয় কবিতা পরিষদ গঠন, সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট গঠন ও দেশের প্রথম আর্ট গ্যালারি ‘শিল্পাঙ্গন’ প্রতিষ্ঠায় তাঁর নেতৃত্ব ও অবদান সবাই শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করেন। এই স্মারকগ্রন্থে বিভিন্ন লেখক তাঁর নানামুখী প্রতিভা ও অবদানের কথা তুলে ধরেছেন।
মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর: মিডিয়া ও উন্নয়নকর্মী।