ইউক্রেনে যখন রুশ বাহিনী ব্যাপক মাত্রায় হামলা চালাচ্ছিল, ঠিক সে সময় ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী নাফতালি বেনেত মস্কো সফর করেছেন। মস্কো সফর শেষ করে সেখান থেকে তিনি বার্লিনে যান। এরপরই জনমনে ধারণা হয়, বেনেট যুদ্ধ থামানোর বিষয়ে ইউক্রেন এবং রাশিয়ার মধ্যে মধ্যস্থতা করতে যাচ্ছেন।
বেনেত শান্তি প্রতিষ্ঠায় মধ্যস্থতা করতে পারেন—এ আশা করাটা অর্থহীন কিছু নয়। কারণ, ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি এবং রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন উভয়ের সঙ্গেই তিনি খোলামেলা আলাপ করার যোগ্যতা রাখেন।
বলা হচ্ছে, বেনেতকে মধ্যস্থতাকারী হিসেবে কাজ করতে সমর্থন দিচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র সরকার। এ ছাড়া জার্মানির চ্যান্সেলর ওলাফ শুলৎজ (যিনি মাত্র কদিন আগেই জেরুজালেম সফর করে গেছেন) এবং ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল মাখোঁও তাঁকে নিখাদ সমর্থন দিচ্ছেন।
অনেক ভাষ্যকার এবং বিশ্লেষক মনে করেন, ইসরায়েলের উদ্যোগটি বীরত্বপূর্ণ ছিল। এর মধ্য দিয়ে ইসরায়েল আন্তর্জাতিক শক্তিধর মধ্যস্থতাকারীদের শীর্ষস্থানীয় দেশগুলোর মধ্যে স্থান পেয়েছে।
নিশ্চিতভাবেই এতে ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি বন্ধ করাসহ অন্যান্য ইসরায়েলি স্বার্থ সম্পর্কিত বিষয়ে ইসরায়েলের লাভ হয়েছে। এতে ইসরায়েলের ভেতরে বেনেতের রাজনৈতিক ভাবমূর্তিও উজ্জ্বল হয়েছে।
তবে এসবের বাইরে যে আলোচনাটি চলছে, সেটি অনেক বেশি যুক্তিযুক্ত। অনেকেই মনে করছেন, রাশিয়া ইসরায়েলকে মধ্যস্থতাকারী হিসেবে চায় বটে, কিন্তু সত্যিকারের শান্তি প্রতিষ্ঠা তার উদ্দেশ্য নয়। অর্থাৎ পুতিন উভয় পক্ষের জন্য সম্মানজনক আপসের পথে না গিয়ে ইউক্রেনকে একতরফা আত্মসমর্পণ করানোতে রাজি করানোর জন্যই বেনেতের সঙ্গে আলোচনা করেছেন।
পুতিনের কর্মকাণ্ড বিশ্লেষণ করলে বোঝা যায়, তিনি খুবই ঠান্ডা মাথায় সুপরিকল্পিতভাবে ইউক্রেনের দিকে এগিয়েছেন। পরিকল্পনামাফিক ইউক্রেনের শহরগুলোতে সন্ত্রাসীদের মতো আতঙ্ক ছড়াচ্ছেন। এটি তাঁর পরিকল্পিত এবং কার্যকর কৌশলকে প্রতিফলিত করে।
শক্তিমত্তা এবং ধ্বংসাত্মক ক্ষমতা প্রদর্শনের মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র ও ন্যাটোকে মোকাবিলা করার ক্ষেত্রে পুতিন কোনো রাখঢাক করেননি। প্রথম থেকেই তিনি যুক্তরাষ্ট্র ও ন্যাটোর বিরুদ্ধে স্পষ্টভাবে হুমকি দিয়ে আসছেন।
এ বিষয়ে কারও সন্দেহ নেই যে ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কির পতন ঘটিয়ে সেখানে নিজের পছন্দমতো একটি পুতুল সরকার বসানোই পুতিনের মূল অভীষ্ট।
এ উদ্দেশ্যের বার্তা জেলেনস্কি, ইউরোপিয়ান নেতারা এবং বাইডেন প্রশাসনের কাছে পৌঁছে দেওয়ার জন্য পুতিন যদি বেনেতকে কাজে লাগানোর চেষ্টা করে থাকেন, তাহলে তা বেনেতের জন্য মোটেও সম্মানজনক হবে না।
যুদ্ধবিরতি দিয়ে যখন দুই পক্ষের মধ্যে সমঝোতা চুক্তি হয়, তখন শান্তি প্রতিষ্ঠা ও ধ্বংস এড়ানোর স্বার্থে উভয় পক্ষকেই বড় কিছু ছাড় দিতে হয়।
এ ধরনের পরিস্থিতিতে মধ্যস্থতাকারীর মূল কাজ হলো চুক্তির শর্তাবলিকে উভয়ের কাছে গ্রহণযোগ্য করে তোলা এবং তারপর একটি চুক্তি করা। যেহেতু দুই পক্ষ একে অপরের সঙ্গে কথা বলছে না, সেহেতু দুই পক্ষের মধ্যে একটি যোগাযোগ চ্যানেল হয়ে কাজ করাও মধ্যস্থতাকারীর বড় কাজ।
অনেক ক্ষেত্রে মধ্যস্থতাকারী আরও অনেক বেশি সক্রিয়ভাবে জড়িত থাকে। অনেক মধ্যস্থতাকারী অচলাবস্থা কাটিয়ে ওঠার জন্য নিজ থেকে সৃজনশীল বিকল্পের প্রস্তাব করে এবং উভয় পক্ষকে নিরাপত্তা বা অর্থনীতি বা অন্যান্য বিষয়ের গ্যারান্টিও দিয়ে থাকে।
১৯৭৩ সালে আরব–ইসরায়েলি যুদ্ধে অস্ত্র বিরতির জন্য যুক্তরাষ্ট্র মধ্যস্থতা করেছিল। সেই মধ্যস্থতায় যুক্তরাষ্ট্রের নিজের বাহিনীও ছিল।
এর কয়েক বছর পরে, মিসরের প্রেসিডেন্ট আনোয়ার সাদাত এবং ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী মেনাচেম বিগিনের মধ্যে ঐতিহাসিক আলোচনা হয়, যা মিসরের সঙ্গে ১৯৭৯ সালে ইসরায়েলের চুক্তির দিকে গড়িয়েছিল। ওই চুক্তির সময় তৃতীয় পক্ষ হিসেবে ছিল যুক্তরাষ্ট্র। যুক্তরাষ্ট্র সরকার ক্যাম্পডেভিডে আলোচনার সুবিধা করে দেয়। পাশাপাশি উভয় পক্ষকে যথেষ্ট অর্থনৈতিক ও সামরিক সহায়তা দিয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র।
সিনাইয়ের পেট্রোলিয়াম ক্ষেত্রগুলো থেকে ইসরায়েল সরে আসবে এবং তার বিনিময়ে যুক্তরাষ্ট্র তাকে জ্বালানি সহায়তা দেবে—যুক্তরাষ্ট্র তখন ইসরায়েলকে এ নিশ্চয়তা দিয়েছিল।
ইউক্রেন-রাশিয়ার ক্ষেত্রে যোগাযোগ চ্যানেল হিসেবে কাজ করতে পারার বাইরে ইসরায়েলের বাড়তি দায়িত্ব নেওয়ার মতো সক্ষমতা অতি অল্পই আছে। জেরুজালেমের হাতে যুক্তরাষ্ট্রের মতো ক্ষমতা নেই, যা দিয়ে কোনো পক্ষকে দেশটি অর্থনৈতিক কিংবা নিরাপত্তার নিশ্চয়তা দিতে পারে। তারপরও হয়তো পুতিন ওয়াশিংটনে ইসরায়েলের প্রভাব আছে মনে করে বেনেতকে মধ্যস্থতাকারী হিসেবে চেয়ে থাকতে পারেন।
আরেকটি বিষয় হলো সফল মধ্যস্থতার জন্য সংঘাতময় পরিস্থিতির ‘পাকা’ অবস্থার দরকার হয়। অর্থাৎ যখন উভয় পক্ষ লড়াই করতে করতে দুর্বল হয়ে পড়ে, তখন উভয়ই ওই অবস্থা থেকে বের হওয়ার চেষ্টা করে। এ অবস্থায় এক পক্ষ কিছুই পাবে না, আরেক পক্ষ সব দিক দিয়ে লাভবান হবে—এমনটা হয় না। এ ধরনের অবস্থায় দুই পক্ষই পরস্পরকে ছাড় দিয়ে জয়ের আনন্দ লাভ করে। আরব-ইসরায়েলি যুদ্ধের সময় এমন পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল। তখন মধ্যস্থতাকারীদের জন্যও সংকট থেকে বেরিয়ে আসার পথ বাতলে দেওয়া সহজ হয়েছিল। কিন্তু সংঘাত সেই ‘পাকা’ বা পরিণত অবস্থায় পৌঁছানোর আগেই মধ্যস্থতা করতে গেলে বিপত্তি বাধে। তখন যে পক্ষ আক্রমণে এগিয়ে থাকে, সেই পক্ষ মেনে নেওয়া কঠিন এমন সব দাবি তুলতে থাকে। মধ্যস্থতাকারীকে শক্তিধর পক্ষ সময়ক্ষেপণের ঘুঁটি হিসেবে ব্যবহার করে এবং আলোচনার মধ্যেই প্রতিপক্ষের ওপর হামলা বাড়াতে থাকে। এ অবস্থায় মধ্যস্থতাকারীকেও একসময় সংকট ঝুলিয়ে রাখার দায়ে দোষারোপ করা হতে থাকে।
রাশিয়া-ইউক্রেন সংঘাত এখন একেবারেই ‘অপক্ক’ অবস্থায় রয়েছে। রাশিয়া একেবারে আক্রমণাত্মক পর্যায়ে রয়েছে। তারা ইউক্রেনের শহরগুলো ধ্বংস করে ফেলছে। লড়াইটা সমানে সমানে চলছে না। এ অবস্থায় রাশিয়া চায় ইউক্রেন আত্মসমর্পণ করুক। সেই আত্মসমর্পণ প্রক্রিয়াটিকে আলোচনার ও চুক্তির মোড়কে আটকাতে চায় ক্রেমলিন। এ ক্ষেত্রে ইসরায়েলকে মধ্যস্থতাকারী হিসেবে রাখতে চায়।
মূলত পুতিন ইসরায়েল এবং বেনেতকে শান্তি প্রতিষ্ঠার তৃতীয় পক্ষ হিসেবে নয়, বরং নিজের শর্তগুলো ইউক্রেন ও পশ্চিমাদের ওপর চাপিয়ে দেওয়ার কাজে বার্তাবাহক হিসাবে ব্যবহার করছেন। যেহেতু শান্তি প্রতিষ্ঠায় রাশিয়ার সদিচ্ছার ঘাটতির বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে গেছে, সেহেতু শিগগিরই ইউক্রেনে রক্তপাত বন্ধের আশা করা কঠিন।
জেরুজালেম পোস্ট থেকে নেওয়া। ইংরেজি থেকে অনুবাদ: সারফুদ্দিন আহমেদ
● জেরাল্ড এম স্টেইনবার্গ ইসরায়েলের বার ইলান ইউনিভার্সিটির প্রোগ্রাম অন কনফ্লিক্ট ম্যানেজমেন্ট অ্যান্ড নেগোসিয়েশন বিভাগের প্রতিষ্ঠাতা ও ইমেরিটাস অধ্যাপক