কয়েক মাস হলো নিউইয়র্কের ম্যানহাটনে মেয়ের বাসায় আছি। আমাদের প্রধান কাজ হলো দুই নাতির দেখভাল করা। যার অন্যতম হচ্ছে বড় নাতিকে স্কুলে নিয়ে যাওয়া এবং ফেরত আনা। আমি যাই হেঁটে। আর নাতি বেশির ভাগ সময় স্কুটিতে (সাইকেলসদৃশ নিচু চাকার যান)। নাতির স্কুল দ্বিতীয় ও তৃতীয় অ্যাভিনিউয়ের মাঝামাঝি আয়তাকার দূরত্বে। এক পথে স্কুলে যাই, আরেক পথে ফিরে আসি। প্রথম দিন ফেরার পথে দেখলাম প্রশস্ত ফুটপাতে সবজি ও ফলের অনুমোদিত স্টল। ম্যানহাটনজুড়েই এ ধরনের স্টল আছে। এর পাশেই রাস্তায় পার্ক করা একটা বড় ভ্যান, দিনের ব্যবসা শেষে পণ্য নিয়ে স্টল গুটিয়ে বাড়ি ফেরার জন্য। আবার পরদিন সকালে একই স্থানে স্টল স্থাপন। প্রতিটি পণ্যের দাম লেখা আছে, তাই দরাদরি নেই। দেখলাম সবজি ও ফল বেশ তাজা, তাই থামলাম। কাছে গিয়ে বয়স্ক বিক্রেতার চেহারা দেখে বুঝলাম তিনি বাংলাদেশি। আর মুখ খুলতেই বুঝলাম তিনি সিলেটি।
স্বাধীনতাযুদ্ধের সময় আব্বা সিলেট এম সি কলেজে পড়াতেন। পাকিস্তানি সেনাদের তাড়া খেয়ে টিলাগড়ের স্টাফ কোয়ার্টার ছেড়ে একবার আব্বার ঘনিষ্ঠ বন্ধু অধ্যাপক আবদুল মতিন চৌধুরীর শ্বশুরবাড়ি ভাদেশ্বরে আশ্রয় নিই। পরেরবার সুরমা নদী পার হয়ে বাঘায়। এ সময় দুই কিস্তিতে প্রায় দেড় মাস গ্রামে অবস্থানকালে সিলেটি ভাষায় আমার একটি ক্রাশ কোর্স করার সুযোগ হয়। সেখান থেকে একটা তির নিয়ে ছুড়ি, ‘আফনার বাড়ি কুনহানো?’ জবাব এল, ‘গুলাবগঞ্জ’। চট্টগ্রাম ও সিলেটের লোকজনের সঙ্গে আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলার সুবিধা হলো, এ কারণে অনেক বন্ধ দুয়ারই খুলে যায়। এ ক্ষেত্রেও তা-ই হলো। আমরা বন্ধু হয়ে গেলাম। তাঁদের কয়েকজনকে নিয়েই আজকের আলাপন।
ফখরুল ইসলাম
একদিন বাসায় ফল আর সবজি নিয়ে ফিরতেই গিন্নির বকা, এত টমেটো আনছ কেন? আমি বললাম, অন্যদিনের মতো দুই পাউন্ড এনেছি। এটা দুই পাউন্ড? দেখলাম প্রায় ৯-১০টা টমেটো, কমপক্ষে ৩ পাউন্ড ওজন হবে। আনার আনতে কে বলল? আমি দেখলাম একটা আনারও আছে। আমি কেবল দুই পাউন্ড টমেটোর দাম দিয়েছি। বুঝতে বাকি রইল না, এটা ফখরুল ইসলামের কাজ! এরপর আমাদের মধ্যে একটা লুকোচুরি খেলা চলতে থাকে। তিনি বাড়তি কিছু সবজি, ফল আমার ব্যাগে ঢুকিয়ে দেন। আমিও দাম দেওয়ার সময় দুই-চার ডলার বেশি দিই। আমি অনুযোগ করি, তিনি বাড়তি ফল, সবজি দিয়েছেন। তিনি অনুযোগ করেন, ‘আফনে ডলার বেশি দেন’।
মাঝে কয়েক দিন দেখলাম তাঁর পরিবর্তে আরেকজন বাঙালি কাজ করছেন। জিজ্ঞাসা করলাম, উনি কোথায়? লোকটি বললেন, উনি (ফখরুল ইসলাম) দোকানের মালিক। ঠান্ডা বেশি দেখে আজ আসেননি। ফিরে এলে কথা হলো ফখরুল ইসলামের সঙ্গে। ১৯৯৭ সালে যুক্তরাষ্ট্রে এসেছেন। তাঁর বয়স ৬৩। কুইন্সে থাকেন। তীব্র শীত আর তুষারপাতের মধ্যে প্রতিদিন কাজ করেছেন। ছেলেমেয়ে ছয়জন। বড় মেয়ে ডাক্তার। আরেক মেয়ে নার্স, অন্যরা পড়াশোনা করছে। তারা চায় না ফখরুল ইসলাম আর এ ধরনের কঠিন কাজ করেন। আগে তিনটা স্টল ছিল, এখন একটাই। অন্যগুলো ছেড়ে দিয়েছেন।
আনোয়ার আহমদ
স্কুল থেকে বের হয়ে সোজা পশ্চিমে গেলেই তাঁর সবজি ও ফলের স্টল। তবে তিনি মালিক নন, কর্মচারী। মালিক একজন তুর্কি। ম্যানহাটনে তাঁর আরও স্টল আছে। আনোয়ারের বাড়ি বরিশালে। বয়স ৫০ ছুঁই ছুঁই। ঢাকায় মিরপুরে বাড়ি আছে। এখানে প্রায় সবারই দুই নৌকায় পা। ইচ্ছা, একসময় বাংলাদেশে ফিরে যাবেন। এখন আনোয়ারের মনে হচ্ছে, ছেলেমেয়েরা কেউ যেতে রাজি হবে না। তা ছাড়া দেশ থেকে লোকমুখে হানাহানির যা খবর পান, তাতে ভরসা হয় না। তবে কি মিরপুরের বাড়ি বিক্রি করে দিতে হবে?
তিনিও বাড়তি কিছু দিতে চান। আমি নিই না। তবে বাকির সুবিধা পাই। একদিন মেয়ে টাকা নিয়ে যায়নি। ১৫ ডলারের ড্রাগন ফ্রুট নিয়ে আসে। আমি পরের দিন গিয়ে মূল্য পরিশোধ করে আসি। তা ছাড়া কোনো পণ্য খারাপ হলে বলেন, আজ কিনবেন না। সোমবার নতুন চালান আসবে। আপনার জন্য রেখে দেব।
জিনাত
স্কুল থেকে ফেরার পথে নাতির বায়না থাকে, ‘ক্যান আই হ্যাভ সামথিং টু ইট (আমি কি কিছু খেতে পারি)? ’ বিশেষত নানি সঙ্গে থাকলে। স্কুল থেকে ফেরত আনার কাজটি তিনিই করে থাকেন। চিন্তা নেই, ফেরার পথেই ডাঙ্কিন ডোনাটস (মধ্যে ছিদ্রযুক্ত পিঠা। ওপরে মিষ্টি প্রলেপ আর ভেতরে ফলের জেলির মতো)। নাতির আবদার মেটান নানি। পথে ডোনাট ও ড্রিংকস শেষ করে ছোট ভাইয়ের জন্য ডোনাট নিয়ে আসে। একদিন দেখলাম ব্যাগে বাড়তি দুটি ডোনাট। স্ত্রীকে জিজ্ঞাসা করি, এগুলো কার জন্য? জোর করে দিয়েছে, দাম নেয়নি। দোকানের মালিক দুজন ভারতীয় ও পাকিস্তানি হলেও ম্যানেজার জিনাতসহ দুজন কর্মচারীই বাঙালি। এর মধ্যে পুরুষ ভদ্রলোক আবার আমার উপজেলা সন্দ্বীপের সন্তোষপুর গ্রামে বিয়ে করেছেন। পরদিন গিয়ে জিজ্ঞাসা করি, আপা, দাম না নিয়ে বাড়তি ডোনাট দিলেন? তিনি বলেন, ‘আমরা কাস্টমারকে খাতির করে এটা দিতেই পারি। এটা আমাদের নিয়মের মধ্যে।’ এখানে মেশিনে টাকা জমা নেওয়া ও রসিদ দেওয়া হয়। বাড়তি টাকা দেওয়ার সুযোগ নেই। তাই বাড়তি পণ্য ‘ক্রসোন্ট স্যান্ডউইচ’ কিনে ফিরে আসি। তা ছাড়া অকৃত্রিম ভালোবাসার মূল্য তো পরিশোধ করা যায় না!
আহমদ হালাল ফুড কার্ট
স্কুল থেকে বের হয়ে থার্ড অ্যাভিনিউ ধরে দক্ষিণে খানিকটা এগোলেই আহমদ ভাইয়ের হালাল ফুড কার্ট। সারা ম্যানহাটনে এ ধরনের ফুড কার্ট আছে। প্রায় তৈরি খাদ্যসামগ্রী ভ্যানে করে কার্টসহ এনে গ্যাসের চুলায় প্রক্রিয়াজাত করে গ্রাহকদের দেওয়া হয়। আহমদ মিসরের নাগরিক। দোকানটির তিনিই মালিক। প্রতিদিন পরিবারের সবাই মিলে খাদ্যসামগ্রী কাটাবাছা, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করেন। দিন শেষে ভ্যানসহ কার্ট বাড়ি ফেরত নিয়ে যান। প্রতিটি খাবারের ছবি ও দাম দেওয়া আছে। সালাম দিয়ে আমি চিকেন ওভার রাইস অর্ডার করি। পরিচ্ছন্ন আয়োজন। দুই-এক দিন যেতেই দেখি, খাবারের সঙ্গে বাড়তি একটা কিছু—ফ্রাই অথবা ফালাফেল (অনেকটা পেঁয়াজির মতো)। বাড়তি ডলার দিতে চাই, কিছুতেই নেবেন না। অনেকটা জোর করে গছাই। কিন্তু প্রতিদানে আবার বাড়তি কিছু-অতিরিক্ত চিকেন। কাঁহাতক আর দরবার করা যায়, ক্ষান্ত দিই। উল্লিখিত অন্য বাঙালিদের মতো আহমদেরও সংগ্রাম অভিন্ন। দেশে দুরবস্থা থেকে পরিত্রাণের জন্য যুক্তরাষ্ট্রে ঠাঁই নিয়েছেন। ছেলেমেয়েরাও ভালো পড়াশোনা করে চাকরি করে। তাঁরা সবাই তাঁদের বর্তমানকে উৎসর্গ করেছেন সন্তানদের উজ্জ্বল ভবিষ্যতের জন্য। দেশে ফিরবেন কি না, জিজ্ঞেস করলে বলেন, ‘ইনশা আল্লাহ’। মুখের অভিব্যক্তি দেখে মনে হয়, ইচ্ছা থাকলেও সম্ভবত আর ফেরা হবে না।
শেষ কথা
এক. ওপরের চরিত্রগুলোই আমাদের রিজার্ভ স্ফীত করে, দেশে বাড়িঘর করে আমাদের অর্থনীতিতে প্রবৃদ্ধি আনে। কিন্তু দেশে ফিরে বিমানবন্দর থেকেই শুরু হয় তাঁদের হেনস্তা, থানা-পুলিশের চাঁদাবাজির শিকারও তাঁরা। উচ্চ মূল্যের বিমানের টিকিটও কিনতে হয় তাঁদের। দেশে পাঠানো টাকার ওপর প্রণোদনা দেওয়া হচ্ছে ভালো কথা, কিন্তু তাঁদের সব রকম হয়রানি থেকে বাঁচাতে হবে। দেশের জন্য তাঁদের অবদানের স্বীকৃতি ও মর্যাদা দিতে হবে।
দুই. কীভাবে ফল, শাকসবজি ও খাবারের মতো ব্যবসা পরিচ্ছন্ন ও স্বাস্থ্যসম্মতভাবে করা যায়, তা তাঁদের কাছ থেকে শিখতে হবে। নগরপিতারা কীভাবে একই সঙ্গে নাগরিকদের ব্যবসা ও স্বল্প মূল্যে খাবার পাওয়ার সুযোগ দেওয়া যায়, সেই শিক্ষা নিতে পারেন।
তিন. নিউইয়র্কজুড়ে ফুটপাতে আশ্রয় নেওয়া বিভিন্ন বর্ণ ও চেহারার মানুষ দেখলেও বাঙালি বা দক্ষিণ এশীয় কাউকে আমার চোখে পড়েনি। তাঁরা পরিশ্রমের জীবনই বেছে নিয়েছেন। তাঁদের সবাইকে টুপি খোলা অভিবাদন।
আমাদের দেশে ফেরার সময় হয়ে এসেছে। যাওয়ার সময়, এমনকি দেশে ফিরেও নিউইয়র্কের এসব অনাত্মীয় স্বজনের কথা খুব মনে পড়বে!
মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান সাবেক সচিব ও অর্থনীতিবিদ