বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, বিশ্বে ১৫ বছর এবং এর বেশি বয়সী নারীদের মধ্যে প্রতি তিনজনে একজন জীবনের কোনো না কোনো সময় সহিংসতার শিকার হয়ে থাকেন। কোভিড অতিমারিতে এর মাত্রা অনেক বেড়েছে। জাতিসংঘের তথ্যমতে, বাল্যবিবাহের কারণে ১১ মিলিয়ন কিশোরী আর স্কুলে ফিরবে না, অতিদারিদ্র্যে পড়বে ৪৭ মিলিয়ন নারী।
এত গেল বৈশ্বিক হিসাব, এবার আমাদের দেশের কথায় আসা যাক। ২০১৫ সালে এক সমীক্ষায় দেখা যায়, ৭৩ শতাংশ নারী জীবনের কোনো না কোনো কোনো ধরনের সহিংসতার শিকার হয়েছেন, যার মধ্যে ৫০ শতাংশই শারীরিক নির্যাতন, ২৭ শতাংশ যৌন নির্যাতন, ২৯ শতাংশ মানসিক নির্যাতন, ১১ শতাংশ অর্থনৈতিক নির্যাতনের শিকার। উপরন্তু ৫৫ শতাংশ নারী তাঁদের জীবনে বিভিন্ন কাজে নানা ধরনের বাধার শিকার হয়েছেন। আবার এ নির্যাতনের শিকার নারীদের বেশির ভাগই ১৮-৩০ বছর বয়সী। দেশের পরিবার পরিকল্পনা সেবাগ্রহীতার তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণে দেখা যায়, এই বয়সী নারীরাই বেশির ভাগ ক্ষেত্রে যৌন ও প্রজনন-স্বাস্থ্যসেবাগ্রহীতা।
পরিবার পরিকল্পনা সেবা ও তথ্য পাওয়া এবং সংশ্লিষ্ট বিষয়ে পছন্দ ও সিদ্ধান্ত নিতে পারা প্রত্যেক মানুষের যৌন ও প্রজননস্বাস্থ্য অধিকার ও মৌলিক মানবাধিকার। কিন্তু আমাদের দেশের নারীরা এসব বিষয়ে নানা ধরনের বঞ্চনা ও নির্যাতনের শিকার।
আমাদের সমাজে নারীরা তাঁদের মতামত ও পছন্দের কথা সাধারণত অকপটে বলতে পারেন না। নারীদের প্রতি সমাজের নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি এর জন্য অনেকাংশে দায়ী। পরিবার পরিকল্পনা সেবার ক্ষেত্রেও পরিস্থিতি একই। এ সেবা একজন মানুষের জীবনকে সুরক্ষা দেয়, সহজ করে তোলে এবং সমাজ, রাষ্ট্র ও পরিবারকেও সহযোগিতা করে। পারিবারিক ও সামাজিক অসহযোগিতার কারণে অধিক সন্তানের চাপ, অনাকাঙ্ক্ষিত গর্ভধারণ, বাল্যবিবাহ, অল্প বয়সে গর্ভধারণ, ঝুঁকিপূর্ণ গর্ভপাতসহ এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট মাতৃমৃত্যু, শিশুমৃত্যু, অপুষ্টি ইত্যাদি নানা ঝুঁকিপূর্ণ, বিপজ্জনক ও ক্ষতিকর বিষয়ের সরাসরি ও প্রাথমিক শিকারে পরিণত হচ্ছেন নারীরা।
এই পরিপ্রেক্ষিতে তিনটি বিষয় দেখতে পাওয়া যায়—
প্রথমত, পরিবার পরিকল্পনা পদ্ধতি ও সেবা ব্যবহারকারীরা প্রধানত নারী। অনেক ক্ষেত্রেই নারীরা পরিবার ও নিজের সার্বিক মঙ্গল কামনা এবং অনাকাঙ্ক্ষিত গর্ভধারণ রোধে পরিবার পরিকল্পনা সেবা নিয়ে থাকেন। অনেক ক্ষেত্রেই সামাজিক বিধিনিষেধ, কুসংস্কার ও পরিবারের সদস্যদের অসচেতনতার কারণে নারীরা পরিবারের মূলত পুরুষ সদস্যদের না জানিয়ে পরিবার পরিকল্পনা পদ্ধতি ব্যবহার করতে বাধ্য হচ্ছেন। এটা পরবর্তীকালে জানাজানি হলে তাঁকে অনেক ক্ষেত্রে স্বামী বা শ্বশুরবাড়ির লোকজনের হাতে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের শিকার হতে হচ্ছে।
দ্বিতীয়ত, অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায়, পুরুষেরা কোনো প্রকার পদ্ধতি ব্যবহার করতে চান না। যাঁরা রাজি হচ্ছেন, তাঁরা নিজে ব্যবহার না করে তাঁর স্ত্রীর ওপরই চাপিয়ে দিচ্ছেন, এমনকি ওই পদ্ধতির পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া তাঁর স্ত্রীর জন্য শারীরিকভাবে ক্ষতিকর হলেও। অর্থাৎ শরীর ও মন নারীর হলেও সিদ্ধান্ত পুরুষের কাছেই রয়ে যাচ্ছে। আর পরিবার পরিকল্পনার দায়দায়িত্বও বাধ্য হয়ে নারীকেই নিতে হচ্ছে।
পরিবার পরিকল্পনা সেবা ও তথ্য পাওয়া এবং সংশ্লিষ্ট বিষয়ে পছন্দ ও সিদ্ধান্ত নিতে পারা প্রত্যেক মানুষের যৌন ও প্রজননস্বাস্থ্য অধিকার ও মৌলিক মানবাধিকার। কিন্তু আমাদের দেশের নারীরা এসব বিষয়ে নানা ধরনের বঞ্চনা ও নির্যাতনের শিকার। আমাদের সমাজে নারীরা তাঁদের মতামত ও পছন্দের কথা সাধারণত অকপটে বলতে পারেন না।
তৃতীয়ত, মাঠপর্যায়ের পরিবার পরিকল্পনা সেবাদানকারীরা অনেক ক্ষেত্রেই প্রয়োজনীয় তথ্য নিয়ে কেবল নারীদের কাছেই পৌঁছাতে পারেন। পেশাগত কারণে দিনের বেশির ভাগ সময় বাড়ির বাইরে থাকা, সামাজিকভাবে এ নিয়ে খোলাখুলি আলাপ না করতে পারাসহ নানা কারণে পরিবার পরিকল্পনার সুফল সম্পর্কে অনেক ক্ষেত্রেই পুরুষেরা যথাযথভাবে জানতে পারেন না। ফলে এ নিয়ে তাঁদের মধ্যে নানা আশঙ্কা ও ভয়ভীতি কাজ করে।
বর্ণিত কারণে, যদিও পুরুষ ও নারী উভয়ই সার্বিকভাবে পরিবারের মঙ্গল চাইছেন, যথাযথ তথ্য ও সচেতনতার অভাবে তাঁদের মধ্যে ভুল-বোঝাবুঝি রয়েই যাচ্ছে, যা রূপ নিচ্ছে সহিংসতায়। আবার কৈশোর ও যুবা বয়সে প্রজননস্বাস্থ্য সম্পর্কে সঠিক তথ্য জানতে না পারাও এ-সংক্রান্ত বিষয়ে ভুল ধারণা রয়ে যাওয়ার অন্যতম কারণ। এ বাস্তবতায় যদিও মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ের পাঠ্যবইয়ে প্রজননস্বাস্থ্য-সম্পর্কিত বিষয় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে, তবু অনেক ক্ষেত্রে সে বিষয়ে যথাযথভাবে পাঠদান সম্ভব হচ্ছে না।
এ বাস্তবতাকে সামনে রেখে ইউএসএআইডি সুখী জীবন প্রকল্প বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে।
এ প্রকল্প বাস্তবায়নে পাথফাইন্ডার ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ সরকার ও অন্যান্য সহযোগী সংস্থার সঙ্গে সম্মিলিতভাবে দেশের ৪টি বিভাগের ৩২টি জেলায় দেশের পরিবার পরিকল্পনা ও প্রজননস্বাস্থ্যসেবার মানোন্নয়ন এবং সবার জন্য সমতাভিত্তিক সেবা নিশ্চিত করতে কাজ করে যাচ্ছে। এ জন্য একদিকে যেমন সমাজে পুরুষসহ সবার মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টির জন্য উঠান বৈঠক, দম্পতি কাউন্সেলিং, গণপ্রচারণা, অবহিতকরণ সভা ইত্যাদির কার্যক্রম হাতে নেওয়া হয়েছে, তেমনি গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে জাতীয়, বিভাগীয়, জেলা ও প্রান্তিক পর্যায়ের সেবাদানকারীদের দক্ষতা বাড়ানোর ওপর। পরিবার পরিকল্পনা সেবাসহ প্রজননস্বাস্থ্য-সংক্রান্ত নানা বিষয়ে প্রশিক্ষণের পাশাপাশি এ প্রকল্পের আওতায় এ পর্যন্ত ৩ হাজার ৪৪৪ সেবাদানকারীকে লিঙ্গ ও লিঙ্গভিত্তিক সহিংসতা সম্পর্কে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে, যার মাধ্যমে ৮৩ মিলিয়ন মানুষ উপকৃত হবে বলে আশা করা হচ্ছে। এ ছাড়া সেবাদানকেন্দ্রগুলোকে লিঙ্গসংবেদনশীল সেবাকেন্দ্র হিসেবে তৈরি এবং লিঙ্গভিত্তিক সহিংসতা প্রতিরোধে সেবাকর্মীদের সক্রিয় ভূমিকা নিশ্চিত করতে ২০১৮ সাল থেকে কাজ করছে সুখী জীবন প্রকল্প।
‘নারী নির্যাতন বন্ধ করি, কমলা রঙের বিশ্ব গড়ি’ প্রতিপাদ্য নিয়ে এবারের লিঙ্গভিত্তিক সহিংসতা প্রতিরোধ পক্ষ উদ্যাপনে পাথফাইন্ডার ইন্টারন্যাশনাল ও ইউএসএআইডি সুখী জীবন প্রকল্প সবার সচেতন অংশগ্রহণ ও লিঙ্গভিত্তিক সহিংসতা রোধে দায়িত্বশীল আচরণ কামনা করে। আমরা বিশ্বাস করি, নারীর যথাযথ ক্ষমতায়নের মাধ্যমেই নারী নির্যাতন বন্ধ করা সম্ভব। কাউকে পেছনে ফেলে নয়, কারও ক্ষতি করে নয়, বরং সবাই মিলে একসঙ্গে এগিয়ে যেতে পারলেই সম্ভব সমাজের কাঙ্ক্ষিত পরিবর্তন।
শামীমা পারভীন জেন্ডার ম্যানেজার, ইউএসএআইডি সুখী জীবন প্রকল্প, পাথফাইন্ডার ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ।
মনিরা হোসেন প্রজেক্ট ম্যানেজার, সিএসআরএইচআর প্রকল্প, পাথফাইন্ডার ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ।