আজ আন্তর্জাতিক নারী দিবস। এক শতাব্দীর বেশি সময় ধরে (১১২ বছর) বিশ্বব্যাপী মানুষ ৮ মার্চকে নারীদের জন্য বিশেষ দিবস হিসেবে পালন করে আসছে। জাতিসংঘের উদ্যোগে পালিত হচ্ছে ১৯৭৫ সাল থেকে। বর্তমানে নারী দিবস পালনের পরিসর বেশ বাড়লেও অনেকের কাছে এর ইতিহাস নিয়ে ধারণা নেই।
১৯০৭ সালে স্টুটগার্টের শ্রমজীবী সমাজতন্ত্রী নারীদের সম্মেলনে বিদগ্ধ জার্মান সমাজতন্ত্রী নেত্রী ক্লারা জেটকিনকে (১৮৫৭-১৯৩৩) আন্তর্জাতিক সম্পাদিকা করে সাম্রাজ্যবাদবিরোধী আন্তর্জাতিক প্রগতিশীল নারীদের একটি ফ্রন্ট গঠিত হয়। ১৯১০ সালে কোপেনহেগেনে হয়েছিল এই ফ্রন্টের দ্বিতীয় সম্মেলন। সেখানেই বিশ্বের নারীদের একটি বিশেষ দিন হিসেবে ৮ মার্চকে ‘আন্তর্জাতিক নারী দিবস’ হিসেবে ঘোষণা করা হয়। এই দিনের একটি ইতিহাস আছে। ১৯০৮ সালের ৮ মার্চ নিউইয়র্কে শ্রমজীবী নারীরা আট ঘণ্টা কাজের সময় নির্ধারণ ও সমকাজে সমমজুরির দাবিতে আন্দোলন করেন। এই রক্তক্ষয়ী সংগ্রামে বেশ কিছু নারী নিহত হন। সেই আত্মত্যাগের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতেই নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠার দিন হিসেবে বিশ্বজুড়ে এ দিবস পালিত হয়ে আসছে আজও।
সাবেক সমাজতান্ত্রিক দেশগুলোয় ৮ মার্চ ছুটির দিন হিসেবে স্বীকৃত। ১৯৮৪ সালে জাতিসংঘের স্বীকৃতির পর বাংলাদেশেও রাষ্ট্রীয়ভাবে ৮ মার্চ পালিত হচ্ছে। জাতিসংঘের নারীর মর্যাদা কমিশনের আন্তর্জাতিক সভাও ৮ মার্চ অনুষ্ঠিত হয়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতীয় নারী উন্নয়ননীতি ঘোষণা করেছেন ১৯৯৭ সালের ৮ মার্চ। জাতীয় নারীর উন্নয়ন পরিষদ লক্ষ রাখছে নারীর সম–অধিকার বাস্তবায়নের বিষয়ে। নারীর ক্ষমতায়নের লক্ষ্যে জাতীয় কর্মপরিকল্পনা করা হয়েছে। কিন্তু নারীর মর্যাদা হানিকর বহু অমানবিক ভিত্তি রয়ে গেছে যেসব আইনে, সেসব সংশোধন করার বিষয়ে কোনো উদ্যোগ বাস্তবায়িত হচ্ছে না।
নারীর অধিকার রক্ষায় ইতিবাচক অবদান রাখার ক্ষেত্রে আইনের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। আইন সব সময় যুগোপযোগী করতে ব্যবস্থা রাখতে হয়। বেইজিং চতুর্থ নারী সম্মেলনের নীতিমালায় (১৯৯৫ সালে অনুষ্ঠিত), সিডও সনদ এবং তিউনিসিয়াসহ অন্য কয়েকটি মুসলিম দেশে নারীর অধিকার রক্ষায় বৈপ্লবিক পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। অথচ দেশের প্রচলিত আইনে নারীর অধিকার এখনো বৈষম্য ও বঞ্চনাকেই প্রতিফলিত করছে।
নারীমুক্তির সঙ্গে জড়িত আছে অনেকগুলো বিষয়—নারীর মর্যাদা তথা সমাজে ও পরিবারে নারীর স্থান, শিশুর রক্ষণাবেক্ষণ, সব ধরনের নির্যাতন, অত্যাচার ও বৈষম্যের কবল থেকে নারীসমাজকে মুক্ত করার পথ বের করা এবং চলতি সামাজিক অবস্থা পরিবর্তনের জন্য নারীসমাজের প্রচেষ্টা কী হবে, সেটা চিহ্নিত করা।
নারী জাগরণের সূচনা পর্বের ধারাবাহিক ইতিহাস থেকে জানা যায়, নারীর স্বার্থে সামাজিক, পারিবারিক, আইনগত সংস্কার ও রাজনৈতিক অধিকারের সন্ধানেই সূচিত হয়েছিল নারী আন্দোলনের প্রেক্ষাপট। ইউরোপজুড়ে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের (১৯১৪-১৮) দামামা বাজা শুরু হয়েছিল উনিশ শতকের শেষ দশক থেকে। সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধের ভয়াবহ চাপে নারীসমাজের পারিবারিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক জীবন বিপর্যস্ত হয়ে উঠেছিল। সেই অবস্থার মুখোমুখি হয়ে নারীসমাজের অবস্থা কী দাঁড়াল, তা প্রত্যক্ষ করে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন, ‘তাদের মুখের ওপর থেকেই যে কেবল ঘোমটা খসল তা নয়, যে ঘোমটার আচরণে তারা অধিকাংশ জগতের আড়ালে পড়ে গিয়েছিল, সেই মনের ঘোমটাও তাদের খসছে। যে মানব সমাজে তারা জন্মেছে, সেই সমাজ আজ সকল দিকেই সকল বিভাগেই সুস্পষ্ট হয়ে উঠল তাদের দৃষ্টির সম্মুখে। এখন অন্ধ সংস্কারের কারখানায় গড়া পুতুলগুলো নিয়ে খেলা করা আর তাদের সাজবে না। তাদের স্বাভাবিক বুদ্ধি কেবল ঘরের লোককে নয়, সকল লোককে রক্ষার জন্য কায়মনে প্রবৃত্ত হবে।’ (কালান্তর: নারী)
নারীমুক্তির সঙ্গে জড়িত আছে অনেকগুলো বিষয়—নারীর মর্যাদা তথা সমাজে ও পরিবারে নারীর স্থান, শিশুর রক্ষণাবেক্ষণ, সব ধরনের নির্যাতন, অত্যাচার ও বৈষম্যের কবল থেকে নারীসমাজকে মুক্ত করার পথ বের করা এবং চলতি সামাজিক অবস্থা পরিবর্তনের জন্য নারীসমাজের প্রচেষ্টা কী হবে, সেটা চিহ্নিত করা।
নারীমুক্তির প্রশ্নটি শ্রেণি–সম্পর্কিত প্রশ্ন। নারী শোষণের সূত্রপাত যে সমাজকাঠামোয়, তার অবলুপ্তি ছাড়া এর পাকাপাকি সমাধান নেই, হতে পারে না। এখানেই রয়েছে নারী আন্দোলন ও শ্রেণিসংগ্রামের যোগসূত্র। সামাজিক যে স্তরেই নারী বাস করুক না কেন, যে শ্রেণিরই সে অংশ হোক না কেন, তাকে বহু সমস্যায় ভুগতে হয়, যা পুরুষকে স্পর্শও করে না। আর্থসামাজিক ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে মূলধারায় নারীর চাহিদা ও সমস্যা সমাধানের বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত না হলে একপেশে পুরুষকেন্দ্রিক উন্নয়ন ও বিকাশ ঘটবে। নির্যাতন ও বৈষম্যের শিকার হবে নারী। কিন্তু তার মানে এই নয় যে নারীর এই বিশেষ সমস্যার জন্য পুরুষ দায়ী। নারীর সব বৈষম্য, শোষণ ও নির্যাতনের মূল কারণ রাষ্ট্রের সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক কাঠামো।
অন্যদিকে নারীর সব সমস্যা সমাজে পুরুষের প্রাধান্যের জন্যই সৃষ্ট বলে প্রচারের লক্ষ্যে নারী আন্দোলনের একটি ধারা সৃষ্টি হয়েছে, যে ধারায় নারী আন্দোলন ও শ্রেণিসংগ্রামের যোগসূত্রটি নাকচ করে বলা হয়, পুঁজিশাসিত সমাজ ও অর্থনীতি নয়, পুরুষশাসিত সমাজব্যবস্থা বদল করতে পারলে, পুরুষের দৃষ্টিভঙ্গি বদলাতে পারলে এবং জীবনের সব ক্ষেত্রে নারীর জন্য পুরুষের সমান অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে পারলে নির্যাতন, শোষণ ও বঞ্চনার হাত থেকে মুক্তি পাবে নারী। এই দুই ধারার নারী আন্দোলনে বহুবিধ কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়। কর্মসূচিতে ভিন্নতাও থাকে। যে যেমন জীবন থেকে আসে ও নিজস্ব গণ্ডিতে যেমন অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করে বা যা দেখে, তারই ভিত্তিতে দাবি তোলে। ফলে লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যের সুস্পষ্টতার জন্য কোনোটা হয় সঠিক, আবার তারই অভাবে কোনোটা হয় অসাড়।
নারী-পুরুষের সম্মিলিত অংশগ্রহণে জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে এবারের ৮ মার্চ এগিয়ে যাক সম–অধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে।
● মালেকা বেগম নারী আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত। সেন্ট্রাল উইমেন্স ইউনিভার্সিটির সোশিওলজি অ্যান্ড জেন্ডার স্টাডিজ বিভাগের চেয়ারপারসন