নারী শ্রমিকের লাশ ও মন্ত্রীর বাণী
পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন সৌদি আরব থেকে নারী কর্মীদের মৃতদেহ ফেরত আসা প্রসঙ্গে মন্তব্য করেছেন, ‘সৌদি আরবে কর্মরত ২ লাখ ২০ হাজার নারীর মধ্যে ৫৩ নারীর মরদেহ ফিরেছে, যা খুবই নগণ্য। সেখান থেকে নির্যাতনের শিকার হয়ে ফিরে আসা নারীর সংখ্যা মাত্র ৮ হাজার, সংখ্যার দিক থেকে যা খুবই ছোট। তাঁরা দূতাবাসের শেল্টারহোমে অভিযোগ না করে দেশে এসে অত্যাচারের কথা বলেন।’ মাননীয় মন্ত্রী, সংখ্যাটা আর কত বড় হলে আপনার কাছে গুরুত্ব পাবে? যেখানে নারীদের আটকে রাখা, বাইরে বের হতে না দেওয়া, এমনকি মোবাইল ব্যবহারেরও অনুমতি নেই সব ক্ষেত্রে, কীভাবে তাঁরা এসে শেল্টার হোমে অভিযোগ করবেন? একবারও কেন নিজেদের দায়িত্বহীনতার জন্য দুঃখ প্রকাশ করলেন না? লুকিয়ে, চোখের আড়ালে নিপীড়িতদের গ্রামের বাড়ি পাঠিয়ে দিলেই কি তার নিপীড়নের ক্ষত মুছে যায়? এমনকি সংখ্যায় যদি একজনও হয়, তার দায় আপনারা এড়াতে পারেন? কিংবা পারবেন?
বিদেশে কর্মরত অবস্থায় গত সাত বছরে যেসব শ্রমিক মারা গেছেন, তাঁদের ৭৫ শতাংশের পরিবারই কোনো ক্ষতিপূরণ পায়নি। মন্ত্রী সেসব নিয়ে বললেন না, বললেন দায় এড়ানো কথা।
‘ওরা আমারে মাইরা ফালাইব, আমারে দেশে ফিরাইয়া নিয়া যান। আমি আমার সন্তান ও পরিবারের কাছে ফিরতে চাই। আমাকে আমার পরিবারের কাছে নিয়ে যান। আর কিছুদিন থাকলে আমি মরে যাব।’ কিছুদিন আগে জীবন বাঁচানোর আকুতি জানিয়ে একটি ভিডিও পোস্ট করেছিলেন সুমী। সেই ভিডিও ভাইরাল হয়েছিল এবং অনেকেই সুমীর বর্তমান অবস্থা নিয়ে শঙ্কিত ছিলেন। সেই সুমী আক্তার সৌদি আরব থেকে অবশেষে ঢাকায় ফিরেছেন এবং তাঁকে অনেকটা গোপনেই বিমানবন্দর থেকে গ্রামের বাড়িতে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে।
সে সময়ই মন্ত্রীর মুখ থেকে উচ্চারিত হলো এমন নিষ্ঠুর বাণী!
শুধু সুমীই নন, আরও আছেন। ডালিয়াসহ অনেকেই সেখানে প্রায় নিয়মিতই শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের শিকার হতেন। অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে ডালিয়া একদিন ওই বাসার দ্বিতীয় তলা থেকে লাফিয়ে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেন। চেষ্টা সফল হয়নি, উল্টো হাত-পা ভেঙে দুই মাস ভর্তি ছিলেন রিয়াদের এক হাসপাতালে। এরপর তাঁর ঠাঁই হয় বাংলাদেশ দূতাবাসের সেফহোমে। সেখান ছিলেন প্রায় চার মাস। এর আগে এসব মানসিক ও শারীরিক অত্যাচারে মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেছিলেন রূপালী। এভাবে দুঃসহ স্মৃতি নিয়ে অনেকে ফিরছেন দেশে; অনেকে তা-ও পারছেন না।
সৌদি আরবে সুমি, ডালিয়া আর রূপালীর মতো আরও অনেকেই আছেন। তবে কতজন এই দুরবস্থায় আছেন, সে তথ্য কারও কাছে নেই। যতক্ষণ না মারা যাচ্ছেন, ততক্ষণ পর্যন্ত আমাদের দূতাবাসের বা সরকারেরও কোনো দায় নেই, বিষয়টি এখন এ পর্যায়ে এসে ঠেকেছে। এখন পর্যন্ত ১৩ হাজার নারী ৪ বছরে ফিরে এসেছেন। আরও কতজন আরও বিপদে আছেন, আমরা এখনো জানি না। এমনকি দেশে ফিরে না আসা পর্যন্ত খুব কম ঘটনাই প্রকাশিত হচ্ছে। আরও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, গত ৪ বছরে ১৫২ জন নারী মারা গেছেন, যাঁদের ৬৬ জন আত্মহত্যা করেছেন। শুধু এই বছরই ৫৩ জন নারীর লাশ বাংলা মা তার বুকে ধারণ করেছে।
নানা ধরনের শারীরিক, মানসিক নিপীড়নের কারণে কাজের নিরাপদ পরিবেশ না থাকায় সৌদি আরব থেকে প্রায় প্রতি মাসেই নারী গৃহকর্মীরা ফিরে আসতে বাধ্য হচ্ছেন। ব্র্যাক অভিবাসন কর্মসূচির তথ্য অনুযায়ী, গত ৮ মাসে সৌদি আরব থেকে দেশে ফিরেছেন প্রায় ৮০০ নারী কর্মী। গত বছর তাঁদের সংখ্যা ছিল ১ হাজার ৩৫৩ জন। তবে এগুলো কেবলই যাঁদের কেস, তাদের কাছে নথিভুক্ত আছে তাঁদের তথ্য। যাঁরা বিমানবন্দর থেকে সরাসরি বাড়ি চলে গেছেন তাঁদের কোনো তথ্যই নেই।
যাঁরা ফিরে এসেছেন তাঁরা প্রায় সবাই শারীরিক বা মানসিক নির্যাতনের শিকার হওয়ার কথা জানিয়েছেন গণমাধ্যমে। তাঁদের অনেককেই গৃহকর্মী হিসেবে নিয়োগের কথা থাকলেও নিয়ে গিয়ে যৌনকাজে ব্যবহার করা হচ্ছে। নারীরা কী কী ধরনের কাজ করছেন, এই বিষয়ে বাংলাদেশ সরকারের কোনো নজরদারি নেই সেখানে। যাঁরা নির্যাতিত হয়ে ফিরে আসছেন, তাঁরা শুধু যে ভুক্তভোগী তা নয়, তারা গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষীও। কিন্তু তার পরও তাঁরা কোনো বিচার পাচ্ছেন না। উল্টো অনেকের পরিবার তাঁদের মেনে নিচ্ছে না, তাই ফিরে যেতে পারছেন না পরিবারের কাছে। তাঁরা দেশে ফিরেও কঠিন জীবন যাপন করছেন।
অথচ এই নির্যাতনের অভিযোগে ইন্দোনেশিয়া ও ফিলিপাইন গৃহকর্মী পাঠানো বন্ধ করে দিয়েছিল। এরপর ২০১৫ সালে বাংলাদেশের সঙ্গে চুক্তি করে সৌদি আরব। সেখানে গেছেন ৩ লাখ নারী।
সরকার তাহলে কী করছে? শুধু লাশ গ্রহণ বা ফিরে আসা মেয়েদের চুপিসারে লুকিয়ে দেশের বাড়ি পাঠানোই কি সরকারের একমাত্র কাজ? গত বছর থেকে যখন নারীরা ফিরে এসে তাঁদের অভিজ্ঞতা বলতে থাকেন, তখন সেসময়ের প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের সচিব ড. নমিতা হালদার বলছেন, ‘যাঁরা দেশে ফিরছেন, তাঁদের অধিকাংশই নির্যাতনের শিকার হয়ে দেশে ফিরছেন না। বরং দেশে ফিরে নির্যাতনের গল্প বানাচ্ছেন।’ এই হচ্ছে মন্ত্রী ও সচিবের বক্তব্য, আর এই হচ্ছে প্রবাসী শ্রমিকের ভাগ্য? এমনটাই কি আমাদের প্রাপ্য?
জোবাইদা নাসরীন: শিক্ষক, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
[email protected]