সবশেষ তালেবান শাসনে আফগানিস্তানে এখন গানবাজনা নিষিদ্ধ। খুঁজেপেতে পাওয়া গেল ১৩ বছর আগে এক লোককবি ও পথশিল্পীর গাওয়া গানটি। কাবুলের উপকণ্ঠেই এটি ধারণ করা হয়। আফগান ইতিহাস আর জন-আকাঙ্ক্ষার চিত্রটি অসাধারণভাবে তুলে ধরা হয়েছে এতে। পশতুন, ইংরেজি হয়ে দুর্বল বাংলা অনুবাদে হয়তো আসল স্বাদ পাওয়া যাবে না, তবে মর্মার্থটুকু হয়তো বোঝা যাবে।
শিল্পী বলছেন, ‘চমৎকার এক আবহাওয়ার দেশ আমাদের/ অপূর্ব ভূমি ও মাঠ/ বহু নায়ক ও সাহসী মানুষের জন্মভূমি/ আফগান জনগণ বয়ে বেড়ায় মহান রক্তের ধারা/ এই দেশের রুক্ষ ভূমিতে রয়েছে বহু খনিজ/ রয়েছে খরস্রোতা নদীর ফল্গুধারা এবং সমতল মরুভূমি/ আছে সড়ক ও বিমানবন্দর/ দেশটি কৌশলগত ভালো অবস্থানে/ রয়েছে উঁচু পাহাড়/ এবং পানি ও বিদ্যুতের নানা উৎস/ বারবার লোভী দেশগুলোর চোখ পড়েছে আমাদের দেশটির ওপর/ বারবার তারা হাত বাড়িয়েছে আমাদের দেশটির দিকে/ ঔপনিবেশিকদের অত্যাচারে, দাসত্বে, রাজনীতিতে আমরা ক্লান্ত/ সেই আলেকজান্দ্রা থেকে রাশিয়ান, ব্রিটিশ, চেঙ্গিস খান হয়ে এখন হাত বাড়িয়েছে পাকিস্তান/ সঙ্গে রয়েছে আরব আর চেচেনরা/ যদি তোমরা কিছু মনে না করো/ আমি একটি প্রশ্ন রেখে যেতে চাই/ তোমরা আমাদের কী দিয়েছ?/ তোমরা তো গিয়েছ মহাশূন্যে, গড়ে তুলেছ কম্পিউটার/ তোমরা যদি আমাদের কিছু দিয়ে থাকো, বলো, বিনিময়ে আমরাও তোমাদের দেব/ যদি কিছুই না দাও আমাদের, তোমাদের এখানে কাজ কী?/ আমরা একটি দেশ/ যারা প্রযুক্তিতে পিছিয়ে/ উন্নত দেশগুলো হয় আমাদের হাত ধরে অথবা কেটে দেয়/ বারবার বিদেশি আক্রমণ আমাদের পিছিয়ে দেয়/ আমাদের কাজ থেকে বিরত রাখে/ এটাই সারা পৃথিবীর সিদ্ধান্ত/ গরিবদের কথা কেউ শোনে না/ যারা আমাদের বারবার আঘাত করে, তাদেরই ব্যবস্থা নিতে হবে/ আমরা আর ভুগতে চাই না/ আমরা আর যুদ্ধবাজদের নির্মমতার শিকার হতে চাই না/ তোমরা তোমাদের নিজ দেশে চলে যাও/ আমাদের ফলে ভাগ বসাতে এসো না।’
এই সূত্র ধরে আরেকটি সত্য উচ্চারণ করছেন সীমান্ত গান্ধী। বাংলাদেশে একটু বয়সী মানুষ যাঁরা, তাঁরা সবাই তাঁর নাম জানবেন। তাঁর অহিংস, উদারনীতির কারণে তাঁকে অনেকে ‘সীমান্ত গান্ধী’ নামেও জানতেন, কেউ বলতেন বাচ্চা খান, কেউ বলতেন বাদশাহ খান। তিনি একটা সময় পাকিস্তানের রাজনীতির অপরিহার্য মানুষ ছিলেন। পশতুন এই নেতার জন্মস্থান আফগানিস্তানে। খান আবদুল গাফফার খান সারা জীবন পাকিস্তানে রাজনীতি করলেও ১৯৮৮ সালে মারা যাওয়ার আগে বলেছিলেন তাঁকে যেন জন্মভূমিতেই দাফন করা হয়। আফগানিস্তানের জালালাবাদে তাঁর কবরস্থান ঘিরে গড়ে তোলা স্মৃতিসৌধ এখন দর্শনীয় স্থান। এই স্মৃতিসৌধের গায়ে লেখা তাঁর বিখ্যাত উক্তি: ভুলে যাও উজবেক, তাজিক, হাজারা বা পশতুন পরিচয়...যদি নিজেদের আফগান ভাবতে না পারো, তাহলে আফগানিস্তান টিকবে না।
২.
আফগানিস্তানের হালফিল অবস্থা দেখে সীমান্ত গান্ধীর কথাই মনে পড়ছে। উজবেক, তাজিক, হাজারা ও পশতুন তো ছিল বা আছেই; এখন তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে কখনো মুজাহিদিন, কখনো তালেবান পরিচয়। এ সবই আবার খণ্ডবিখণ্ড—কখনো আল-কায়েদা, কখনো আইসিস, কখনো আইএস-কে, কখনো নর্দার্ন অ্যালায়েন্স, কখনো প্রতিরোধযোদ্ধা, নানা পরিচয়ে। সব মিলিয়ে কখনোই আফগানরা সবাই মিলে আফগান হতে পারছে না।
বেশি পুরোনো ইতিহাসে না যাই, সবশেষ বিজয়ের পর কাবুল ও কান্দাহারে যখন তালেবানদের বিজয়োল্লাস চলছে, তখন কাবুলেই নিজেদের শক্তির জানান দিল অপেক্ষাকৃত নতুন সংগঠন ‘ইসলামিক স্টেট-খোরাসান’, সংক্ষেপে আইএস-কে। সংবাদমাধ্যমগুলো বলছে, আদতে এরা পশ্চিম এশিয়ার জঙ্গি সংগঠন আইএসের আফগান শাখা। বর্তমান পাকিস্তান, আফগানিস্তান, ইরান, তাজিকিস্তান, তুর্কমিনিস্তান ও উজবেকিস্তানের একাংশ নিয়ে ছিল প্রাচীন খোরাসান অঞ্চল। আইএসের আফগান শাখাও এই অঞ্চলকে তাদের নামে জুড়ে নিয়েছে। প্রায় দুই দশক আগে আইএসের প্রতিষ্ঠা করেন আল-কায়েদার ইরাকি শাখার প্রধান আবুমুসাব আল জারকোয়াই। সে সময় সংগঠনের নাম ছিল ইসলামিক স্টেট অব ইরাক অ্যান্ড লেভান্ত (আইএসআইএল)।
তুরস্ক, সিরিয়া, জর্ডান, লেবানন, সাইপ্রাস, প্যালেস্টাইন এবং ইজরায়েলের একাংশ নিয়ে গঠিত ছিল প্রাচীন লেভান্ত ভূখণ্ড। পরে সাময়িকভাবে সংগঠনের নাম হয় ইসলামিক স্টেট অব ইরাক অ্যান্ড সিরিয়া (আইএসআইএস)। আইএস-কের লক্ষ্য খিলাফত (খলিফার শাসন) পুনঃপ্রতিষ্ঠা। আফগানিস্তানের নানগরহর, নুরিস্তান, কুনার প্রদেশ আইএস-কের ঘাঁটি। জালালাবাদসহ নানগরহরের বেশ কিছু এলাকাতেই শিবির রয়েছে তাদের। একসময় পশতুন ‘ওয়ারলর্ড’ গুলবুদ্দিন হেকমতিয়ারের নিয়ন্ত্রণে ছিল নানগরহর। পরে তালেবানের দখলে যায়। এখানে সক্রিয় আইএস-কে গোষ্ঠীতে পশতুনের পাশাপাশি আরব, পাকিস্তান, উইঘুর ও মধ্য এশিয়ার জঙ্গিরাও রয়েছে।
২০১৪ সালে পাকিস্তান-তালেবান নেতা হাফিজ সইদ খান আইএস-কে গঠন করেন। তৎকালীন আইএস প্রধান আবু বকর আল বাগদাদির অনুগামী হাফিজ ২০১৬ সালে আমেরিকার বিমান হামলায় নিহত হন। বাগদাদির মৃত্যু হয় ২০১৯-এ, সিরিয়ায়। ২০১৫ সালে আফগানিস্তানে আইএস-কের প্রায় তিন হাজার জঙ্গি ছিল। তাদের বড় অংশই সাবেক তালেবান। ওসামা বিন লাদেনের জমানায় আল-কায়েদার সঙ্গে সখ্য ছিল আইএসের। পরবর্তী আল-কায়েদা প্রধান আয়মান আল জাওয়াহিরির সময় দুই সংগঠনের সম্পর্কে ফাটল ধরে। আল-কায়েদাঘনিষ্ঠ তালেবানেরও বিরোধিতা শুরু করে আইএস।
১০০ বছর আগে ব্রিটিশদের হাত থেকে সম্পূর্ণ স্বাধীন হয়ে এখন পর্যন্ত অন্তত ১৮ বার বদলেছে আফগানিস্তানের পতাকা। এবার আবারও কাবুলের নিজেদের পতাকা তুলেছে তালেবান। বারবার পতাকা বদল হয়েছে, কিন্তু আফগানিস্তানকে নিয়ে সবাই যেমন আফগান হয়ে উঠতে পারেনি, তেমনি সাধারণ আফগানদের ভাগ্য বদল হয়নি।
তালেবান ও আইএস দুটি সংগঠনই সুন্নি মতাবলম্বী। তালেবান দেওবন্দি মতাদর্শের অনুসারী। আইএস অনুসরণ করে সালাফি মতবাদকে, সুফি মতবাদের কট্টর বিরোধী তারা। এই সংক্ষিপ্ত ইতিহাসটুকু ধার করে জানালাম এ জন্য যে আফগানিস্তান আসলে আফগানদের হতে কত দেরি, বিষয়টি বোঝানোর জন্য। এবারের তালেবানরা যদিও নানা প্রতিশ্রুতি দিচ্ছে, কিন্তু গুয়ানতামো বা পাকিস্তানের জেলফেরত, যাদের চেহারা আবার কাবুলে দেখা যাচ্ছে, তাতে আশাবাদী হওয়ার কোনো কারণ দেখছি না।
ইতিহাস সাক্ষী দিচ্ছে: ১০০ বছর আগে ব্রিটিশদের হাত থেকে সম্পূর্ণ স্বাধীন হয়ে এখন পর্যন্ত অন্তত ১৮ বার বদলেছে আফগানিস্তানের পতাকা। এবার আবারও কাবুলের নিজেদের পতাকা তুলেছে তালেবান। বারবার পতাকা বদল হয়েছে, কিন্তু আফগানিস্তানকে নিয়ে সবাই যেমন আফগান হয়ে উঠতে পারেনি, তেমনি সাধারণ আফগানদের ভাগ্য বদল হয়নি।
৩.
বিশেষজ্ঞ সংবাদমাধ্যমগুলোর তথ্য: কয়েক ট্রিলিয়ন ডলার সম্পদের ওপর বসে থেকেও বর্তমানে আফগানিস্তানের অর্ধেকের বেশি মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করছে। প্রায় ৬ লাখ ৫২ হাজার বর্গকিলোমিটারের আফগানিস্তানকে বিশ্বের অন্যতম শীর্ষ খনিজসমৃদ্ধ দেশ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। দেশটিতে ১ হাজার ৪০০-এর বেশি বিভিন্ন খনিজ ক্ষেত্র রয়েছে। খনিজ ক্ষেত্রগুলোর আনুমানিক মূল্য ১ থেকে ৩ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার, মতান্তরে সেটা ৭ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার পর্যন্ত হতে পারে। সোনা, রুপা, প্লাটিনাম, ইউরেনিয়াম, অ্যালুমিনিয়াম, তামা, লোহা, ক্রোমাইট, লিথিয়াম ছাড়াও রয়েছে উচ্চমানের পান্না, রুবি, নীলকান্তমণি, ফিরোজা ইত্যাদি রত্নপাথরের মজুতও। যুক্তরাষ্ট্রের ভূতাত্ত্বিক জরিপের (ইউএসজিএস) গবেষণা অনুযায়ী, আফগানিস্তানে ৬০ মিলিয়ন মেট্রিক টন তামা, ২ দশমিক ২ বিলিয়ন টন লোহা, ১ দশমিক ৪ মিলিয়ন টন দুর্লভ বস্তু রয়েছে। আর রয়েছে সোনা, রুপা, দস্তা, পারদ ও লিথিয়াম। দেশটিতে এত বেশি পরিমাণে লিথিয়াম আছে যে দেশটি বিশ্বের লিথিয়ামের রাজধানী হয়ে উঠতে পারে।
দুর্লভ বস্তু বা রেয়ার আর্থ ইলিমেন্ট (আরইই) হচ্ছে বর্তমান প্রযুক্তিনির্ভর পৃথিবীর সবচেয়ে আকর্ষণীয় বস্তু। মুঠোফোন বা ল্যাপটপ থেকে শুরু করে মহাকাশে পাঠানো স্যাটেলাইট, এমনকি হাইপারসনিক অস্ত্র তৈরি ইত্যাদি অনেক ক্ষেত্রে আরইই ব্যবহার করা হয়। হাই-টেক শিল্পের উন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গে আরইইয়ের প্রয়োজনীয়তাও বাড়ছে। মার্কিন ভূতাত্ত্বিক জরিপ (ইউএসজিএস) ও আফগানিস্তান ভূতাত্ত্বিক জরিপের (এজিএস) একটি যৌথ গবেষণা থেকে বেরিয়ে এসেছে, শুধু দেশটির উত্তরাঞ্চলেই বিভিন্ন তেল ও গ্যাসক্ষেত্রে আনুমানিক ১ দশমিক ৬ বিলিয়ন ব্যারেল অপরিশোধিত তেল, ১৬ ট্রিলিয়ন ঘনফুট প্রাকৃতিক গ্যাস এবং ৫০০ মিলিয়ন তরল প্রাকৃতিক গ্যাসের মজুত রয়েছে। আফগানিস্তানে খনন করা প্রায় ৯৫ শতাংশ রত্নপাথর অবৈধভাবে উত্তোলিত হয় এবং তা বিক্রির জন্য অবৈধভাবে পাকিস্তানে চালান করা হয়। এরপর অবৈধভাবে পাকিস্তানের মাধ্যমে এসব রত্নপাথর বিশ্বে রপ্তানি করা হয়।
মূল্যবান রত্নপাথরের পাশাপাশি আফগানিস্তানে সোনারও যথেষ্ট মজুত রয়েছে। শতাব্দীকাল ধরে আফগানিস্তানের গজনি, কাবুল, কান্দাহার, তাখার প্রদেশসহ দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল থেকে সোনা উত্তোলন করা হচ্ছে। তালেবান ও আইসিস আফগানিস্তানের খনিজ সম্পদ থেকে ব্যাপকভাবে লাভবান হচ্ছে। এক তথ্য অনুযায়ী, শুধু তালেবানরাই বছরে আড়াই থেকে ১০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার মূল্যের খনিজ সম্পদ উত্তোলন করে, যা আফিমের পর তাদের আয়ের দ্বিতীয় বৃহত্তম উৎস।
একজন মার্কিন বিশেষজ্ঞের মতে, আফগানিস্তানে শাসকদের যদি রাজনৈতিক সদিচ্ছা থাকে, দেশটিতে যদি টানা অন্তত ১৬ বছর স্থিতিশীল পরিবেশ থাকে, যদি আধুনিক বিজ্ঞান বিশেষজ্ঞরা দায়িত্ব পান, যদি পর্যাপ্ত বিদেশি বিনিয়োগ মেলে, তাহলে নিজস্ব সম্পদেই আফগানিস্তান একটি স্বনির্ভর দেশ হতে পারবে। কিন্তু এই এতগুলো ‘যদি’ সহজ সমীকরণ নয়। আর শুধু আফগান দুর্নীতিবাজরা নয়, পাকিস্তানের দুর্নীতিবাজ সামরিক-বেসামরিক প্রশাসন এই ‘যদি’গুলোর সামনে প্রধান বাধা হয়ে থাকবে।
৪.
নিজেরা এত সম্পদশালী হয়েও আফগানরা কখনোই আফগান হতে পারেনি। তাজিক, উজবেক, হাজারা, পশতুন তো ছিলই; রুশদের হটাতে তারা হয়েছে মুজাহিদিন; মুজাহিদিনের বিরুদ্ধে লড়তে হয়েছে তালেবান, এখন তালেবানদের বিরুদ্ধে লড়ছে আইএস-কে, প্রতিরোধযোদ্ধা বা নর্দার্ন অ্যালায়েন্স। এর পেছনে বড় শক্তিগুলোর কলকাঠি তো ছিলই। রাশিয়ানদের তাড়াতে মুজাহিদদের সহায়তা দিয়েছে আমেরিকা; সৌদি আরবের সহায়তায় সেই মুজাহিদ তালেবান হয়ে তাড়াল আমেরিকাকে। দূর নেপথ্যে চীন থাকলেও নিকট প্রতিবেশী পাকিস্তান খেলেছে সব খেলা। তালেবানদের ‘গডফাদার’খ্যাত আইএসআই প্রধান জেনারেল হামিদ গুল ভারতবিরোধী জুজু দেখিয়ে পাকিস্তান সেনাবাহিনী, সিভিল প্রশাসন এবং তালেবান ও পাকিস্তানের হোম গ্রোন জঙ্গিদের একাকার করে ফেলেছে। এই হামিদ গুলকে যখন জাতিসংঘ সন্ত্রাসী তালিকাভুক্ত করার উদ্যোগ নিয়েছিল, তখন সেখানে বাদ সেধেছে চীন।
আবার অন্যদিকে তালেবানবিরোধী লড়াইয়ে পাকিস্তান যে আমেরিকার ভাড়াখাটা দেশ ছিল, তার প্রমাণ মিলবে পারভেজ মোশাররফের আত্মজীবনীতে। সবশেষ প্রমাণ, তালেবানের শীর্ষ নেতাদের জন্ম পাকিস্তানে বলে দাবি করেছেন দেশটির স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী শেখ রশিদ। পাকিস্তানেই তালেবান নেতারা প্রশিক্ষণ নিয়েছেন বলে দাবি করেছেন তিনি। পাকিস্তানের হাম নিউজকে দেওয়া ওই সাক্ষাৎকারে ইমরান খান সরকারের এই মন্ত্রী বলেন, ‘আমরা তালেবান নেতাদের অভিভাবকের মতো। দীর্ঘদিন ধরে আমরা তাঁদের খেয়াল রাখছি। পাকিস্তানে তাঁরা আশ্রয় ও শিক্ষাদীক্ষার সুযোগ পেয়েছেন; আমরা তাঁদের জন্য সবকিছুই করেছি।’ তালেবানের সব প্রথম সারির নেতার জন্ম ও বেড়ে ওঠা পাকিস্তানে। তাঁরা পাকিস্তানে প্রশিক্ষণ নিয়েছেন। এখনো অনেক তালেবান সদস্য পাকিস্তানে পড়াশোনা করছেন বলে ওই সাক্ষাৎকারে দাবি করেছেন তিনি। পাকিস্তানের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, তালেবান নেতা মোল্লা বারাদার পাকিস্তানের কারাগারে বন্দী ছিলেন। যুক্তরাষ্ট্রই তাঁকে মুক্তি দেওয়ার ব্যাপারে সুপারিশ করেছিল।
নিজেরা এত সম্পদশালী হয়েও আফগানরা কখনোই আফগান হতে পারেনি। তাজিক, উজবেক, হাজারা, পশতুন তো ছিলই; রুশদের হটাতে তারা হয়েছে মুজাহিদিন; মুজাহিদিনের বিরুদ্ধে লড়তে হয়েছে তালেবান, এখন তালেবানদের বিরুদ্ধে লড়ছে আইএস-কে, প্রতিরোধযোদ্ধা বা নর্দার্ন অ্যালায়েন্স।
পাকিস্তান তালেবানের কাছে সেকেন্ড হোমের মতো বলে এর আগে সংগঠনটির মুখপাত্র জাবিউল্লাহ মুজাহিদ জানিয়েছিলেন। দুই দেশের মানুষ বলতে গেলে একে অপরের সঙ্গে মিশে আছে। তবে পাকিস্তান যে সাপের লেজে পা দিয়ে বসে আছে, সেটি হয়তো তারা এখনো বুঝতে পারছে না। ইতিমধ্যে পাকিস্তানের হোম গ্রোন জঙ্গিরা তালেবানদের আমন্ত্রণ জানিয়েছে তাদের সঙ্গে যোগ দিয়ে কাশ্মীর মুক্ত করতে। এই দুই জঙ্গিগোষ্ঠী যদি একসঙ্গে হয়, তার সঙ্গে প্রকাশ্যে-নেপথ্যে যদি যুক্ত হয় পাকিস্তান সেনাবাহিনী, আশঙ্কা করি, তাহলে প্রথম পতন হবে পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রটির। কারণ, এই জঙ্গি ঐক্য পাকিস্তানের প্রথাগত রাষ্ট্রকাঠামো (যা নানা কারণে এমনিতেই ঠুনকো) পুরোপুরি ভেঙে দেবে। দ্বিতীয় আশঙ্কা, ভারতের ধর্মভিত্তিক শাসনে অতিষ্ঠ সংখ্যালঘুদের ক্ষুব্ধ অংশ, জঙ্গিগোষ্ঠী এবং বাংলাদেশের জঙ্গি ও তাদের ওপর ভর করে যারা রাষ্ট্রক্ষমতায় যেতে চায়, তাদের মধ্যে একধরনের মানসিক ঐক্য প্রতিষ্ঠিত হবে। চাঙা হবে তাদের কার্যক্রম, যা আঞ্চলিক স্থিতিশীলতার জন্য যথেষ্ট।
ইরানকে কেন্দ্র করে দোহার শাসক, বৈরুতের হিজবুল্লাহর যে সমীকরণ মধ্যপ্রাচ্যে নতুন বলয় তৈরি করেছে, তার সঙ্গে বর্তমান কাবুলের তালেবান ঐক্য সৌদি আরব ও যুক্তরাষ্ট্রের জন্য মাথাব্যথার কারণ হয়েই থাকবে। আপাতত চীন তালেবানদের বড় ভরসাস্থল হলেও উইঘুর ইস্যু নিয়ে তালেবানদের অবস্থান একসময় চীনকেও বিব্রতকর অবস্থায় ফেলবে, তা খুব সহজেই ধারণা করা যায়। সব ছাপিয়ে আফগানিস্তান গৃহযুদ্ধমুক্ত একটি দেশ হয়ে দ্রুতই সামনের দিকে এগিয়ে যাবে, এমন সম্ভাবনাও দেখা যাচ্ছে না।
৫.
মার্কিন বাহিনীর হাতে তালেবান পতনের পর নির্মিত চলচ্চিত্র ‘ওসামা ২০০৩’ যতবার দেখি, ততবার চোখ ভিজে ওঠে। দড়ি লাফানো এক উচ্ছল কিশোরী কীভাবে তালেবানদের হাত থেকে রক্ষা পেতে চুল কেটে বালক সেজে আত্মরক্ষার চেষ্টা করে, কিন্তু শেষ রক্ষা হয় না। বালিকা কেন বালক সাজার চেষ্টা করেছিল, এই অপরাধে তার সাজা হয়। তাকে তার চেয়ে পাঁচ গুণ বয়সী এক বৃদ্ধের সঙ্গে যেতে হয় চতুর্থ স্ত্রী হিসেবে।
সেই পথ কবির আকাঙ্ক্ষা সামনে রেখে, আজ থেকে চার দশক আগে নমস্য খান আবদুল গাফফার খান যে পরামর্শ দিয়েছিলেন: ‘...ভুলে যাও উজবেক, তাজিক, হাজারা বা পশতুন পরিচয়...যদি নিজেদের আফগান ভাবতে না পারো, তাহলে আফগানিস্তান টিকবে না।’ তাঁর সঙ্গে যোগ করে বলি, আফগানদের আধুনিক হতে হবে, যুগের সঙ্গে তাল মেলাতে এবং মানবিক হতে হবে। তা না হলে শুধু অস্ত্র, শুধু যুদ্ধ, শুধু রক্ত ঝরিয়ে, নারীদের বোরকায় আবদ্ধ রেখে আফগানিস্তান একটি আধুনিক দেশ হিসেবে গড়ে উঠতে পারবে না।
দেশটির সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ হয়তো তাদের জন্মভূমিকে নিয়ে বলতে পারবে ‘ইনহাস্ত ওয়াতানম’—এই তো আমার জন্মভূমি। কিন্তু আফগানিস্তান আফগানদের হাত ধরে একটি আধুনিক দেশ না হতে পারলে নতুন প্রজন্ম হয়তো অন্যভাবে বলবে, ‘এই কি আমার জন্মভূমি?’
তথ্যসুত্র: বিভিন্ন সংবাদমাধ্যম
মনজুরুল আহসান বুলবুল সাংবাদিক