আফগানিস্তানে যুক্তরাষ্ট্রের পতনের পর দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতিতে চীনের ব্যাপক উত্থান বেশি দিন টিকবে কি না, এই প্রশ্ন এখন বেশ আলোচিত। ঋণের জালে জর্জরিত হয়ে শ্রীলঙ্কা নিজেদের অর্থনৈতিকভাবে দেউলিয়া ঘোষণা করেছে। পাকিস্তান আগে থেকেই বৈদেশিক ঋণে জর্জরিত ছিল, অর্থনৈতিক সংকটের পাশাপাশি রাজনৈতিক সংকট ও দুর্বল জোট সরকারের ক্ষমতারোহন দেশটিতে মার্কিন প্রভাব বাড়াবে। শ্রীলঙ্কা-পাকিস্তানকে উদ্ধারে চীন এগিয়ে আসেনি বলে দেশ দুটির ভরসা এখন আইএমএফ ঋণ ও ঋণনির্ভর সংস্কার পরিকল্পনা। অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্র নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে বাংলাদেশে তার স্বার্থ বিস্তারের লাল সংকেত দিয়ে রেখেছে। ভারত আগে থেকেই যুক্তরাষ্ট্রের প্রধানতম কৌশলগত মিত্র। সব মিলিয়ে দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতিতে যুক্তরাষ্ট্র সুস্পষ্টভাবেই প্রভাব কায়েমে মাঠে নেমেছে।
মার্চের শেষ দিকে পাকিস্তানের পরিশোধ করা মোট চার বিলিয়ন ডলারের ঋণ রি-ইস্যু করার প্রতিশ্রুতি চীন এখনো রাখেনি। ২ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলারের ক্রেডিট সাপোর্টের জন্য শ্রীলঙ্কার আবেদনেও দ্বিধাগ্রস্ত চীন সাড়া দেয়নি। বেইজিং ঋণগ্রস্ত দেশগুলোতে রাজনৈতিক অস্থিরতা শেষ হওয়ার অপেক্ষা করছে। এতে বেইজিংয়ের বিরুদ্ধে ‘ঋণের ফাঁদ’ ফেলে বিশ্বের উন্নয়নশীল দেশগুলোকে নিজের ওপর নির্ভরশীল করা এবং অর্থনৈতিক বিপদের সময় অনুদার ও নিষ্ক্রিয় থাকার অভিযোগ জোরালো হচ্ছে। অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে অভিযোগ হচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্র যাকে সামরিক বন্ধু বানিয়েছে, তার নির্মম পরিণতি বিশ্ব দেখেছে। সাদ্দাম থেকে গাদ্দাফি, তালেবান থেকে পাকিস্তান—সবখানেই যুক্তরাষ্ট্র কৌশলগত সামরিক বন্ধুত্বের প্যাকেজে ঢুকে প্রত্যক্ষ–পরোক্ষ মদদে কার্যত দেশ ধ্বংস করে ছেড়েছে। ইউরোপ ছাড়া যুক্তরাষ্ট্রের কোনো স্থায়ী মিত্র নেই। চীন যেমন অর্থনৈতিক বিপদের সময় অবিশ্বস্ত প্রমাণিত, যুক্তরাষ্ট্রও তেমনি সামরিক দিক থেকে প্রতারক। নিজেদের সামরিক জ্বালানি ও অর্থনৈতিক আধিপত্য ছাড়া তারা কিছুই বোঝে না। অন্যদিকে ভারত ও রাশিয়ার বিষয়ে সত্য হচ্ছে তারা অনুদার ও কৃপণ মিত্র।
মুক্ত, শান্তিপূর্ণ ও নিরাপদ ভারত-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চল প্রতিষ্ঠায় যুক্তরাষ্ট্রের লক্ষ্যের সঙ্গে বাংলাদেশের জনগণের কোনো দ্বিমত নেই। কিন্তু এই লক্ষ্য অর্জনের জন্য বাংলাদেশের বৈধতার সংকটে থাকা সরকারকে যাতে আরেকটি নির্বাচনী বৈতরণি পারের সুযোগ কেউ না দেয়, সেটাই জনগণের প্রত্যাশা। আন্তর্জাতিক বৈধতার সংকট কাটাতে সরকার যাতে দেশের ভবিষ্যৎ স্বার্থ বিসর্জন না দেয়, সেটাও জনগণের দেখার বিষয়। জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচিত জবাবদিহিমূলক দক্ষ, যোগ্য ও সৎ সরকারই শুধু দেশের ভূরাজনৈতিক গুরুত্বকে অর্থনৈতিক সুযোগ ও সম্ভাবনার দর-কষাকষিতে পরিণত করতে সক্ষমতা দেখাতে পারে।
বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় রপ্তানি বাজার যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপে। বাংলাদেশ শুধু যুক্তরাষ্ট্রে যা রপ্তানি করে, তার মাত্র ৮ ভাগের ১ ভাগ বিক্রি করে চীনে কিংবা ভারতে। মাত্র ১০ ভাগের ১ ভাগ বিক্রি করে রাশিয়ায়। করোনার পরে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে পোশাক রপ্তানি বেড়েছে প্রায় দেড় গুণ। অন্যদিকে বাংলাদেশের মোট আমদানির প্রায় এক-তৃতীয়াংশের আমদানির উৎস চীন, যা যুক্তরাষ্ট্রের প্রায় ১০ গুণ। মোট আমদানির প্রায় এক–চতুর্থাংশের কাছাকাছি আমদানির উৎস ভারত। বাংলাদেশের মূল উন্নয়ন সহযোগী ও ঋণদাতা জাপানের জাইকা, এডিবি, বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ এবং চীন-রাশিয়া। ফলে বাংলাদেশের স্বার্থের একক কোনো শিবির আবিষ্কার করা বেশ দুরূহ। এমন পরিস্থিতিতে ইন্দো-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের নতুন ভূরাজনীতিতে বিবদমান দুই পরাশক্তির ক্রমবর্ধমান প্রভাবে বাংলাদেশের মতো উদীয়মান অর্থনীতির সামনে নতুন শঙ্কা কিংবা নতুন সম্ভাবনার ক্ষেত্র তৈরি করেছে।
শ্রীলঙ্কা-পাকিস্তানের মতো অর্থনৈতিক সংকটে না থাকলেও নির্বাচনী ব্যবস্থা কার্যত ধ্বংস করে ফেলায় বাংলাদেশে একটি দলের কেন্দ্রীভূত শাসন কায়েম হয়েছে। নাজুক মানবাধিকার পরিস্থিতি, দুর্নীতির বিস্তৃতি ও গণতন্ত্রহীনতার প্রশ্নগুলো যুক্তরাষ্ট্রকে বাংলাদেশের ওপর নাক গলানোর সুযোগ ক্রমাগতভাবে বাড়িয়ে দিয়েছে। বাংলাদেশের মূল সমস্যা হচ্ছে, সরকারে থাকার বিষয়টি এখন আর জনগণের ভোটের ওপর নির্ভর করে না। ফলে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে বাংলাদেশ সরকারের দর-কষাকষির ক্ষমতা একেবারেই নগণ্য। এই দুর্বলতা ন্যায্যতাভিত্তিক বহুপক্ষীয় আন্তর্জাতিক সম্পর্ক তৈরির ক্ষেত্রে বিরাট এক দেয়াল তৈরি করে দিয়েছে।
জনভিত্তির দুর্বলতা, প্রশ্নযুক্ত নির্বাচনের কারণে সরকারকে বৈদেশিক আস্থা অর্জনে সংকটে পড়তে হয়েছে। অভিযোগ আছে, বাংলাদেশের বর্তমান সরকারকে বৈদেশিক সমর্থন জুটিয়ে দেওয়ার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় ভূমিকা পালন করছে ভারত। এদিকে অর্থনৈতিক ‘উন্নয়ন’ চলমান রাখতে সরকার জাপান ও চীনা ঋণের দ্বারস্থ হয়েছে। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্র যে নীতির প্রতি জোর দিয়ে থাকে, তা হচ্ছে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা, মানবাধিকার ও গণতন্ত্র। সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধের অংশ হিসেবে ‘অপারেশন ইরাকি ফ্রিডম’-এ তৎকালীন বিএনপি-জামায়াত সরকারের সৈন্য পাঠাতে অস্বীকৃতি এবং বাংলাদেশে জঙ্গি হামলা বৃদ্ধির ঘটনা রাজনৈতিক মেরুকরণ ও সরকার পরিবর্তনের পরিস্থিতি তৈরি করে। বলা যায়, এ ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্র-ভারত-ইউরোপ—ত্রিপক্ষীয় সমঝোতা তৈরি হয়। বাংলাদেশ-ভারতের সীমান্ত অঞ্চলের নিরাপত্তা এবং বাংলাদেশের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা প্রশ্নে আওয়ামী লীগের প্রতি ভারত-যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থন অব্যাহত রয়েছে বিগত দেড় দশক। এতে বাংলাদেশে মানবাধিকার পরিস্থিতি নাজুক হয়েছে, বিরোধী শক্তি দুর্বল হয়েছে। ২০১৪ সালে একদলীয় নির্বাচন এবং ২০১৮ সালের প্রশ্নবিদ্ধ ভোটের পরও যুক্তরাষ্ট্র স্থিতিশীলতা প্রশ্নে আওয়ামী লীগ সরকারকে শীতল সমর্থন দিয়ে গেছে। কিন্তু এরই ফাঁকে চীনের সঙ্গে অবকাঠামো নির্মাণসহ গভীরতর বহুমুখী সম্পর্ক তৈরি হয়ে গেছে। বাংলাদেশের কাছে চীন সাবমেরিনও বিক্রি করেছে।
ভারত-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে চীনের ক্রমবর্ধমান প্রভাব ঠেকাতে যুক্তরাষ্ট্র যখন মরিয়া, তখন চীনের রোড বেল্ট ইনিশিয়েটিভে (বিআরআই) যুক্ত হওয়াসহ গভীর অর্থনৈতিক-সামরিক সম্পর্কের সূচনার পরিপ্রেক্ষিতে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার পরিবর্তে মানবাধিকার ও গণতন্ত্রের ইস্যু সামনে নিয়ে এসে র্যাবের ওপর নিষেধজ্ঞা আরোপ করে নতুন পরিস্থিতি তৈরি করে ফেলেছে। দুই স্তরের নিষেধাজ্ঞার পরও মানবাধিকার পরিস্থিতি ভালো করার, গণতন্ত্র পুনর্বাসনের সুস্পষ্ট প্রতিজ্ঞা, গুম ও খুনের অভিযুক্ত ব্যক্তিদের বিচারের কোনো বিশ্বাসযোগ্য পদক্ষেপ সরকারের কাছ থেকে পাওয়া যায়নি। এনফোর্সড ডিজঅ্যাপিয়ারেন্স বিষয়ে জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশনের স্পেশাল র্যাপোর্টিয়ার বাংলাদেশে আসার জন্য বহুবার আবেদন করেছে। গুম-খুনের শিকার পরিবারগুলোর সংগঠন ‘মায়ের ডাক’–এর প্রধানতম একটা দাবি হচ্ছে জাতিসংঘের টিমকে স্বাধীনভাবে কাজ করতে দেওয়া। কিন্তু সরকার জাতিসংঘের গুমবিষয়ক টিমকে বাংলাদেশে আসার অনুমতি দেয়নি। সরকার কয়েক স্তরের লবিস্ট নিয়োগ করেও নিষেধাজ্ঞা এড়ানোর কোনো সংকেতই পাচ্ছে না। বরং আলোচনার টেবিলে উঠেছে যুক্তরাষ্ট্রের অনুকূলে বেশ কিছু দ্বিপক্ষীয় ও বহুপক্ষীয় চুক্তি।
বাংলাদেশের সঙ্গে প্রতিরক্ষাসংক্রান্ত আকসা ও জিসোমিয়া নামে দুটি চুক্তি সই করতে চায় যুক্তরাষ্ট্র। আকসা (অ্যাকুইজিশন অ্যান্ড ক্রস-সার্ভিসিং অ্যাগ্রিমেন্ট) চুক্তির অধীনে মার্কিন বাহিনী খাদ্য, জ্বালানি, গোলাবারুদ ও সরঞ্জামাদি বিনিময় হয়ে থাকে। জিসোমিয়া (জেনারেল সিকিউরিটি অব মিলিটারি ইনফরমেশন অ্যাগ্রিমেন্ট) চুক্তির অধীনে হয় সামরিক গোয়েন্দা তথ্যের বিনিময়। অন্যদিকে র্যাবের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়ার দাবি বাংলাদেশের। স্পষ্টতই দেখা যাচ্ছে, দেশের এলিট ফোর্সের ওপর নিষেধাজ্ঞার খাঁড়া রেখে আরেকটি জোরজবরদস্তিমূলক নির্বাচন করা সরকারে জন্য দুরূহ। রাষ্ট্রীয় বাহিনীকে ব্যবহার করে বিরোধী নির্যাতন ও ভয়ের সংস্কৃতি জারি রাখাও কঠিন। আশঙ্কা হচ্ছে, সরকারের এমন নাজুক পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র নিজের ভূরাজনৈতিক স্বার্থ উদ্ধারের চেষ্টা করতে পারে।
আমরা নবনিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাসের মুখে আইপিএস নিয়ে বক্তব্য শুনেছি। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের পরিপ্রেক্ষিতে নতুন বিশ্ব পরিস্থিতি, ইন্দো-প্যাসিফিক সহযোগিতার বিস্তার, বর্তমান ভূরাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে নতুন মাত্রার বহু সমীকরণের মধ্যে মার্চ ২০২২–এ অনুষ্ঠিত হয়েছে বাংলাদেশ-যুক্তরাষ্ট্র অংশীদারত্ব সংলাপ। এখানে শীর্ষ আলোচ্য ছিল আইপিএস, আকসা ও জিসোমিয়ার চুক্তি।
এদিকে চীনের বিআরআইয়ের বিপরীতে যুক্তরাষ্ট্র হাজির হয়েছে ইন্দো-প্যাসিফিক স্ট্র্যাটেজি (আইপিএস) নামের অর্থনৈতিক করিডর নিয়ে। যুক্তরাষ্ট্রের ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশলপত্রে পাঁচটি মূল উপাদান রয়েছে—অবাধ ও উন্মুক্ত অঞ্চল, আন্তসংযোগ, সমৃদ্ধিশালী অর্থনীতি, নিরাপত্তা ও ঝুঁকিসহিষ্ণুতা। আইপিএসের আওতায় সামরিক, নিরাপত্তা, বাণিজ্য ও বিনিয়োগ, উন্নয়ন ও সুশাসন নিয়ে বাংলাদেশের সঙ্গে বৃহত্তর অংশীদারত্ব গড়তে চায় যুক্তরাষ্ট্র। ভিন্ন ভিন্ন সুবিধা নিয়ে আইপিএসের যুক্তরাষ্ট্রীয় ও ইউরোপীয় দুটি ধারাও রয়েছে।
পাশাপাশি রয়েছে কোয়াডের মতো বহুপক্ষীয় সামরিক জোটে যুক্ত হওয়ার প্রস্তাব। সামরিক দিক থেকে বিশ্বে সবচেয়ে শক্তিশালী দেশটি সমরাস্ত্র আধুনিকায়নে বাংলাদেশের প্রতিরক্ষা বাহিনীগুলোর ‘ফোর্সেস ভিশন-২০৩০’ অর্জনে সহযোগিতা দিতে আগ্রহী। বলা হচ্ছে, রোহিঙ্গা ইস্যুতে বাংলাদেশের পাশে জোরালোভাবে থাকবে যুক্তরাষ্ট্র। এদিকে ভারতের পক্ষ থেকে রয়েছে হোয়াইট শিপমেন্ট চুক্তির চাপ, যেখানে বাংলাদেশ বঙ্গোপসাগরে বাণিজ্যিক ও বেসামরিক জাহাজ চলাচলের তথ্য আদানপ্রদান করবে। ইতিপূর্বে বাংলাদেশ ভারতকে ট্রানজিট, ট্রান্সশিপমেন্ট, অগ্রাধিকার বন্দর ব্যবহার, স্থল ট্রানজিট সুবিধা দিয়েছে এবং মেরিটাইম চুক্তি করেছে। সব মিলিয়ে ঢাকার আকাশে ঝুলছে বহু চুক্তির খাঁড়া। এসব জটিলতর বৈদেশিক চুক্তি বাংলাদেশের মানুষের জন্য সম্ভাবনার নতুন বার্তা বয়ে আনবে, নাকি বাংলাদেশকে সামরিক ঝুঁকিতে ফেলবে, তা বুঝতে সময় লাগবে।
গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, কোয়াডের মতো বহুপক্ষীয় চুক্তির বাইরেও বাংলাদেশ-যুক্তরাষ্ট্রের দর-কষাকষির প্রধানতম আলোচ্য হয়ে উঠেছে আকসা ও জিসোমিয়ার মতো দ্বিপক্ষীয় সামরিক ও গোয়েন্দা চুক্তি। সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধের অংশীদার হয়েও যেখানে এ রকম সামরিক সরঞ্জাম ও গোয়েন্দাবিষয়ক লেনদেনের দরকার পড়েনি, সেখানে আকসা ও জিসোমিয়ার মতো চুক্তির জন্য চাপ কিসের বার্তা দেয়? তবে কি যুক্তরাষ্ট্র এই অঞ্চলে ভবিষ্যতের কোনো ভূরাজনৈতিক পরিকল্পনা কিংবা সামরিক উপস্থিতির আগাম প্রস্তুতি নিয়ে রাখছে? চীনের তিব্বত, মিয়ানমারের আরাকান ও চিন প্রদেশ, ভারতের সেভেন সিস্টার্সকে কেন্দ্র করে এই অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের কোনো আগাম ভূরাজনৈতিক পরিকল্পনার বীজ বোনা হচ্ছে না তো! এই অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্র কোনো ধরনের যুদ্ধে জড়িত না হলে সরাসরি যুদ্ধ প্রস্তুতি–সম্পর্কিত চুক্তির জন্য এমন চাপ আসবে কেন!
আমরা নবনিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাসের মুখে আইপিএস নিয়ে বক্তব্য শুনেছি। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের পরিপ্রেক্ষিতে নতুন বিশ্ব পরিস্থিতি, ইন্দো-প্যাসিফিক সহযোগিতার বিস্তার, বর্তমান ভূরাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে নতুন মাত্রার বহু সমীকরণের মধ্যে মার্চ ২০২২–এ অনুষ্ঠিত হয়েছে বাংলাদেশ-যুক্তরাষ্ট্র অংশীদারত্ব সংলাপ। এখানে শীর্ষ আলোচ্য ছিল আইপিএস, আকসা ও জিসোমিয়ার চুক্তি। বাইডেন আমলের প্রথম অংশীদারি সংলাপে মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের রাজনীতিসংক্রান্ত আন্ডার সেক্রেটারি ভিক্টোরিয়া নুল্যান্ড বলেছেন, ‘এই সংলাপ হলো বড় ভোজের আগে অ্যাপিটাইজার।’ পাশাপাশি বলে গেছেন, নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়া এক জটিল প্রক্রিয়া। উভয় ইঙ্গিতই তাৎপর্যবাহী।
চীনের রোড-বেল্ট ইনিশিয়েটিভ একটি অর্থনৈতিক পদক্ষেপ। বিপরীতে আইপিএসে সামরিক উপাদানের পরোক্ষ সংযোগ আছে। আকসা ও জিসোমিয়া গভীরতর সামরিক ও গোয়েন্দা সম্পর্কের বিষয়। কোয়াড সামরিক জোট। চীনের সঙ্গে যেহেতু বাংলাদেশের সামরিক ও অর্থনৈতিক সম্পর্ক খুবই জোরালো, তাই এই চার চুক্তির প্রতিটিই আলাদা আলাদা কিংবা সামষ্টিকভাবে চীন-ভারত-যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ভারসাম্যপূর্ণ সম্পর্কে উত্তেজনা ও ঝুঁকি তৈরি করতে পারে। এসব চুক্তির কিছু উপাদান এই অঞ্চলে চীনের স্বার্থের বিরুদ্ধে গেলে আঞ্চলিক অস্থিরতা তৈরি হতে পারে। তদুপরি আইপিএস আকসা ও জিসোমিয়ার ত্রিমুখী প্যাকেজ কৌশলের আওতা শুধু অবকাঠামোগত বিনিয়োগেই সীমাবদ্ধ না থেকে বরং তা বিদ্যমান বাংলাদেশ-চীন কিংবা বাংলাদেশ-জাপান কিংবা বাংলাদেশ-ভারত ইত্যাদি দ্বিপক্ষীয় চুক্তিগুলোর ভারসাম্য নষ্টের কারণ হতে পারে।
মুক্ত, শান্তিপূর্ণ ও নিরাপদ ভারত-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চল প্রতিষ্ঠায় যুক্তরাষ্ট্রের লক্ষ্যের সঙ্গে বাংলাদেশের জনগণের কোনো দ্বিমত নেই। কিন্তু এই লক্ষ্য অর্জনের জন্য বাংলাদেশের বৈধতার সংকটে থাকা সরকারকে যাতে আরেকটি নির্বাচনী বৈতরণি পারের সুযোগ কেউ না দেয়, সেটাই জনগণের প্রত্যাশা। আন্তর্জাতিক বৈধতার সংকট কাটাতে সরকার যাতে দেশের ভবিষ্যৎ স্বার্থ বিসর্জন না দেয়, সেটাও জনগণের দেখার বিষয়। জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচিত জবাবদিহিমূলক দক্ষ, যোগ্য ও সৎ সরকারই শুধু দেশের ভূরাজনৈতিক গুরুত্বকে অর্থনৈতিক সুযোগ ও সম্ভাবনার দর-কষাকষিতে পরিণত করতে সক্ষমতা দেখাতে পারে।
ফয়েজ আহমদ তৈয়্যব টেকসই উন্নয়নবিষয়ক লেখক। গ্রন্থকার: ‘চতুর্থ শিল্পবিপ্লব ও বাংলাদেশ’, ‘বাংলাদেশ অর্থনীতির ৫০ বছর’, ‘অপ্রতিরোধ্য উন্নয়নয়ের অভাবিত কথামালা’, ‘উন্নয়ন প্রশ্নে বাংলাদেশের কিছু সংকট ও সম্ভাবনা’। [email protected]