নাগোরনো-কারাবাখ নিয়ে আর্মেনিয়া ও আজারবাইজানের মানুষের মধ্যে বিরোধ চিরকালীন নয়, এই বিরোধ প্রাচীন কোনো ঘৃণার ভিত্তিতেও তৈরি হয়নি। রুশ সাম্রাজ্যের আগমনের আগপর্যন্ত আর্মেনীয় ও আজেরি—এই দুই জাতি বহু শতাব্দী ধরে শান্তিপূর্ণভাবে একসঙ্গে বাস করে আসছিল।
আজকের দ্বন্দ্বের উৎস হলো সার্বভৌম আজারবাইজানে আর্মেনিয়ার সামরিক দখলদারি। আর্মেনিয়া এই সংঘাতকে মুসলিম আজারবাইজানের সঙ্গে ‘সভ্যতার সংঘাত’ হিসেবে চিত্রিত করে ‘খ্রিষ্টান কার্ড’ খেলার চেষ্টা করেছে। কিন্তু সেই প্রচার খুব একটা বিকোচ্ছে না।
আর্মেনিয়ার বাহিনী নাগোরনো-কারাবাখ থেকে ৭ লাখ ৮০ হাজার আজেরি মুসলিমকে তাড়িয়ে দেয়। এর প্রতিশোধ হিসেবে আজারবাইজানে থাকা আর্মেনীয়দের ওপর আজেরিরা চড়াও হয় এবং আজারবাইজান থেকে আড়াই লাখ আর্মেনীয় আর্মেনিয়ায় পালিয়ে যায়
আজ নেদারল্যান্ডস যেভাবে একটি খ্রিষ্টান দেশ হিসেবে পরিচিত, আজারবাইজানও প্রায় একইভাবে মুসলিম দেশ হিসেবে সবার কাছে পরিচিত। ফলে ধর্মীয় পার্থক্যকে এই দ্বন্দ্বের ভিত্তি ভাবা ঠিক হবে না।
বিশ শতকের গোড়ার দিকে আজেরি এবং আর্মেনীয়দের মধ্যে বড় ধরনের সংঘর্ষ হয়েছিল, যার সম্প্রসারিত অভিঘাতে আজকের এই সংঘাত শুরু হয়েছে। ১৯২০–এর দশকের গোড়ার দিকে নাগোরনো-কারাবাখ স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল (এনকেএও) গঠিত হয়। আজারবাইজানীয় সোভিয়েত সমাজতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্রের (এএসএসএসআর) সীমানার মধ্যে এই ভূখণ্ডে প্রথম থেকেই সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠী হলো আর্মেনীয়রা।
কখনো কখনো যুক্তি দেওয়া হয়, তৎকালীন সোভিয়েত ককেশাস কমিটির প্রধান জোসেফ স্তালিন এএসএসআরের কাছে এনকেএওকে ‘হস্তান্তর’ করেছিলেন। এনকেএও সৃষ্টির আদেশের নথিতে বলা হয়েছে, এই অঞ্চলের আজারবাইজানের সঙ্গেই ‘থাকা উচিত’। এর অর্থ, এই ভূখণ্ডকে শুরু থেকেই আজারবাইজানের অংশ হিসেবে মনে করা হতো।
সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাওয়ার তিন বছর আগে ১৯৮৮ সালে, এনকেএও আঞ্চলিক কাউন্সিল আর্মেনিয়ান এসএসআরের সঙ্গে একীভূত হওয়ার পক্ষে ভোট দিয়েছিল। ১৯৯১ সালে স্বাধীনতার গণভোট যেভাবে অবৈধ ছিল, ঠিক একইভাবে এই ভোটও অবৈধ ছিল।
সোভিয়েত আইনে বলা ছিল, নাগোরনো-কারাবাখ কেবল ইউএসএসআরের (সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন) অংশ অথবা আজারবাইজানের অংশ হিসেবে থাকার বিকল্প প্রস্তাব দিতে পারে। কিন্তু স্বাধীনতা ঘোষণা কিংবা আর্মেনিয়ায় তাদের যোগ দেওয়ার বিষয়ে গণভোট গ্রহণ আইনিভাবে বৈধ ছিল না।
সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাওয়ার পরে আজারবাইজান ও আর্মেনিয়া সোভিয়েত সরকারের টেনে দেওয়া সীমান্ত নিয়েই স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃত হয়েছিল। এর অর্থ হলো, আন্তর্জাতিক আইন নাগোরনো-কারাবাখকে আজারবাইজানের সার্বভৌম অঞ্চল হিসেবে স্বীকৃতি দেয় এবং সেখানে আর্মেনিয়ার সামরিক বাহিনীর উপস্থিতিকে দখল হিসেবে দেখে।
যখন সোভিয়েত ভেঙে যাচ্ছিল, তখন আর্মেনীয় বাহিনী এই অঞ্চলে আক্রমণ করে এবং তখনই দ্বন্দ্বের সূত্রপাত ঘটে।
আর্মেনিয়ান বাহিনী এ পর্যন্ত আজারবাইজানের প্রায় ২০ শতাংশ অঞ্চল দখল করেছে। ১৯৯৩ সালে, জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ আর্মেনিয়ান বাহিনীকে আজারবাইজানের অধিকৃত অঞ্চল থেকে অবিলম্বে সরে আসার আহ্বান জানিয়ে প্রস্তাব অনুমোদন করে। কিন্তু আর্মেনিয়া সেই প্রস্তাব উপেক্ষা করেছে।
আর্মেনিয়ার বাহিনী নাগোরনো-কারাবাখ থেকে ৭ লাখ ৮০ হাজার আজেরি মুসলিমকে তাড়িয়ে দেয়। এর প্রতিশোধ হিসেবে আজারবাইজানে থাকা আর্মেনীয়দের ওপর আজেরিরা চড়াও হয় এবং আজারবাইজান থেকে আড়াই লাখ আর্মেনীয় আর্মেনিয়ায় পালিয়ে যায়।
বর্তমানে প্রায় ১০ হাজার আর্মেনীয় আজারবাইজানের বাকু, গাঞ্জা এবং অন্যান্য শহরে আছে।
তিন দশকজুড়ে থেমে থেমে সংঘাত হয়েছে। এ বছরের জুলাইয়ে নাগোরনো-কারাবাখ থেকে মাত্র এক শ কিলোমিটার দূরে আজারবাইজানের টভুজ শহরে আবার লড়াইয়ের সূত্রপাত হয়। সংঘর্ষের সময় রাশিয়া আর্মেনিয়াকে সামরিক সহায়তা দিয়েছে। এটি আজারবাইজানকে হতাশ করেছে; কারণ, গত ১৫ বছরে তারা মস্কোর সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নের চেষ্টা করেছে।
যুদ্ধবিরতির জন্য রাশিয়া মধ্যস্থতা করলেও ২৭ সেপ্টেম্বর লড়াই আবার শুরু হয়। তখন থেকে আর থামেনি। এখন প্রশ্ন হলো, আমরা এ বছর এই মাত্রায় সেখানে সংঘাত দেখছি কেন।
২০০৮ সালে নিকোল পাশিনিয়ান আর্মেনিয়ার প্রধানমন্ত্রী হন। তাঁর প্রথম দিককার বক্তব্য এই দুই দেশের দ্বন্দ্ব সমাধানে বড় আশা জাগিয়েছিল। কিন্তু তিনি যখন দেখলেন, তিনি তাঁর প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী আর্মেনীয় ভোটারদের অর্থনৈতিক অবস্থার উন্নতি করতে পারছেন না এবং তাঁর রাজনৈতিক অস্তিত্ব হুমকির মুখে পড়ছে, তখন তিনি ভোটারদের মন জয় করতে কট্টর জাতীয়তাবাদী হয়ে উঠলেন।
গত আগস্টে পাশিনিয়ান আজারবাইজানের অধিকৃত অঞ্চলগুলোকে আর্মেনিয়ার অঙ্গ হিসেবে ঘোষণা করেন। নব্বইয়ের দশকের গোড়ার দিকে যুদ্ধের পর থেকে কোনো আর্মেনীয় রাজনীতিবিদ তা বলেননি। এরপরই আজারবাইজান মারমুখী হয়ে ওঠে।
আল–জাজিরা থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনূদিত
রবার্ট এম কাটলার: কানাডিয়ান গ্লোবাল অ্যাফেয়ার্স ইনস্টিটিউটের একজন ফেলো