নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন বলতে যা বোঝায়
পাকিস্তান, আফগানিস্তান ও বাংলাদেশ থেকে নির্যাতনের শিকার হয়ে ভারতে আসা হিন্দু, শিখ, খ্রিষ্টান, বৌদ্ধ, জৈন ও পারসিকদের স্থায়ীভাবে নাগরিকত্ব দেওয়ার বিষয়টি অনুমোদন করে ২০১৯ সালের ডিসেম্বর মাসে পার্লামেন্টে যে নাগরিকত্ব সংশোধন আইন পাস হয়েছে, তা নিয়ে ব্যাপক ও নজিরবিহীন বিতর্ক চলছে। এই বিতর্ক ১৯৪৭ সালে দেশভাগের সময়ের, অর্থাৎ পাকিস্তান নামক মুসলিম দেশের জন্মের সময়ের দুঃখজনক ও বিশৃঙ্খলাপূর্ণ পরিস্থিতির স্মৃতিকে আরও একবার যেন উসকে দিয়েছে। ওই সময় ভারত ও পাকিস্তান উভয় ভূখণ্ডেই রক্তক্ষয়ী দাঙ্গা ও খুনোখুনি হয়েছিল। পাঞ্জাব, সিন্ধু ও উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলীয় সীমান্ত প্রদেশ থেকে লাখ লাখ হিন্দু ও শিখ প্রাণভয়ে ভারতে চলে এসেছিল এবং পাঞ্জাব, দিল্লি ও উত্তর প্রদেশ থেকে প্রধানত মুসলমানরা পাকিস্তানে চলে গিয়েছিল। সে সময় ভারত ও আফগানিস্তানের মধ্যে নির্ধারিত কোনো সীমান্তরেখা ছিল না এবং দুই ভূখণ্ডের মানুষের অবাধ যাতায়াত ছিল বলে আফগানিস্তান থেকেও বহু হিন্দু ও শিখ ভারতে চলে এসেছিল।
যাহোক, দুই দেশের জনগণের এই অদলবদল তখন সমন্বয় করে করা হয়নি। সে সময়ও অনেকে নিজ দেশ ছেড়ে অন্য দেশে যেতে চায়নি, অনেকে ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও যেতে পারেনি। দেশভাগের সময়কার এই সহিংসতা যদিও ভারত ও পূর্ব পাকিস্তানের (বর্তমান বাংলাদেশ) মধ্যে অপেক্ষাকৃত কম ছড়িয়েছিল, তথাপি সাত দশক ধরে ধারাবাহিকভাবে বাংলাদেশ থেকে শরণার্থীরা ভারতে এসেছে।
পাকিস্তানে ধর্মীয় সংখ্যালঘুরা ভয়াবহভাবে নির্যাতনের শিকার হয়েছে এবং তাদের ওপর অপেক্ষাকৃত কম নির্যাতন হয়েছে (এখনো হচ্ছে) বাংলাদেশ ও আফগানিস্তানে। নির্যাতনের শিকার হয়ে পালিয়ে আসা এসব সংখ্যালঘু ভারতে এসে আশ্রয় চাইছে এবং ভারত সরকার অস্থায়ী ভিত্তিতে তাদের নাগরিকত্ব দিচ্ছে।
ভারতের নতুন নাগরিকত্ব আইন এখন এই অস্থায়ী নাগরিকত্বের অধীনে থাকা নির্যাতিত মানুষকে কেবল আনুষ্ঠানিকভাবে স্থায়ী নাগরিকত্ব দিচ্ছে, যা এসব মানুষকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তি হওয়া, চাকরি পাওয়া, সম্পত্তি কেনা, রাষ্ট্রীয় যাবতীয় সুযোগ-সুবিধা পাওয়াসহ সম্মানজনক জীবন-জীবিকার নিশ্চয়তা দেবে।
প্রতিবেশী দেশ থেকে আসা নির্যাতিতদের পুনর্বাসন করতে ভারত নৈতিকভাবে বাধ্য এবং দশকের পর দশক ধরে ভারতের সব রাজনৈতিক দলের নেতারা প্রকাশ্যেই এর সমর্থনে কথা বলেছেন। সাবেক প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং পাকিস্তান থেকে আসা শিখদের নাগরিকত্ব দেওয়ার পক্ষে প্রকাশ্যেই কথা বলেছেন।
এরপরও নতুন নাগরিকত্ব সংশোধন আইন নিয়ে এত হইচই কেন? ভারতের বিরোধী দলগুলো ক্ষমতা থেকে ছিটকে পড়ায় গভীর হতাশায় ডোবার কারণে এই সহজ ইস্যুটিকে ইচ্ছাকৃতভাবে পেঁচিয়ে ফেলে বিতর্কিত করছে। তারা মুসলমানদের মনে এই ভয় ঢুকিয়ে দিচ্ছে যে তাদের নাগরিকত্ব কেড়ে নেওয়া হবে। অথচ যারা বর্তমানে ভারতের নাগরিক, তাদের নিয়ে এই আইনে কিছুই বলা হয়নি।
এই দলগুলো ঐতিহ্যগতভাবে মুসলমানদের মধ্যে নিরাপত্তাহীনতার ভয় ঢুকিয়ে দিয়ে ক্রমাগত তাদের ভোটব্যাংক হিসেবে ব্যবহার করে। এই দলগুলো দায়িত্বজ্ঞানহীনের মতো নাগরিকত্ব সংশোধন আইনের সঙ্গে জাতীয় নাগরিক তালিকাকে (ন্যাশনাল রেজিস্ট্রার অব সিটিজেন বা এনআরসি) গুলিয়ে ফেলছে। সব পক্ষের সঙ্গে বিশদভাবে পরামর্শ ছাড়া এনআরসি করা হবে না—প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি স্বতঃস্ফূর্ত ও দ্ব্যর্থহীনভাবে এ কথা বলার পরও তারা এ দুটি বিষয়কে উদ্দেশ্যমূলকভাবে এক করে ফেলছে।
ভারতে বহুত্ববাদী সমাজব্যবস্থা আর নেই বলে যে আতঙ্ক ছড়ানো হচ্ছে, তা মোটেও ধোপে টিকবে না। কারণ, যে ভারতে সব ধর্মের অনুসারীরা নিজেদের নিরাপদ মনে করে এবং যে ভারতে কেউ নিজেদের বৈষম্যের শিকার বলে মনে করে না, সেই ভারতের প্রতি জনগণের শক্ত ও জোরালো সমর্থন রয়েছে।
মুসলমান (ভারতে যাদের সংখ্যা ধীরে ধীরে বেড়েছেই) এবং অন্য সব সংখ্যালঘুর সুরক্ষা নিশ্চিত করতে ভারতে বিশেষ আইন ও সাংবিধানিক বিধান রয়েছে। ভারতকে স্পষ্ট ও দ্ব্যর্থহীনভাবে বলতে হবে: ভারতীয় মুসলমানরা ভারতীয় সমাজের অবিচ্ছেদ্য অংশ এবং ভারতই তাদের দেশ। ভারত গর্বিত যে অনেক মুসলমান বলিউডের বড় তারকা ও খেলার জগতের আইকন। তাঁদের অনেকেই প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী ও শিল্পকারখানার মালিক ও নেতা।
এ ছাড়া বহু গর্বিত ও দেশপ্রেমিক মুসলমান সেনা ও জেনারেল আছেন, মুসলমান প্রাজ্ঞ বিচারপতিরা আছেন, দক্ষ ও প্রতিশ্রুতিশীল মুসলিম অফিসার ও পুলিশ কর্মী আছেন, প্রতিভাবান মুসলিম বিজ্ঞানী ও প্রকৌশলীরা আছেন। ইসলাম ধর্মের সব গোষ্ঠীর লোকই এখানে শান্তিপূর্ণভাবে তাঁদের ধর্মকর্ম করতে পারেন। মুসলমানসহ সব সংখ্যালঘুরা তাদের উপাসনালয় ও ধর্মীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান চালাতে পারে। নিজেদের ছেলেমেয়েরা যাতে তাদের ধর্মীয় শিক্ষা–দীক্ষা অর্জন করতে পারে, সে জন্য তারা ধর্মীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানও চালাতে পারে। ভারতে কোনো নির্দিষ্ট গোষ্ঠী বা সম্প্রদায়কে বাড়তি সুবিধা দেওয়ার উদ্দেশ্যে রাস্তাঘাট, পানি সরবরাহব্যবস্থা, গ্যাস সরবরাহব্যবস্থা, আবাসন, শৌচাগার, শিক্ষা, স্বাস্থ্য ইত্যাদি খাতের উন্নয়নকাজ করা হয় না।
ভারতে তেজি গণতন্ত্র বিদ্যমান আছে। এখানে সবার ওপরে সংবিধান। এখানে বিতর্ক ও বিরোধিতার পর্যাপ্ত সুযোগ আছে। এখানে নির্যাতিতের নালিশ শোনার জন্য স্বাধীন বিচারব্যবস্থা আছে। এখানে শান্তিপূর্ণ আন্দোলন গ্রহণযোগ্য, তবে সহিংসতা বরদাশতযোগ্য নয়। কেউ যদি জনগণের তথা সরকারের সম্পত্তি ধ্বংস করে এবং পুলিশ কর্মীদের ওপর বা কোনো প্রতিষ্ঠানের ওপর হামলা চালায়, তাহলে অবশ্যই তাঁকে জবাবদিহির আওতায় আনা উচিত।
পার্লামেন্টের কর্তৃত্ব ও সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানের ওপর প্রত্যেকেরই শ্রদ্ধাশীল হতে হবে। সংসদে উন্মুক্ত বিতর্কের পর আনুষ্ঠানিকভাবে পাস হওয়া আইন রাস্তার উন্মত্ত জনতা কিংবা রাজনীতিকদের বাগাড়ম্বরের কারণে উল্টে যেতে পারে না। পার্লামেন্টে অনুমোদিত কোনো আইন রাজ্য সরকার এবং রাজ্য বিধায়কদের রদ করার কোনো এখতিয়ার নেই। এ অবস্থায় সব রাজনৈতিক দল দায়িত্বশীল আচরণ করবে এবং গঠনমূলক দিকে জনমতকে পরিচালিত করবে, সেটাই কাম্য হওয়া দরকার।
ইংরেজি থেকে অনূদিত
রাজীব সিক্রি কাজাখস্তানে ভারতের সাবেক দূত ও ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অবসরপ্রাপ্ত সচিব