রোমানরা যখন ব্যাংকিং ব্যবসাকে গির্জার ঘেরাটোপ থেকে বের করে এনে আলাদা বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে প্রতিষ্ঠা করে কিংবা যখন বিশ্বের প্রথম বাণিজ্যিক ব্যাংকটি স্থাপিত হয়, সে সময় থেকে ব্যাংকিং ব্যবসার চরিত্র ও গতিপ্রকৃতিতে বহু ধরনের পরিবর্তন এসেছে। সেবাপণ্য ও মানে এসেছে বৈপ্লবিক পরিবর্তন। বর্তমান সময়ের মতো টাকা লগ্নিকারীদের দৌরাত্ম্য সে সময়েও ছিল, তবে যেকোনো বৈধ বাণিজ্যিক লেনদেন কিংবা রাষ্ট্রীয় হিসাব ও খরচাদি পরিচালনা হতো ব্যাংকিং প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে। নানান ব্যাংকিং প্রথা, বিভিন্ন নিয়মরীতি ও বিধানের গোড়াপত্তন হয়েছিল সে যুগেই। যেমন বর্তমানে ঋণখেলাপিদের বন্ধকি ভূসম্পত্তি বিক্রি করে দেওয়ার যে আইনি বিধান ও ক্ষমতা ব্যাংকগুলোর হাতে আছে, তার উদ্ভাবক ছিলেন রোমান সম্রাট জুলিয়াস সিজার। তিনি মসনদে বসার পর এক ফরমানবলে ঋণখেলাপের নিদান হিসেবে দেনাদারের ভূসম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করার ক্ষমতা দিয়েছিলেন ব্যাংকগুলোকে। তাঁর এই বৈপ্লবিক আইনের মাধ্যমে একদা ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকা ক্ষমতাবান ভূস্বামীদের ঋণদানকারী ব্যাংকের কাছে দায়বদ্ধতা নিশ্চিত করেছিলেন তিনি। এই বিধান চালু হওয়ার আগে ঋণগ্রহীতা ভূস্বামীদের ঋণ কেবল উত্তরাধিকারীদের ওপর বর্তাত, যত দিন পর্যন্ত ঋণদাতা ও ঋণগ্রহীতাদের এক পক্ষ রণে ভঙ্গ না দিত কিংবা মারা না যেত। এমন পরিস্থিতিতে গ্রহীতা ঋণ শোধ না করলে খেলাপি ঋণ আদায়ে জামানত বিক্রি করে আদায় করা ছিল বাস্তবে অসম্ভব।
নবলব্ধ এই ক্ষমতার কারণে ব্যাংকের পক্ষে নিরাপদে ব্যাংকিং ব্যবসা চালানো সহজ হয়। উপরন্তু, বিভিন্ন সম্রাটের আশীর্বাদপুষ্ট হওয়ার ফলে ব্যাংকের একটা বাড়তি মর্যাদাপ্রাপ্তিও ঘটে। তবে এই ক্ষমতা ও রাজকীয় মদদ যে কেবল আশীর্বাদ ছিল তা নয়, রাজকোষে তহবিলের ঘাটতি হলে ব্যাংকগুলো থেকে ঋণ নিয়েই রাজকীয় খরচ মেটানো হতো এবং সেই ঋণ দিতে হতো গ্রহীতার শর্তে। এই ঋণের অর্থ খরচ করা হতো রাজকীয় বিলাস ব্যসনে এবং অন্য সম্রাটদের সঙ্গে যুদ্ধ কিংবা সমর প্রতিযোগিতায়। ব্যাংকগুলো ঋণ গ্রহণের উদ্দেশ্য এবং ঋণের অর্থ ব্যবহার নিয়ে প্রশ্ন তুলতে পারত না, অথচ এটিই পরবর্তী সময়ে ঋণের ঝুঁকি ব্যবস্থাপনার প্রধান নিয়ামক হয়ে দাঁড়ায়। সেই সময়ের রাজকীয় ঋণ গ্রহণের এই প্রবণতা আমাদের দেশে সরকারি ঋণ গ্রহণ এবং বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের হরিলুটের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়।
ঐতিহাসিকভাবে এই রাজকীয় পৃষ্ঠপোষকতার কারণেই ব্যাংকিং প্রতিষ্ঠান অন্য দশটি মুনাফা অর্জনকারী ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের তুলনায় বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে উচ্চতর গুরুত্ব ও মর্যাদা ভোগ করে। এই মর্যাদার কারণেই ব্যাংকাররা সাধারণ মানুষের কাছে নির্ভরশীল ও বিশ্বস্ত বলে পরিচিত হয়ে আসছিল। উপরন্তু দেশের অর্থবাজারের অন্যতম অংশীদার হিসেবে জাতীয় অর্থনীতি ও জনগণের আর্থিক প্রয়োজনে ব্যাংকিং প্রতিষ্ঠান সব সময়ই জনগুরুত্বসম্পন্ন, স্পর্শকাতর ও অতিপ্রয়োজনীয় একটি প্রতিষ্ঠান। এই মর্যাদা ও ভাবমূর্তির কারণে মানুষ এই প্রতিষ্ঠানকে এখনো অগাধ বিশ্বাসে এবং ভিন্ন মর্যাদায় গ্রহণ করে। যদিও বর্তমান সময়ে বিবিধ অনিয়ম, বিচ্ছিন্ন কিছু দুর্ঘটনা ও জালিয়াতির কারণে ব্যাংকারদের ভাবমূর্তিতে কিছু ভাটা পড়েছে, তবু ব্যাংকিং খাত অবশ্যম্ভাবীরূপে এখনো অর্থনীতি ও সাধারণ মানুষের আর্থিক বা বাণিজ্যিক কার্যক্রমের মূল চালিকাশক্তি।
আজ থেকে চার বছর আগে (২০১৩) যখন সরকার ঘোষণা দিয়ে রাজনৈতিক বিবেচনায় কিংবা পৃষ্ঠপোষকতায় আরও নয়টি বাণিজ্যিক ব্যাংক স্থাপনের অনুমতি দেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু করে, তখন কেবল উদ্যোক্তা ও সরকার ছাড়া সব শ্রেণির বিশ্লেষক ও পর্যবেক্ষক মহল তার বিরোধিতা করেছিল। আমাদের সঙ্গে তুলনা করা যায় কিংবা এশিয়া মহাদেশের যেসব অর্থনীতির সঙ্গে আমাদের নিকট সম্পর্ক রয়েছে, সেসব দেশের উদাহরণ তুলে ধরে সরকারকে অর্থহীন এই সিদ্ধান্ত থেকে বিরত রাখার চেষ্টা করা হয়েছিল। এ কথা সচেতন মহলের প্রায় সবারই জানা আছে যে অর্থনীতির আয়তন, ব্যাংকের সংখ্যা বিচারে, এমনকি জনসংখ্যার বিবেচনায়ও ভারত, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া, এমনকি পাকিস্তানের মতো দেশেও জিডিপি অনুপাতে ব্যাংকের সংখ্যা বাংলাদেশের চেয়ে কম। সেই সময়ের সাবধানবাণী ও উদ্বেগ সত্য প্রমাণ করে দিয়েই জন্মের মাত্র দুই বছরের মাথায় নতুন ব্যাংকগুলোর সংকট ও দুর্বলতা প্রকাশ পেতে থাকে।
নানাবিধ বিতর্ক ও সমালোচনার মধ্যে নতুন ব্যাংকগুলোর সৃষ্টি বলে প্রথম থেকেই গ্রাহকের আস্থা অর্জনে ও ব্যবসা সম্প্রসারণে এসব ব্যাংককে অসুস্থ প্রতিযোগিতায় নামতে হয়। বেশি সুদে আমানত সংগ্রহ এবং অপেক্ষাকৃত কম সুদে ঋণ দিয়ে বাজারে জায়গা করে নিতে গিয়ে ব্যাংকগুলোর অবস্থান প্রথম থেকেই দুর্বল হয়ে পড়ে। একটা অপেক্ষাকৃত ছোট অর্থনীতিতে প্রয়োজনের অতিরিক্ত ব্যাংকের অস্তিত্ব ব্যাংকগুলোর ব্যবস্থাপনায় ঝুঁকির নতুন মাত্রা যোগ করে। বছরান্তে ব্যাংকগুলোর মুনাফাই যে নতুন ব্যাংক স্থাপনের পেছনের প্রধান প্রণোদনা ছিল, তা স্পষ্ট হয় নতুন ব্যাংকগুলোর আগ্রাসী তৎপরতায়। অথচ যখন নতুন ব্যাংক স্থাপন নিয়ে তোড়জোড় চলছে, সে সময় বিশ্লেষকেরা হিসাব করে দেখিয়ে দিয়েছিলেন, ৪০০ কোটি টাকার পরিশোধিত মূলধন, সাধারণ ঋণ সংস্থান, মূলধন সঞ্চিতির সংবিধিবদ্ধ পরিপালন, আয়কর, খেলাপি ঋণের বিপরীতে মন্দ ঋণ সংস্থান—সবকিছুর বায়না মিটিয়ে এসব ব্যাংক কখন মুনাফা ঘরে তুলতে পারবে, তার নিশ্চয়তা নেই। এ ছাড়া একটি বিষয়ে সবাই ভুলে যায় যে ব্যাংকিং ব্যবসা অন্যান্য শিল্প বা বাণিজ্যের চেয়ে সম্পূর্ণ ভিন্ন এবং কঠোর শৃঙ্খলায় আবদ্ধ। ব্যাংকিং কোম্পানি আইন, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বিধান ও সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের ত্রিমুখী নজরদারিতে পরিচালিত হয় ব্যাংকিং ব্যবসা। এই ব্যবসায় উদ্যোক্তার মূলধন অতি অল্পই ভূমিকা রাখে, সাধারণ মানুষের আমানতই হয় ব্যাংকের চলতি মূলধন। তাই আমানতকারীদের স্বার্থরক্ষায় নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোকে রাখতে হয় কঠোর নজরদারি, যা অন্যান্য বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের বেলায় প্রযোজ্য হয় না।
নতুন ব্যাংকগুলো চালু হওয়ার চার বছর পর যখন মুনাফা অর্জনের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে মাত্র, ঠিক সে সময় তাদের কোনো কোনোটির যে সার্বিক চিত্র দেখা যাচ্ছে, তাতে দেশের অর্থ খাতে নতুন আতঙ্কের আভাস পাওয়া যাচ্ছে। এই পরিস্থিতিকে সমগ্র ব্যাংকিং খাতের জন্য অশনিসংকেত বলে গণ্য করা যায়। সরকারের একজন মন্ত্রী যখন কোনো ব্যাংকের অবস্থাকে শিউরে ওঠার মতো বলে মন্তব্য করেন, সেটি যে কতটা মারাত্মক বার্তা বহন করে, তা কেবল ব্যাংক-সংশ্লিষ্ট মহলই জানে। আমানতকারীদের দায় পরিশোধের ক্ষমতা নেই এমন সংবাদ গণমাধ্যমে প্রকাশিত হলে একটি ব্যাংকের অস্তিত্ব নিয়ে যে সংশয় জাগে, তা কেবল ব্যাংকটির ওপর নয়, সমগ্র ব্যাংকিং খাতের ওপর মানুষের আস্থা টলিয়ে দিতে যথেষ্ট।
আরেকটি চমকে দেওয়ার মতো তথ্য হচ্ছে, নতুন ব্যাংকগুলোর মধ্যে একটিকে গত এক বছরে সাড়ে ১৮ কোটি টাকা জরিমানা দিতে হয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সংবিধিবদ্ধ নগদ জমা রাখার ব্যর্থতার জন্য। সাধারণ পাঠকদের অবগতির জন্য জানাই, আমানতকারীদের তাৎক্ষণিক প্রয়োজন মেটানোর জন্য বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকে একটা নির্দিষ্ট পরিমাণ তারল্য (নগদ বা দ্রুত নগদায়নযোগ্য অর্থ) রক্ষা করতে হয়। তার মধ্যে একটিকে বলা হয় নগদ সংরক্ষণ অনুপাত (ক্যাশ রিজার্ভ রেশিও—সিআরআর), যা নিশ্চিত করতে হয় ব্যাংকের মোট আমানতের ৬ দশমিক ৫ শতাংশ কেন্দ্রীয় ব্যাংকে নগদ জমা রাখার মাধ্যমে। উল্লেখ্য, কেন্দ্রীয় ব্যাংক মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে এই হার কমাতে বা বাড়াতে পারে।
অন্যটি হচ্ছে সংবিধিবদ্ধ তারল্য অনুপাত (স্ট্যাচুটরি লিকুইডিটি রেশিও—এসএলআর), যা রাখতে হয় ব্যাংকের সিন্দুকে নগদ কিংবা কোনো সরকারি বন্ডের আকারে, যার বর্তমান হার ব্যাংকের চলতি ও মেয়াদি আমানতের ১৩ শতাংশ হারে। এ দুই অনুপাতে তারল্য রক্ষা করতে ব্যর্থ হওয়ার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক আইনের বিধান অনুযায়ী নির্ধারিত হারে জরিমানা আরোপ করা যায়। এই জরিমানার হার সিআরআর ঘাটতির ওপর বর্তমান ব্যাংক হার ৫ শতাংশের সঙ্গে বাড়তি ৫ শতাংশ যোগ করে মোট ১০ শতাংশ হারে। অন্যদিকে এসএলআর রক্ষায় ব্যর্থতার জন্য জরিমানার হার নির্ধারণ করা হয় ঘাটতির ওপর বিশেষ রেপো হারে (বিদ্যমান রেপো হার যদি ৬ দশমিক ৫ শতাংশ হয়, তার সঙ্গে বাড়তি ৩ শতাংশ যোগ করে ৯ দশমিক ৫ শতাংশ)। এই হারে কোনো একটি ব্যাংকের জরিমানার পরিমাণ যদি এক বছরে সাড়ে ১৮ কোটি টাকা হয়, তাহলে সেই ব্যাংক কত দিন কী পরিমাণ তারল্য ঘাটতিতে ছিল, তার জন্য যে ঐকিক নিয়মে সুদকষার পাটিগণিত চর্চা করতে হবে—তার অবকাশ এখানে নেই।
এসব ব্যাংকের কোনোটির অনিয়ম কেবল তারল্য ঘাটতিতে সীমাবদ্ধ নেই, বিপুল পরিমাণ খেলাপি ঋণ, ঋণ জালিয়াতি, একক গ্রাহক ঋণসীমা লঙ্ঘন এবং লোকবল নিয়োগে অনিয়মের কথা বহুদিন আগেই গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। আবার কোনোটির পরিচালনা পর্ষদের মধ্যকার নজিরবিহীন সংঘাত, পরিচালক নিয়োগ এবং পর্ষদ সভায় উপস্থিতি নিয়ে কারচুপি, বেআইনি ঋণ অনুমোদনের খবরও বিভিন্ন সময়ে গণমাধ্যমের প্রধান খবর হিসেবে প্রকাশিত হয়েছে।
নতুন ব্যাংকগুলোর জন্মের চার বছরের মাথায় কয়েকটিতে নজিরবিহীনভাবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পর্যবেক্ষক নিয়োগের বিষয়টি এটাই দৃঢ়ভাবে প্রমাণ করে যে ব্যাংকগুলোকে অনুমোদন দেওয়ার আগে যে আশঙ্কা করা হয়েছিল, সেসব সত্য বলে প্রমাণিত হতে যাচ্ছে। এই পরিস্থিতিতে ব্যাংকগুলোর কোনো একটিও যদি টিকে থাকতে ব্যর্থ হয়, তাহলে সমগ্র ব্যাংকিং খাতে নেমে আসবে মারাত্মক বিপর্যয়, যা সামাল দেওয়ার মতো অভিজ্ঞতা আমাদের নেই। বর্তমানে কর্মরত কয়েক প্রজন্মের ব্যাংকারদের এমন অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হয়নি। তাই এই মুহূর্তে সর্বাগ্রে প্রয়োজন যেকোনো অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতি এড়ানোর জন্য অগ্নিনির্বাপণের মতো জরুরি ও পর্যাপ্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করা।
ফারুক মঈনউদ্দীন: লেখক ও ব্যাংকার৷