প্রথম আলোর (২৮ ফেব্রুয়ারি ২০২২) ‘ইসি গঠনে এবারও ছোট দলের “সাফল্য” এবং একই দিনের সমকাল-এর ‘ফের ছোট দলের বাজিমাত’ শিরোনামের দুটি প্রতিবেদন থেকে জানা যায়: সরকারি দল ঘেঁষা ‘সাইনবোর্ডসর্বস্ব হিসেবে পরিচিত ছোট রাজনৈতিক দলগুলো এবারও চমক দেখিয়েছে। রাজনীতি ও ভোটের মাঠে দৃশ্যমান না থাকা এসব দলের তালিকা থেকেই প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী হাবিবুল আউয়াল এবং অন্তত তিনজন নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ পেয়েছেন’ (সমকাল)। এ থেকে আশঙ্কা হয়, অনুসন্ধান কমিটির ১৫ কার্যদিবসের ‘অনুসন্ধান’ থেকে আবারও এমন একটি নির্বাচন কমিশন আমরা পেলাম, ২০১৭ সালের ‘পরীক্ষিত’ কৌশল অবলম্বন করে ক্ষমতাসীন দল যাঁদের নির্বাচন কমিশনে নিয়োগ নিশ্চিত করেছে। তাই এ যেন আবারও সেই খোকার বাপ!
প্রথম আলোর (৮ ফেব্রুয়ারি ২০২২) এক প্রতিবেদন থেকে জানতে পারি, ২০১৭ সালে নূরুল হুদা কমিশন গঠনের ক্ষেত্রে ক্ষমতাসীন দল একটি কৌশল অবলম্বন করে তাদের পূর্বনির্ধারিত চারজনকে—নূরুল হুদা, রফিকুল ইসলাম, কবিতা খানম ও ব্রিগেডিয়ার জেনারেল শাহদাত হোসেন চৌধুরী—নির্বাচন কমিশনে নিয়োগ দিতে পেরেছিল। ক্ষমতাসীন দলের কৌশলটি ছিল তাদের শরিক ও সমমনা দল দিয়ে এ চারজনের নাম বারবার প্রস্তাব করানো। আর অনুসন্ধান কমিটি যে নামগুলো বেশিবার প্রস্তাবিত হয়েছে, সেগুলো মহামান্য রাষ্ট্রপতির কাছে প্রেরিত তাদের সুপারিশে অন্তর্ভুক্ত করেছে এবং এভাবে সিইসিসহ ক্ষমতাসীন দলের পূর্বনির্ধারিত চারজনই নির্বাচন কমিশনে নিয়োগ পান। অনুসন্ধান কমিটির সুপারিশে ব্যক্তির যোগ্যতা-দক্ষতা ও সুনাম-দুর্নাম তেমন গুরুত্ব পেয়েছে বলে মনে হয় না। এগুলো গুরুত্ব পেলে নূরুল হুদার মতো ১৯৭৩ সালের বিশেষ ব্যাচের কর্মকর্তার—যিনি এক দিনও সচিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করেননি, যাঁর সম্পর্কে পক্ষপাতদুষ্ট আচরণের অনেক অভিযোগ ছিল এবং যিনি প্রধান বিরোধী দলের চরম বিরাগভাজন ও ক্ষমতাসীন দলের পরম আশীর্বাদপুষ্ট ছিলেন—সিইসি পদের জন্য সুপারিশ পাওয়া অসম্ভব হতো।
রাষ্ট্রপতির জারি করা প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে অস্বচ্ছ প্রক্রিয়ায় অতীতে যে দুটি নির্বাচন কমিটি গঠিত হয়েছে, তারা আমাদের নির্বাচনী ব্যবস্থাকে ধ্বংস করে দিয়েছে এবং ভোটাধিকার হরণ করেছে। তাদের অপকর্মের ফলে নির্বাচনপ্রক্রিয়া ও নির্বাচন কমিশনের ওপর জনগণের ব্যাপক আস্থাহীনতা সৃষ্টি হয়েছে। নতুন আইনের অধীন আবারও একই অস্বচ্ছ প্রক্রিয়ায় সেই পুরোনো কৌশল অবলম্বন করে আমাদের নতুন নির্বাচন কমিশন গঠিত হলো। গঠনপ্রক্রিয়ায় এ অস্বচ্ছতা ও প্রশ্নবিদ্ধতার কারণে নতুন কমিশনের ক্ষেত্রেও বিরাজমান আস্থার সংকট রয়েই গেল।
গত ১৩ ফেব্রুয়ারি অনুসন্ধান কমিটির সামনে ২০১৭ সালের এ অভিজ্ঞতার কথা তুলে ধরেছিলাম। আমার লিখিত বক্তব্যে ক্ষমতাসীন দলের কৌশলের কথাও উল্লেখ করেছিলাম। আমি বলেছিলাম, ‘নির্বাচন কমিশনে নিয়োগের ২০১৭ সালের অভিজ্ঞতা থেকে তিনটি বিষয় সুস্পষ্ট ও প্রণিধানযোগ্য: প্রথমত, নির্বাচন কমিশনে কাদের নিয়োগ দেওয়া হবে, ক্ষমতাসীন দল আগে থেকেই তা ঠিক করে রেখেছিল। দ্বিতীয়ত, ক্ষমতাসীন দল তাদের পছন্দের ব্যক্তিদের নাম রাষ্ট্রপতির কাছে পাঠানোর জন্য অনুসন্ধান কমিটির চূড়ান্ত তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করতে পেরেছিল। তৃতীয়ত, অনুসন্ধান কমিটি মনে হয় যেন সবচেয়ে যোগ্য ব্যক্তিদের সত্যিকারের অনুসন্ধানের মাধ্যমে খুঁজে বের করার পরিবর্তে ট্যালি করে সবচেয়ে বেশিবার প্রস্তাবিত নামই সুপারিশ করেছিল। ফলে, নূরুল হুদার মতো জয়েন্ট সেক্রেটারির অভিজ্ঞতাসম্পন্ন একজন অপেক্ষাকৃত অচেনা ব্যক্তির পক্ষে সিইসি হওয়া সম্ভব হয়েছে’ (‘অনুসন্ধান কমিটিকে যা বলে এলাম,’ প্রথম আলো, ১৪ ফেব্রুয়ারি ২০২২)।
যে কৌশল অবলম্বন করে ক্ষমতাসীন দল তাদের পূর্বনির্ধারিত ব্যক্তিদের নির্বাচন কমিশনে ২০১৭ সালে নিয়োগ দিতে পেরেছে, এবারও অনেকটা তারই পুনরাবৃত্তি ঘটেছে বলেই মনে হয়। ‘এবারও নির্বাচন কমিশনে (ইসি) নিয়োগ পাওয়া ব্যক্তিদের বেশির ভাগের নাম ছিল সরকারঘেঁষা ছোট কয়েকটি দলের তালিকায়। এর মধ্যে তরিকত ফেডারেশন, জাতীয় পার্টি (জেপি), গণতন্ত্রী পার্টি, বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল (বাসদ-বিএসডি), ন্যাশনাল পিপলস পার্টি (এনপিপি) ও বাংলাদেশ ন্যাশনালিস্ট ফ্রন্ট (বিএনএফ) অন্যতম। প্রথম চারটি দল আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন ১৪-দলীয় জোটের শরিক। বাকি দুটি দল সরকারঘেঁষা হিসেবে পরিচিত। এ ছয় দলের বাইরেও নবগঠিত ইসিতে নিয়োগ পাওয়া ব্যক্তিদের কারও না কারও নাম একাধিক দল বা ব্যক্তির প্রস্তাবে ছিল...১৪ দলের শরিক ও সরকারঘেঁষা দলগুলোর নেতারা বলেন, তাঁদের মনে হয়েছে যেসব নাম বেশি দলের তালিকায় এসেছে, সেগুলোই অনুসন্ধান কমিটিতে বেশি বিবেচিত হয়েছে। আগেরবারও এমনটাই হয়েছিল।’ তবে এবার ক্ষমতাসীন দলের কৌশলই ছিল মূলত ছোট দলগুলোকেই ‘কিংমেকার’ বানানো (‘ইসি গঠনে ছোট দলগুলো যেভাবে “কিংমেকার” হয়ে ওঠে,’ প্রথম আলো, ২ মার্চ ২০২২)।
অনুসন্ধান কমিটির সামনে প্রদত্ত বক্তব্যে আমি প্রশ্ন তুলেছিলাম, অনুসন্ধান কমিটি কি আসলেই ‘ডিউ ডিলিজেন্স’ প্রয়োগের মাধ্যমে অনুসন্ধান করে? বিচারাঙ্গনে বহুল ব্যবহৃত ডিউ ডিলিজেন্স কনসেপ্টের অর্থ হলো সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ সতর্কতা ও বিবেচনাশক্তি ব্যবহার করা, যা এমনকি সাধারণ মানুষও তাদের প্রাত্যহিক জীবনে ব্যবহার করে থাকে। উদাহরণস্বরূপ, অফিস-আদালতে চাকরিপ্রার্থীদেরও পরীক্ষা দেওয়া, সাক্ষাৎকার নেওয়া এবং রেফারেন্স চেক করা হয়। কিন্তু আমাদের নতুন নির্বাচন কমিশনার নিয়োগের ক্ষেত্রে কী ধরনের অনুসন্ধান করা হয়েছে এবং কতটুকু সতর্কতা ও সুবিবেচনাবোধ প্রয়োগ করা হয়েছে, তা নিয়ে অনেকের মনেই প্রশ্ন আছে। প্রসঙ্গত, গণমাধ্যমের প্রতিবেদন অনুযায়ী কমিটি তাদের দেওয়া ১৫ কার্যদিবসের তিন দিন আগেই অনুসন্ধান সম্পন্ন করেছে।
অনুসন্ধান কমিটির প্রথম বৈঠকের পর কমিটির এক সদস্য ইত্তেফাককে (৭ ফেব্রুয়ারি ২০২২) বলেন, গতবার সার্চ কমিটি যেভাবে কাজ করেছিল, এবারও সেভাবেই করবে। এর পরিপ্রেক্ষিতে অনুসন্ধান কমিটির সামনে প্রদত্ত বক্তব্যে আমি দাবি করেছিলাম, বিরাজমান আস্থার সংকট দূর করার জন্য কমিটি কী প্রক্রিয়ায় অনুসন্ধান করে, তা যেন জনগণকে অবহিত করে। একই সঙ্গে কমিটি যেন তার কার্যক্রমে স্বচ্ছতা প্রদর্শন করে।
উল্লেখ্য, প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও অন্যান্য নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ আইন, ২০২২-এর ৪(১) ধারায় অনুসন্ধান কমিটিকে ‘স্বচ্ছতা ও নিরপেক্ষতার নীতিমালা অনুসরণ’ করে ‘যোগ্যতা, অযোগ্যতা, অভিজ্ঞতা, সততা ও সুনাম বিবেচনা করিয়া প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও নির্বাচন কমিশনার পদে নিয়োগদানের জন্য রাষ্ট্রপতির নিকট সুপারিশ’ করার নির্দেশনা দেওয়া আছে। কিন্তু তা সত্ত্বেও কমিটি প্রস্তাবিত নামগুলো এবং তাদের প্রস্তাবকারীদের নাম প্রকাশ করেনি। তথ্য অধিকার আইনের অধীন একটি দরখাস্ত করেও আমি নামগুলো পাইনি। কমিটি যদি তাদের সংকুচিত তালিকার ২০ জনের এবং চূড়ান্ত তালিকার ১০ জনের নাম ও প্রস্তাবকারীর নাম প্রকাশ করত, তাহলে জনগণের প্রতিক্রিয়ার মাধ্যমেই নির্ণয় করা যেত কমিটির বিবেচনাধীন ব্যক্তিরা সৎ এবং সুনামের অধিকারী কি না। প্রসঙ্গত, জনশ্রুতিই সততা ও সুনামের একমাত্র মানদণ্ড। স্বচ্ছতার নীতি অনুসরণ করার আইনের সুস্পষ্ট নির্দেশনাকে কমিটি কেন যে উপেক্ষা করল, তা আমাদের বোধগম্য নয়। আমাদের আরও বোধগম্য নয় বিশিষ্টজনের সুপারিশ উপেক্ষা করে কেন সরকারের সুবিধাভোগীদের নাম অনুসন্ধান কমিটি রাষ্ট্রপতির কাছে সুপারিশ করল।
পরিশেষে, রাষ্ট্রপতির জারি করা প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে অস্বচ্ছ প্রক্রিয়ায় অতীতে যে দুটি নির্বাচন কমিটি গঠিত হয়েছে, তারা আমাদের নির্বাচনী ব্যবস্থাকে ধ্বংস করে দিয়েছে এবং ভোটাধিকার হরণ করেছে। তাদের অপকর্মের ফলে নির্বাচনপ্রক্রিয়া ও নির্বাচন কমিশনের ওপর জনগণের ব্যাপক আস্থাহীনতা সৃষ্টি হয়েছে। নতুন আইনের অধীন আবারও একই অস্বচ্ছ প্রক্রিয়ায় সেই পুরোনো কৌশল অবলম্বন করে আমাদের নতুন নির্বাচন কমিশন গঠিত হলো। গঠনপ্রক্রিয়ায় এ অস্বচ্ছতা ও প্রশ্নবিদ্ধতার কারণে নতুন কমিশনের ক্ষেত্রেও বিরাজমান আস্থার সংকট রয়েই গেল। নতুন কমিশনের কিছু সদস্যের সম্পর্কে এরই মধ্যে কিছু কিছু তথ্য উদ্ঘাটিত হচ্ছে, যাতে ভবিষ্যতের জন্য আশাবাদী হওয়া দুরূহ। আশা করি, নতুন কমিশন তাদের সততা, স্বচ্ছতা, সাহসিকতা ও নিরপেক্ষতার মাধ্যমে এ আশঙ্কা দূরীভূত করতে সক্ষম হবে।
বদিউল আলম মজুমদার সম্পাদক, সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন)