আরাকানের পরিস্থিতিকে বাংলাদেশের অনেকে একসময় মিয়ানমারের ‘অভ্যন্তরীণ বিষয়’ ভাবতেন। আসামের পরিস্থিতি সম্পর্কে হয়তো এখন একই কথা বলবেন তাঁরা। কিন্তু যাঁরা বর্তমান পেরিয়ে সামনে আরও কিছু দূর দেখতে চান, তাঁরা উদ্বিগ্ন হলে দোষ দেওয়া যায় না।
আসামে ‘বাংলাদেশ’-এর ফিরে আসা!
২৩ সেপ্টেম্বর আসামের দাররাং জেলায় এক উচ্ছেদ অভিযানে স্থানীয় দরিদ্র মুসলমানদের সঙ্গে পুলিশের সংঘাতের কথা ইতিমধ্যে আন্তর্জাতিক মহল জানে। এই সংঘাতে একজন মুসলমান নাগরিক মারা গেছেন। কিন্তু ঘটনাটি বিচ্ছিন্ন ও ‘সামান্য অধ্যায়’ হিসেবে ওখানেই শেষ হয়নি। দাররাং অভিযানের পর থেকে আসামে আবার বাংলাদেশবিরোধী প্রচারণা পুরোনো গতি পেয়েছে। সেখানকার ভূমিহীন দরিদ্র মুসলমানদের ‘বিদেশি’ তথা ‘অবৈধ বাংলাদেশি’ হিসেবে উল্লেখ করে শুরু হয়েছে পুরোনো ধাঁচের ঘৃণাবাদ কথাবার্তা। এর লক্ষ্য যদি হতো ২৩ তারিখের দমন-পীড়নের বৈধতা দেওয়া, সেটাও ভারতের অভ্যন্তরীণ বিষয় হিসেবে মানা যেত নিশ্চয়ই। কিন্তু আসামে ভূমির ‘অবৈধ’ দখলদারদের উচ্ছেদ অভিযানকে দ্রুত ‘অবৈধ বাংলাদেশিদের’ বিতাড়নপর্ব আকারে হাজির হতে দেখা যাচ্ছে সামাজিক মাধ্যমে, এমনকি মূলধারার প্রচারমাধ্যমেও।
যে দরিদ্রদের বুদ্ধিজীবী নেই, সংবাদমাধ্যমও নেই
সরেজমিন ঘুরে বেড়ানো মানুষ জানেন, ব্রহ্মপুত্রের ভাঙনের শিকার প্রচুর দরিদ্র মানুষ আশপাশের চর-চাপরির বিভিন্ন স্থানে বসতি করে আছে বহুকাল। কাকতালীয়ভাবে এরা মুসলমান এবং অনেকে বাঙালি মুসলমান। আসামের পরিচয়বাদী রাজনীতিতে এরা বহুকাল নিরীহ ‘টার্গেট’। এই দরিদ্রদের সেখানে বুদ্ধিজীবীও নেই, সংবাদমাধ্যমও নেই। এদের সম্পর্কে ‘ইচ্ছেমতো’ লেখা হয় বলা যায়। রাজনৈতিক বক্তৃতায় এদের কখনো ‘পাকিস্তানের এজেন্ট’, ‘কখনো ‘প্রতিবেশী দেশের বাসিন্দা’ বানানো হয়। এ রকম সিলমোহর থাকায় এসব মানুষকে সামাজিকভাবে দ্বিতীয় ও তৃতীয় শ্রেণির নাগরিক করায় বিবিধ সুবিধা আছে। কম মজুরিতে খাটানো যায়। এসব প্রচারণা এড়িয়ে কোনোভাবে জীবন ধারণ করে যেতে স্থানীয় এই বাংলাভাষীদের অধিকাংশ ইতিমধ্যে মাতৃভাষায় শিক্ষাদীক্ষার অধিকার ছেড়ে দিয়েছে। জমি ও কৃষি ছাড়া তাদের জীবনধারণের বিকল্প কম। তারপরও জাতিবাদের হাত থেকে রেহাই মেলেনি তাদের।
ব্রহ্মপুত্রের ভাঙনের শিকার প্রচুর দরিদ্র মানুষ আশপাশের চর-চাপরির বিভিন্ন স্থানে বসতি করে আছে বহুকাল। কাকতালীয়ভাবে এরা মুসলমান এবং অনেকে বাঙালি মুসলমান। আসামের পরিচয়বাদী রাজনীতিতে এরা বহুকাল নিরীহ ‘টার্গেট’। এই দরিদ্রদের সেখানে বুদ্ধিজীবীও নেই, সংবাদমাধ্যমও নেই।
অসমিয়াদের একাংশ বহুকাল এই মুসলমানদের তাড়ানোর দাবি তুলে রাজনীতি করেছে। বিজেপি অসমিয়াদের প্রিয়পাত্র হতে সেই দাবির পক্ষে। চলতি উচ্ছেদ অভিযানকে রাজ্যের বিজেপি সরকার বলছে ‘ভূমি উদ্ধার অভিযান’। সর্বশেষ অভিযানে প্রায় ২৫ হাজার একর ভূমি থেকে ‘অবৈধ দখলদার’ উচ্ছেদ হবে। সেই অভিযানে নিহত মাইনুল হকের মৃতদেহের ওপর উল্লাস করে লাফানোর দৃশ্য ইতিমধ্যে ফেসবুক-টুইটারে ভাইরাল হয়েছে, যা থেকে মনে হতে পারে সমস্যাটি কেবল জমি নয়। ঘৃণার বিস্তারও আছে এতে। মাইনুল হক এই অর্থে একটি বিপদে পড়া সম্প্রদায়ের প্রতীক হয়ে আলোচনায় এলেন। জমি উদ্ধার প্রকল্পের আগে আসামে মুসলমানদের জন্মনিয়ন্ত্রণের জরুরি উদ্যোগের প্রশাসনিক আয়োজনও ছিল চোখে পড়ার মতো। এই সম্প্রদায়ের দারিদ্র্য নিয়ে এ রকম আগ্রহ দেখায় না কেউ।
‘বাংলাদেশি’ ভীতি ছড়ানোর নতুন তরঙ্গ
চলতি আসামে কীভাবে বাংলাদেশবিরোধী প্রচার নতুন গতি পেল, তার কেবল একটি নজির হিসেবে স্থানীয় জনপ্রিয় সংবাদমাধ্যম দ্য সেনটিনেল-এর ২৯ সেপ্টেম্বরের সম্পাদকীয় পড়া যেতে পারে। ‘এ কোয়েশ্চেন অব ল্যান্ড’ শিরোনামে সম্পাদকীয়তে দাবি হচ্ছে, আসামকে বহুকাল মুসলমানপ্রধান রাজ্য করার জন্য প্রথমে পূর্ব বাংলা এবং পরে আজকের বাংলাদেশ থেকে বড় আকারে নীরব আগ্রাসন চলছে। এতে আসামের জনমিতি পাল্টাচ্ছে। রাজ্যের বনাঞ্চল, প্রাকৃতিক সম্পদ বেদখল হচ্ছে। অনেক স্থানে অসমিয়ারা সংখ্যালঘু হয়ে পড়ছে। এমনকি তাদের মেয়েরাও ওই ‘বিদেশি’ কৃষিজীবী বাঙালিদের থেকে নিরাপদ নয়।
এ রকম ভাষ্যে অনিবার্যভাবে অবৈধ দখলদারদের উচ্ছেদ করতে নামা রাজ্য সরকারের ‘মা-মাটি-বেটি’ রক্ষার কর্মসূচির পক্ষে সমর্থন তৈরি হয়। বোঝা যাচ্ছে, বহুকালের ভূমিজ সন্তান হয়েও আসামে বাঙালি সমাজ স্থানীয় ‘মাটি’র প্রতিপক্ষ চিহ্নিত হয়ে আছে। যে প্রতিপক্ষ ‘অবৈধ’, তার জমিকেন্দ্রিক বেঁচে থাকার সংগ্রাম বৈধ হবে কীভাবে! ফলে দ্রুত অসমিয়া ছাত্রসংগঠনগুলো সরকারের সেপ্টেম্বর অভিযানে সমর্থন জানিয়েছে। দাররাংয়ে ‘আত্মরক্ষার্থে গুলি’ অসমিয়া ‘সিভিল সমাজ’কে আহত করেছে এমন কোনো প্রবল নজিরও নেই। অথচ দুবছর আগেও অসমিয়া তরুণেরা বিজেপি সরকারের বিরুদ্ধে রক্তাক্ত আন্দোলন করেছেন নাগরিকত্ব আইনের সংশোধন বিষয়ে। কিন্তু দরিদ্র মুসলমান ‘চরুয়াদের’ ইস্যু আসামের রাজনৈতিক এলিটদের আবার এক কাতারে আনল।
বুদ্ধিদীপ্ত রাজ্য সরকার পরিস্থিতির সুযোগ নিতে দেরি করছে না। ২৩ সেপ্টেম্বর যারা মারা পড়েছে, আহত হয়েছে, উচ্ছেদ হয়েছে ফৌজদারি মামলাও দায়ের হয়েছে তাদের বিরুদ্ধে। বলা বাহুল্য, উপরিউক্ত চিত্রের সবটুকু অনায়াসে আসামের অভ্যন্তরীণ বিষয় হিসেবে দেখা যায়। যেভাবে ১৯৮৩-এর নেলি গণহত্যা আসামের নিজস্ব বিষয় হিসেবে ধরে নেওয়া হয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশকে কেন আসামের জাতিবাদে টেনে আনা হয়, সে প্রশ্ন থেকেই যায়। অর্থনৈতিক উন্নয়নে আসামের চেয়ে বাংলাদেশ বহুদূর এগিয়ে আছে। বাংলাদেশ থেকে রুটিরুজি খুঁজতে কোনো মানুষের যে আসামে যাওয়ার দরকার নেই, এ সত্যটা আড়াল করে আসামে নিরন্তর উল্টো গল্প কেন বাজারজাত হচ্ছে, সেটা অবশ্যই উদ্বেগের বিষয়।
মিথ্যা প্রচারে তথ্যভিত্তিক জবাব যে কারণে প্রয়োজন
দুনিয়ার সব বাংলাভাষী এ প্রবাদ জানে, ‘ঘরপোড়া গরু সিঁদুরে মেঘ দেখলে ভয় পায়’। আসামের ঘটনাবলিতে বাংলাদেশের অনুভূতি ও রকম হওয়া বিচিত্র নয়। আরাকানে মিয়ানমার সরকার রোহিঙ্গা মুসলমানদের অবৈধ বলতে বলতে একসময় ‘বাংলাদেশি’ বলা শুরু করে। সেখানেও দরিদ্র এবং অতি প্রান্তিক রোহিঙ্গাদের পক্ষে প্রচারমাধ্যম ছিল না। ছিল না জাতীয় কোনো বুদ্ধিজীবী। আজও নেই। ফলে রোহিঙ্গাদের কয়েক দশক ‘বাংলাদেশি’ হিসেবে প্রচারের পর দেশে-বিদেশে অন্তত আংশিক ‘সত্য’ হিসেবে ভালোভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায় সেটা। কিছুটা হলেও বিভ্রম তৈরি করা গেছে। অথচ মিয়ানমারের জাতির পিতা জেনারেল অং সানের রাজনৈতিক সহযোগীদের মধ্যে একাধিক ছিলেন রোহিঙ্গা মুসলমান।
আসামেও কয়েক দশক বাংলাভাষী স্থানীয় দরিদ্র মুসলমানদের ‘বাংলাদেশি’ হিসেবে তুমুল প্রচারণার পর আন্তর্জাতিক প্রচারমাধ্যম ইতিমধ্যে কিছুটা ভ্রান্তিতে পড়েছে। ব্রহ্মপুত্র উপত্যকার শত শত বছরের ইতিহাসে কৃষিজীবী বাংলাভাষীদের উপস্থিতির দিকে কেউ আর তাকাতে চাইছে না। পাশাপাশি ভারতীয় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে মুসলমানবিরোধী ঘৃণার ব্যাপক চর্চায় দরিদ্র এই বাঙালিরা এ মুহূর্তে বেশ হতবিহ্বল ও অসহায় অবস্থায় আছে। রাজ্যের জনমিতি ঠিক রাখতে উচ্ছেদ হতে হতে এরা কোথা থেকে কোথায় যাবে, সেটা বড় এক দুর্ভাবনার ব্যাপার। এরা ‘অবৈধ’ এটা প্রমাণ করতে গিয়ে সেখানে এনআরসি হয়েছিল। তাতেও চরাঞ্চলের এই গরিবদের সামান্যই অবৈধ প্রমাণিত হয়েছে। সম্প্রতি নিহত মাইনুল হকেরও সেখানে পরিচয়পত্র ছিল। মাইনুল হকের মতো বেঁচে থাকারাও মিছিল-মিটিংয়ে পরিচয়পত্র দেখায়। কিন্তু তাতে থামছে না তাদের ‘বাংলাদেশি’ উল্লেখের অভ্যাস।
এনআরসির মাধ্যমে নাগরিকত্ব স্বীকৃত গরিব মানুষের সামাজিক নিরাপত্তা ও পুনর্বাসন প্রশাসনের দায়িত্ব হলেও যেহেতু তারা বাংলাভাষী, সেহেতু তাদের কপাল মন্দ। করোনা মহামারির প্রথম দিকে এদের ‘ভাইরাসবাহক’ হিসেবে চিহ্নিত করারও প্রয়াস ছিল। এসব বেশ চেনা চেনা সামাজিক লক্ষণ, যার ভবিষ্যৎ অনুমান করলে ভয় পেতে হয়।
ফলে বাংলাদেশ-আসাম সীমান্তের বৃহত্তর রংপুর এবং বৃহত্তর সিলেটে বাড়তি সতর্কতা দরকার এখনই। পাশাপাশি আসামে বাংলাদেশকে উল্লেখ করে ছড়ানো যেকোনো মিথ্যা প্রচারে তথ্যভিত্তিক জবাব দেওয়া প্রয়োজন। এ বিষয়ে বিলম্ব এবং উদাসীনতা বিপদ তৈরি করতে পারে।
● আলতাফ পারভেজ দক্ষিণ এশিয়ার ইতিহাস বিষয়ে গবেষক