১৫ নভেম্বর ‘রিজিওনাল কম্প্রিহেনসিভ ইকোনমিক পার্টনারশিপ’ (আরসিইপি) নামে এক নতুন আঞ্চলিক চুক্তি স্বাক্ষরিত হওয়ার পর সারা বিশ্বে মিশ্র প্রতিক্রিয়া লক্ষ করা যাচ্ছে। এই চুক্তিকে একাধারে বিশ্বের বৃহত্তম বাণিজ্যিক জোট এবং বিশ্বের বৃহত্তম মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি (এফটিএ) হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে। ২০১২ সাল থেকে এটি নিয়ে আলাপ–আলোচনা চলেছে। এই চুক্তির সদস্য এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের ১৫টি দেশ। এর মধ্যে রয়েছে অস্ট্রেলিয়া, চীন, জাপান, নিউজিল্যান্ড, দক্ষিণ কোরিয়া এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশীয় সংস্থার (আসিয়ান) ১০ সদস্য—ব্রুনেই, কম্বোডিয়া, ইন্দোনেশিয়া, লাও পিডিআর, মালয়েশিয়া, মিয়ানমার, ফিলিপাইন, সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ড ও ভিয়েতনাম। এই দেশগুলো বিশ্বের মোট দেশজ উৎপাদনের প্রায় ৩০ শতাংশ এবং বিশ্বের জনসংখ্যার প্রায় এক-তৃতীয়াংশ দখল করে আছে।
চুক্তিটি ভূ-অর্থনৈতিক-রাজনৈতিক দিক থেকে অনেক গুরুত্বপূর্ণ
কোভিড-১৯ অতিমারির কারণে সারা বিশ্বের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড ও বাণিজ্য সংকুচিত হয়েছে। এ কারণে বিশ্ব অর্থনীতি এখন অভূতপূর্ব চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি। এই পরিপ্রেক্ষিতে আরসিইপি চুক্তিটি এর সদস্যদেশগুলোর জন্য আশাব্যঞ্জক। তবে এই বাণিজ্য চুক্তিকে নতুন বিশ্বব্যবস্থার দিকে যাওয়ার একটি পদক্ষেপ বলে মনে করা হচ্ছে, যেখানে এশীয় অঞ্চলের আধিপত্য থাকবে।
আরসিইপি চুক্তিতে স্বাক্ষরের সময়টি অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। বর্তমানে পৃথিবী করোনাভাইরাস অতিমারির কারণে বিপর্যস্ত। অন্যদিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ৩ নভেম্বর অনুষ্ঠিত প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ডোনাল্ড ট্রাম্প পরাজয় মেনে নিতে অস্বীকার করার পর থেকে বিশ্বের অন্যতম পরাক্রমশালী এই দেশ রাজনৈতিক সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। দুঃখজনকভাবে, অতিমারি এবং এর থেকে সৃষ্ট অর্থনৈতিক সংকট মোকাবিলা—উভয় ক্ষেত্রেই যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বকে নেতৃত্ব দেখাতে ব্যর্থ হয়েছে।
সুতরাং আরসিইপিকে এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে চীনের প্রভাব শক্তিশালী হওয়ার একটি উপায় মনে করা হচ্ছে। কেননা, এই অঞ্চলে অনুরূপ বাণিজ্য চুক্তিতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র অনুপস্থিত। সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা ‘কম্প্রিহেনসিভ অ্যান্ড প্রগ্রেসিভ অ্যাগ্রিমেন্ট ফর ট্রান্স-প্যাসিফিক পার্টনারশিপ (সিপিটিপিপি)’ নামক চুক্তি স্বাক্ষর করেছিলেন। ট্রাম্প প্রশাসন ২০১৭ সালের জানুয়ারি মাসে ওই চুক্তি থেকে সরে এসেছিল। সিপিটিপিপির ১২টি দেশ হলো অস্ট্রেলিয়া, ব্রুনেই, কানাডা, চিলি, জাপান, মালয়েশিয়া, মেক্সিকো, নিউজিল্যান্ড, পেরু, সিঙ্গাপুর, ভিয়েতনাম ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। দুটি চুক্তিতেই অস্ট্রেলিয়া, জাপান, মালয়েশিয়া, নিউজিল্যান্ড, সিঙ্গাপুর ও ভিয়েতনাম—এ ছয়টি দেশ রয়েছে। তাই এ অঞ্চলে চীনের নেতৃত্বের পাশাপাশি টিপিপি একটি ভারসাম্য হিসেবে কাজ করতে পারে। শুরুর দিকে ভারত এই চুক্তির আলোচনায় থাকলেও ২০১৯ সালের নভেম্বরে ভারত এই চুক্তি থেকে নিজেকে সরিয়ে নেয় তার দেশীয় শিল্প রক্ষার যুক্তিতে। এর ফলে চীন ১৪টি আরসিইপিভুক্ত দেশে তার মূল্য শৃঙ্খল বা ভ্যালু চেইন সংহতকরণের মাধ্যমে আরও প্রভাবশালী হয়ে ওঠার সুযোগ পাবে।
বাংলাদেশে তাৎক্ষণিক প্রভাব কম
আরসিইপিভুক্ত দেশগুলোয় বাংলাদেশের রপ্তানির ধরন থেকে ধারণা করা যায়, বাংলাদেশের এ মুহূর্তে খুব চিন্তিত হওয়ার পরিস্থিতি হবে না। অস্ট্রেলিয়া, চীন, জাপান, নিউজিল্যান্ড, দক্ষিণ কোরিয়া, থাইল্যান্ডসহ বেশ কয়েকটি আরসিইপিভুক্ত দেশে বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশ (এলডিসি) হিসেবে বিভিন্ন ধরনের অগ্রাধিকারভিত্তিক সুবিধা পেয়ে থাকে। বর্তমানে আরসিইপি অঞ্চলে বাংলাদেশের মোট রপ্তানির ৮০ শতাংশের বেশি যায় ওই দেশগুলোয়।
আরেকটি বিষয় হলো, এ ধরনের বহুপক্ষীয় বাণিজ্য চুক্তি থেকে সুবিধা আদায় করতে অনেক লম্বা সময় লেগে যায়। বস্তুত, আরসিইপিভুক্ত দেশগুলোয় ৯০ শতাংশ শুল্ক হ্রাস করা হবে দুই দশক ধরে। তা ছাড়া কমপক্ষে ছয়টি আসিয়ানভুক্ত দেশ এবং তিনটি আসিয়ানবহির্ভূত দেশকে এ চুক্তি অনুমোদন করতে হবে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অনুমোদনের এ প্রক্রিয়া শেষ হতে ২০২১ সালের পুরোটাই লেগে যাবে। সুতরাং বাংলাদেশ তার কৌশল ঠিক করার জন্য কিছুটা সময় পাবে।
তবে বাংলাদেশের যথেষ্ট চিন্তার কারণ আছে
কম্বোডিয়া, লাওস ও মিয়ানমারের মতো তিনটি স্বল্পোন্নত দেশ এই চুক্তির সদস্য। এর মধ্যে লাওস ও মিয়ানমার উভয়ই বাংলাদেশের সঙ্গে ২০১৮ সালে স্বল্পোন্নত দেশ থেকে বের হয়ে যাওয়ার যোগ্যতা অর্জন করেছে। তারা ২০২৪ সালে উন্নয়নশীল দেশে পরিণত হওয়ার অপেক্ষায় রয়েছে। নতুন এই বাণিজ্য চুক্তির অংশীদার হওয়ার মাধ্যমে স্বল্পোন্নত এই দেশগুলো উন্নয়নশীল দেশে পরিণত হওয়ার পরও অগ্রাধিকারমূলক বাজার সুবিধা ভোগ করতে থাকবে, যেটি বাংলাদেশ পাবে না। উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণ ঘটার পর বাড়তি তিন বছর, অর্থাৎ ২০২৭ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশের প্রাপ্য সুবিধাগুলো ভোগ করতে পারবে। কিন্তু তারপর আর সেই সুযোগ পাবে না। সুতরাং এ ধরনের বহুপক্ষীয় চুক্তির বাইরে থাকলে মধ্যম ও দীর্ঘ মেয়াদে বাংলাদেশের রপ্তানি ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় উদ্বেগের কারণ হচ্ছে ভিয়েতনামের বাজারের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করা। অনেক চ্যালেঞ্জ থাকা সত্ত্বেও তৈরি পোশাক রপ্তানির ক্ষেত্রে বাংলাদেশ বিশ্ববাজারে তার অবস্থান ধরে রাখতে সক্ষম হয়েছে। যদিও ইউরোপের বাজারে বাংলাদেশ শুল্কমুক্ত–কোটামুক্ত প্রবেশাধিকারের সুযোগ পাচ্ছে, কিন্তু উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণ ঘটলে বাংলাদেশের জন্য এই সুযোগ আর থাকবে না। অথচ ভিয়েতনাম ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি স্বাক্ষর করেছে। এর ফলে ভিয়েতনাম ইউরোপের বাজারে অগ্রাধিকারমূলক সুবিধা পাবে। ভিয়েতনাম মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন টিপিপিরও সদস্য, যদিও ওই চুক্তিটি এখন স্থগিত রয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে যেহেতু সরকার পরিবর্তন ঘটতে যাচ্ছে, নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন টিপিপি চুক্তিতে ফিরে আসতে পারেন। সুতরাং আরসিইপি, ইইউ এবং টিপিপির সঙ্গে সংযুক্ত থাকার ফলে ভিয়েতনামের অগ্রাধিকারমূলক বাজার সুবিধার আওতা অনেক বেশি। তাই বাংলাদেশ এর ফলে প্রচণ্ড প্রতিযোগিতার মধ্যে পড়বে।
এই চুক্তিগুলোয় অংশগ্রহণ করতে হলে বাংলাদেশকে বিভিন্ন নীতিমালার এবং অর্থনৈতিক সংস্কার করতে হবে। একটি কঠিন বাণিজ্য ব্যবস্থায় প্রতিযোগিতা করার জন্য দক্ষতা বাড়াতে হবে। এ ধরনের প্রস্তুতি স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে উন্নয়নশীল দেশে মসৃণ ও টেকসইভাবে উত্তরণ ঘটানোর জন্যও সহায়ক হবে।
নতুন এই বাণিজ্য চুক্তি বাংলাদেশকে অন্যান্য উপায়েও চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন করতে পারে। এ ধরনের মেগা বাণিজ্য চুক্তি কেবল বাণিজ্যের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে না; এটি বিনিয়োগের সুযোগ সৃষ্টি করে, সরবরাহ শৃঙ্খল শক্তিশালী করে। তা ছাড়া আরসিইপিভুক্ত দেশগুলোয় ‘রুলস অব অরিজিনের’ ব্যাপারে অনেক ছাড় দেওয়া হবে। সহজ কথায় বলতে গেলে ‘রুলস অব অরিজিন’ হচ্ছে একটি পণ্য, যে দেশে উৎপাদিত হচ্ছে, পণ্যটিতে সে দেশের নিজস্ব অংশ কতখানি আর কতখানি আমদানি করে আনা হয়েছে।
আরসিইপি সদস্যরা অনেক নমনীয় ‘রুলস অব অরিজিনের’ মাধ্যমে পণ্যের ওপর অগ্রাধিকারমূলক শুল্ক সুবিধা পাবে। এটিও আরসিইপির সদস্যদেশগুলোর মধ্যে বিনিয়োগ আকৃষ্ট করবে এবং অগ্রাধিকারমূলক বাণিজ্যের মাধ্যমে সদস্যদের রপ্তানি বাড়িয়ে দেবে। তাদের কাছে বাংলাদেশ বা অন্য আরসিইপিবহির্ভূত দেশ বিনিয়োগের জন্য আকর্ষণীয় গন্তব্যস্থল হবে না।
নতুন বাস্তবতায় বাংলাদেশের প্রস্তুতি
যেহেতু বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার (ডব্লিউটিও) দোহা রাউন্ড বাণিজ্য আলোচনা এখনো অচলাবস্থার মধ্যে রয়েছে, তাই ডব্লিউটিওর সদস্যদেশগুলো মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি এবং আঞ্চলিক বাণিজ্য চুক্তিতে আগ্রহী হচ্ছে। আরসিইপি এবং অন্যান্য আঞ্চলিক বাণিজ্য চুক্তির কারণে বাংলাদেশের যে ক্ষতি হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে, তা মুক্ত বাণিজ্য চুক্তিগুলোয় সক্রিয় অংশগ্রহণের মাধ্যমে অনেকটা হ্রাস করা যাবে। বিমসটেকসহ একাধিক মুক্ত বাণিজ্য সংস্থার সদস্য হিসেবে বাংলাদেশ আঞ্চলিক বাণিজ্য সংহতকরণ থেকে সুবিধা পাওয়ার জন্য কার্যকর পদক্ষেপ নিতে পারে।
আরসিইপির মাধ্যমে প্রতিযোগী দেশগুলোর কাছে রপ্তানি বাজার হারানোর আশঙ্কা থেকে বলা হচ্ছে যে বাংলাদেশের এই চুক্তিতে যোগ দেওয়া উচিত। তবে এর পূর্বশর্ত হিসেবে বাংলাদেশের প্রস্তুতি নিতে হবে। নীতিনির্ধারকদের দর-কষাকষির সক্ষমতা বাড়াতে হবে। তা ছাড়া বিনিয়োগ ও রাজস্ব ক্ষেত্রে এই চুক্তির প্রভাব কেমন হবে, সে বিষয়ে বিশদ মূল্যায়নেরও প্রয়োজন।
এর পেছনে কয়েকটি কারণ রয়েছে। প্রথমত, আরসিইপি একটি পারস্পরিক চুক্তি। এর অর্থ হচ্ছে আরসিইপিভুক্ত সব দেশকে একে অপরের বাজারে অগ্রাধিকারমূলকভাবে ঢোকার সুবিধা দিতে হবে। বাংলাদেশের জন্য ইউরোপীয় ইউনিয়নের বেলায় এটি প্রযোজ্য নয়। সুতরাং আরসিইপির মতো চুক্তিতে প্রয়োগ দেওয়ার আগে দেশীয় বাজারের ওপর তার প্রভাব সঠিকভাবে বুঝতে হবে।
দ্বিতীয়ত, এই চুক্তিতে বাণিজ্য ও বিনিয়োগের জন্য উন্নত মানের কার্যক্রম ও সেবার প্রয়োজন হবে। এই চুক্তিতে মেধাস্বত্ব অধিকার, ই-কমার্স, টেলিযোগাযোগ এবং আর্থিক ও পেশাজীবী সেবার বিষয়গুলোও অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এই চুক্তিগুলোয় অংশগ্রহণ করতে হলে বাংলাদেশকে বিভিন্ন নীতিমালার এবং অর্থনৈতিক সংস্কার করতে হবে। একটি কঠিন বাণিজ্য ব্যবস্থায় প্রতিযোগিতা করার জন্য দক্ষতা বাড়াতে হবে। এ ধরনের প্রস্তুতি স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে উন্নয়নশীল দেশে মসৃণ ও টেকসইভাবে উত্তরণ ঘটানোর জন্যও সহায়ক হবে।
ড. ফাহমিদা খাতুন সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) নির্বাহী পরিচালক। মতামত লেখকের নিজস্ব।