২৬তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর আয়োজন দেখতে ক্লিক করুন
মূল সাইট দেখতে ক্লিক করুন

ধারাবাহিকতা আছে, বৈষম্য কমানোর নির্দেশনা নেই

.
.

২০১৫-১৬ অর্থবছরের বাজেটে চলমানতা বজায় রয়েছে। ২০০৮ সালের পর থেকে দীর্ঘদিন একই রাজনৈতিক জোট ক্ষমতায় রয়েছে। রাজনৈতিক চলমানতার সঙ্গে সঙ্গে অর্থনৈতিক ধারাবাহিকতাও দৃশ্যমান। অর্থনৈতিক নীতি ও অগ্রাধিকারের ক্ষেত্রে তেমন বড় কোনো দিক পরিবর্তন ঘটেনি। গত কয়েক বছরের বাজেটগুলোকে পাশাপাশি রেখে পর্যালোচনা করলে সামঞ্জস্য ও ধারাবাহিকতা সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে। এবারের বাজেটও ব্যতিক্রম নয়। নতুন পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার পরিপ্রেক্ষিতে বাজেটে নতুন ধারা সৃষ্টির কথা কেউ কেউ বলছিলেন। তাঁদের মনে রাখতে হবে, পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনাও একই ধারাবাহিকতায় প্রণীত। এখানে স্বপ্ন আছে, বিস্তৃতির প্রক্ষেপণ আছে, বৈচিত্র্যায়ণের সুযোগও রয়েছে। কিন্তু নৈতিক বাঁক পরিবর্তনের সুযোগ নেই। এ রকম দুর্লভ ধারাবাহিক চলমানতায় অর্জন কতটা হয়েছে, সে বিষয়ে মাননীয় অর্থমন্ত্রী বাজেট বক্তৃতায় কিছুটা উল্লেখ করেছেন। অর্জনটা আরও অধিক হতে পারত কি না, সে প্রশ্ন থাকতেই পারে।
এবারের বাজেটে করপোরেট করের হার কিছুটা কমেছে। এটি ব্যবসাবান্ধব। বাংলাদেশে এই হার সর্বোচ্চ ৪৫ শতাংশ পর্যন্ত ছিল। এটি অবাস্তব ও নিপীড়নমূলক। করপোরেট বিনিয়োগে প্রতিবন্ধকও বটে। ব্যাংক-বিমা কোম্পানির করের হার ৪২.৫০ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৪০ শতাংশ করা হয়েছে, যা উচ্চহার হিসেবেই বিবেচিত। মুনাফা ঠিক রেখে উচ্চহারে কর প্রদানের ফলে ব্যাংকের সুদের উচ্চহার বজায় রয়েছে। করের হার কমিয়ে সুদের হার কমানোর চাপ প্রয়োগ করা উচিত। উল্লেখ্য, ভারত অর্থনৈতিক উল্লম্ফনের জন্য বিনিয়োগ আকর্ষণের কৌশল হিসেবে আগামী চার বছরের মধ্যে করপোরেট করের হার ২৫ শতাংশে কমিয়ে আনার পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে। এ ধরনের কৌশল বাংলাদেশেও সুফল আনবে। নীতি পর্যায়ের একটি ঘোষণা এ বাজেট অধিবেশনেই প্রদান করা হোক। প্রস্তাব রাখছি, আগামী পাঁচ বছরে করপোরেট করের হার সর্বোচ্চ ৩০ শতাংশ এবং সর্বনিম্ন ২৫ শতাংশে নামিয়ে আনার নীতি ঘোষণা দেওয়া হোক। এর ফলে বিনিয়োগ সচল হয়ে উঠবে।
অবশ্য বাজেটে পুঁজিবাজারভুক্ত কোম্পানিগুলোর করের হার ২৭ দশমিক ৫০ শতাংশ থেকে ২৫ শতাংশে নামিয়ে আনা হয়েছে। এটি অনুপ্রেরণামূলক হলেও পুঁজিবাজারের বিবিধ কারণে গড়ে ওঠা অনাস্থা দূর হবে না। ইমেজ-সংকট কাটাতে হলে আরও কিছু দৃশ্যমান সংস্কার করতে হবে।
ব্যক্তি পর্যায়ে আড়াই লাখ টাকা পর্যন্ত আয়করমুক্ত রাখা হয়েছে। এটি করদাতাবান্ধব সিদ্ধান্ত। তবে করজাল সম্প্রসারণের জন্য উপজেলা পর্যায়ে আয়কর অফিস স্থাপনের বিষয়টি কস্ট বেনিফিট বিবেচনায় সন্তোষজনক হবে না। উচ্চ আয়ের জনগোষ্ঠী কয়েকটি নগর অঞ্চলে বাস করে। গ্রামে তাদের বাড়ি থাকলেও তারা শহুরে করদাতা। পল্লি এলাকায় কিছু মার্জিনাল করদাতাসহ মধ্য আয়ের স্বল্পসংখ্যক মানুষ রয়েছে। প্রভাবশালী ব্যক্তিদের কর আদায়ে কর কর্মকর্তাদের সাফল্য নেই। ফলে সংস্থাপন ব্যয় ওঠানোর জন্য দুর্বল মার্জিনাল করদাতাদের ওপর চাপ পড়তে পারে। উপজেলা পর্যায়ে স্বনির্ধারণী পদ্ধতিতে প্রদত্ত আয়কর ফাইনাল সেটেলমেন্ট হিসেবে গ্রহণের মাধ্যমে আস্থা অর্জন করা প্রয়োজন। ভীতি সৃষ্টি না করে জনবান্ধব কৃষ্টি গড়ে তোলার জন্য উপজেলা পর্যায়ের কর্মকর্তাদের বিশেষ প্রশিক্ষণ ও নির্দেশ দেওয়ার প্রয়োজন হবে।

বৈষম্য দূরীকরণের বিষয়টি বাজেটে যথাযথ দৃশ্যমান হয়নি। ৭ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হলে সম্পদ চুইয়ে পড়বে, এমন ধারণা অমূলক। বিশ্বব্যাংকের এই পুরোনো ধারণা এখন অচল

এবারের বাজেটের সবচেয়ে দুর্বল দিক হচ্ছে স্ফীত আয় খাত। রাজস্ব বোর্ড কর্তৃক আদায়যোগ্য কর ধরা হয়েছে ১.৭৬ লাখ কোটি টাকা। পূর্ববর্তী বছরের বাজেটে এই খাতে আয় ধরা হয়েছিল ১.৫০ লাখ কোটি টাকা, যা সংশোধিত হয়ে দাঁড়িয়েছিল ১.৩৫ লাখ কোটি টাকায়। অর্থাৎ ৩০ শতাংশ বর্ধিত আয় এবার। এই বৃদ্ধির উপাদান-কারণ বর্ণিত হয়নি। অর্জনের উপায় বিশ্লেষণ না করে বাজেট বক্তৃতায় অর্থমন্ত্রী রাজস্ব বোর্ডের চেয়ারম্যানের দোহাই দিয়েছেন, যা প্রথাসম্মত নয়। একজন সরকারি কর্মকর্তাকে বলির পাঠা সাজানো অনৈতিক। রাজস্ব বোর্ডের পক্ষে ১.৭৬ লাখ কোটি টাকা অর্জন সাধ্যাতীত বলেই শঙ্কা হয়। সে ক্ষেত্রে ঘাটতি বিশাল আকার ধারণ করবে এবং বাজেট বাস্তবায়ন দুঃসাধ্য হয়ে উঠবে। প্রায় তিন লাখ কোটি টাকার বাজেট আনন্দদায়ক, কিন্তু আয়ের নড়বড়ে স্তম্ভের ওপর দাঁড় করানো বাজেটটি ধসে পড়ার বিষয়ে সতর্কতা অবলম্বন প্রয়োজন।
৬ শতাংশের চক্র ভেদ করে জাতীয় আয়ের প্রবৃদ্ধি ৭ শতাংশে উন্নীত করার প্রত্যয় ঘোষণা করেছেন অর্থমন্ত্রী। বৃদ্ধির জন্য যে বিনিয়োগ বাড়াতে হবে, সে কথাও উল্লেখ করেছেন তিনি। কিন্তু বিনিয়োগ বৃদ্ধির কৌশল বাজেটে খুব একটা প্রতিফলিত হয়নি। করপোরেট কর সামান্য অবনয়নের ফলে ব্যাপক বিনিয়োগ আসবে, এমনটা মনে হয় না। বিনিয়োগ স্থবিরতার কারণ অন্যত্র। বিদ্যুৎ-গ্যাসের সংযোগ এখনো সহজলভ্য নয়, স্পিড মানি না দিলে পাওয়াই যায় না, এমন অভিযোগ সর্বত্র। শিল্প-জমি দুষ্প্রাপ্য। অর্থনৈতিক অঞ্চল তৈরির ঘোষণা গত বছরের বাজেট বক্তৃতায় ছিল, কিন্তু বাস্তবায়িত হয়নি। দ্রুত প্রাপ্যতা নিশ্চিত করা প্রয়োজন। অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক উভয় বিনিয়োগের ক্ষেত্রে আমলাতান্ত্রিক জটিলতা একটি ব্যাধি।
এটি দূর করতে হলে ‘বোর্ড অব ইনভেস্টমেন্টের’ স্থলে অথবা তার পাশাপাশি ‘ইনভেস্টমেন্ট প্রোমোশন বডি’ স্থাপন করতে হবে। বিনিয়োগ বোর্ড একটি রেগুলেটরি সংস্থা। প্রমোশনাল সেবা দিতে পারছে না। রেগুলেটর আর প্রমোটরের কাজের ধরনই ভিন্ন। পরিচালকদের মানসিকতা ও দক্ষতাও ভিন্ন। সে কারণে ব্যক্তি খাতের মানসিকতা ও প্রধান উদ্যোক্তা সমন্বয়ে প্রমোশন সংস্থা গঠন করা যেতে পারে।
বৈষম্য দূরীকরণের বিষয়টি বাজেটে যথাযথ দৃশ্যমান হয়নি। ৭ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হলে সম্পদ চুইয়ে (Parcolate) পড়বে, এমন ধারণা অমূলক। বিশ্বব্যাংকের এই পুরোনো ধারণা এখন অচল। অবশ্য বৈষম্য হ্রাসে সম্পদ বণ্টন-প্রক্রিয়ায় প্রবৃদ্ধির গুরুত্ব রয়েছে। কিন্তু সম্পদ বণ্টনের জন্য ‘ইন্টারভেনশন’ একান্ত প্রয়োজন। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে আওয়ামী লীগ পরিচালিত সরকার বাজেটে ধারাবাহিকভাবে সোশ্যাল সেফটিনেট বা সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর উল্লেখযোগ্য বিনিয়োগের মাধ্যমে গ্রহণযোগ্য ইন্টারভেনশন সৃষ্টি করেছে।
কৃষি খাতে ভর্তুকিও একটি ফলপ্রসূ ইন্টারভেনশন বিবেচিত হয়েছে। এ বছরের বাজেটে সফল ইন্টারভেন দুটির উপস্থিতি আশানুরূপ হয়নি।
বাজেট বা জাতীয় আয়ের শতকরা হার হিসাবে বর্তমান বাজেটে সেফটিনেটে বরাদ্দ হ্রাস পেয়েছে, যদিও উপকারভোগীর সংখ্যা বৃদ্ধি পাবে মর্মে উল্লেখ করেছেন অর্থমন্ত্রী। বিষয়টি খতিয়ে দেখা দরকার। কল্যাণ অর্থনীতির প্রবক্তা বর্তমান সরকারের সম্পদ বণ্টন তথা বৈষম্য হ্রাসকরণ নীতিমালার বাঁক পরিবর্তন না ঘটে, এমনটাই আশা। পুঁজিবাদী অর্থনীতির চাবুক খেয়ে বৈষম্য পরিমাপক গিনি কো-এফিশিন্টের ক্রম ঊর্ধ্বগতিতে বৈষম্য যখন প্রকট থেকে প্রকটতর হয়ে দাঁড়িয়েছিল, তখন শেখ হাসিনা দৃঢ়চিত্ততার সঙ্গে বৈষম্য রোধক ইন্টারভেনশন জোরদার করেছিলেন। ফলে গিনি কো-এফিশেন্ট দশমিক ৪৭ পর্যায়ে এসে থমকে দাঁড়িয়েছে, অর্থাৎ প্রবল বৈষম্য বাড়ছে না বটে, তবে হ্রাসও পাচ্ছে না।
উল্লেখ্য, স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালে গিনি কো-এফিশেন্টের মাত্রা ছিল দশমিক ২৭, যা সহনীয় বৈষম্য হিসেবে বিবেচিত। পঁচাত্তরের পর থেকে প্রবৃদ্ধির চেয়েও বেশি বেড়েছে বৈষম্য। এখন চরম বৈষম্য অবস্থা বিদ্যমান। এর জন্য বাজেটে আরও দৃঢ় ও ব্যাপক অভিঘাত প্রয়োজন।
খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ: ব্যাংকার, সাবেক ডেপুটি গভর্নর, বাংলাদেশ ব্যাংক।