সুবর্ণচরে চার সন্তানের মায়ের গণধর্ষণের শিকার হওয়ার বিষয়ে জাতীয় মানবাধিকার কমিশন দ্রুততার সঙ্গে একটা তদন্ত সম্পন্ন করে তার প্রতিবেদন প্রকাশ করায় ধন্যবাদ পেতে পারে। সাধারণত এত দ্রুত কোনো তদন্ত সম্পন্ন হওয়ার নজির তো দেশে খুব একটা নেই। সে জন্য অন্তত একটি ক্ষেত্রে হলেও তাদের উদ্যোগী ভূমিকা প্রশংসনীয়। তবে একই সঙ্গে তাদের প্রতিবেদনের সারবস্তুটি যে মানবাধিকারের নীতির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয় এবং নিন্দনীয়, সে কথাটিও বলা প্রয়োজন।
কমিশনের তদন্ত প্রতিবেদনে ধর্ষণের অভিযোগের ‘প্রাথমিক সত্যতা’ পাওয়া গেছে বলে জানানো হলেও বলা হয়েছে যে ‘একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সাথে ভিকটিমের মারপিট ও ধর্ষণের শিকার হওয়ার কোনো সম্পর্ক তদন্তকালে তদন্ত কমিটির সামনে উন্মোচিত হয়নি।’ প্রতিবেদনে এই উপসংহার টানার কারণ হিসেবে বলা হয়েছে, ‘বরং ভিকটিমের স্বামীর দায়েরকৃত এজাহারের ভাষ্যমতে এটি আসামিদের সাথে ভিকটিমের পরিবারের পূর্বশত্রুতার জের।’ অথচ ওই প্রতিবেদনেই ধর্ষণের শিকার নারীর জবানবন্দির বরাত দিয়ে বলা হয়, ‘তিনি ১৪ নম্বর ভোটকেন্দ্রে যান, তাঁকে নৌকায় ভোট দিতে বলে। তিনি বলেন, তাঁর ভোট তিনি দেবেন, তখন বলে যে যান বিকালবেলা খবর আছে। সোহেল বলে রাইতে দেখা করবে, সন্ধ্যার পর তিনি ও তাঁর পরিবারের সদস্যরা খাওয়াদাওয়া সেরে ঘুমিয়ে পড়েন।’
এই প্রতিবেদনের সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো প্রতিবেদনে ধর্ষণের শিকার নারীর ভাষ্যের একটি অংশকে নাকচ করে দেওয়ার মাধ্যমে তাঁর ভাষ্য সম্পর্কে সন্দেহ প্রকাশ করা হয়েছে। অথচ রাজনৈতিক নেতারা, গণমাধ্যম এবং নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরা সবাই ওই নারী, তাঁর পরিবার এবং গ্রামবাসীর বক্তব্যের ভিত্তিতে একবাক্যে এটিকে ভোটের সঙ্গে সম্পর্কিত বলে মত দিয়েছেন।
জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের তদন্ত প্রতিবেদন প্রকাশের পর বাম জোটের একজন নেতা, সিপিবির সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য রুহিন হোসেন আবারও জোর দিয়ে বলেছেন, তাঁরা যেসব সাক্ষ্য শুনেছেন তাতে ওই নারীর ভাষ্যই সত্য। ওই নারী পরে প্রশ্ন করেছেন, পুরোনো শত্রুতা হলে হামলা আগে না হয়ে নির্বাচনের পর রাতের বেলায় হলো কেন? মানবাধিকার কমিশনের কাছে এই প্রশ্নের কী জবাব আছে? যৌন নিপীড়নের শিকার নারীর ভাষ্য সম্পর্কে এই সন্দেহ তৈরি কোনো মানবাধিকার রক্ষার দায়িত্ব পালনকারী ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের দায়িত্বশীলতার পরিচয় বহন করে না।
ধর্ষণের শিকার নারীর দাবি নাকচ করার ক্ষেত্রে তদন্তকারীরা পুলিশের কাছে দায়ের করা এজাহারের বক্তব্যকে ভিত্তি হিসেবে গ্রহণ করেছেন। কিন্তু তাঁরা এই তথ্যটুকু বিবেচনায় নেওয়ার প্রয়োজনবোধ করেননি যে এজাহারটি লিখেছে পুলিশ এবং যে কারণে প্রধান আসামির নামও এজাহার নথিভুক্তকারী কর্মকর্তা বাদ দিয়েছেন। ওই নারীর স্বামী সংবাদমাধ্যমগুলোর কাছে এ তথ্য জানিয়ে বলেছেন যে তিনি নিরক্ষর হওয়ায় নিজে এজাহারটি লিখতে পারেননি এবং প্রধান আসামির নাম যে পুলিশ বাদ দিয়েছে, তিনি তা জানেন না। মানবাধিকার কমিশনের তদন্তকারীরা গণমাধ্যমে প্রকাশিত ও বহুল প্রচারিত এই তথ্যটুকুর সত্যাসত্য যাচাই করেছিলেন কি?
জাতীয় মানবাধিকার কমিশন হচ্ছে আইন দ্বারা প্রতিষ্ঠিত একটি আধা–বিচারিক (কোয়াসি জুডিশিয়াল) সংস্থা। মামলাটির পুলিশি তদন্ত ও বিচারপ্রক্রিয়ায় এই সংস্থার তদন্ত প্রতিবেদনের প্রভাব পড়ার সমূহ সম্ভাবনা আছে। সে কারণেই নির্যাতনের শিকার নারীর জবানবন্দি বা বিবৃতির অংশবিশেষকে নাকচ করার ফলে তাঁর পুরো বিবৃতির প্রতি সন্দেহ বা অবিশ্বাস সৃষ্টি হতে পারে। এটি মানবাধিকার কমিশনের আইন বিশেষজ্ঞদের অজানা থাকার কথা নয়। ধর্ষণের শিকার নারীর প্রতি এটি রীতিমতো অন্যায় ও অবিচার।
সুবর্ণচরের এই গণধর্ষণের অপরাধটিতে রাজনৈতিক কর্মী এবং নির্বাচনের সরাসরি সম্পর্কের কারণে সৃষ্ট বিতর্ককে ধামাচাপা দেওয়ার জন্যই মানবাধিকার কমিশন তড়িঘড়ি করে এই প্রতিবেদন দিয়েছে বলে জনমনে সৃষ্ট ধারণাকে কি নাকচ করে দেওয়া যায়? এখানে স্মরণ করা যেতে পারে, ক্ষমতাসীন দল ও তাদের জোটসঙ্গীরা ছাড়া দেশের সব রাজনৈতিক দল ও জোট এবং বিদেশি গণমাধ্যমগুলো নির্বাচনের বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে। সেই নির্বাচনকে সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক হিসেবে অভিহিত করার ক্ষেত্রে কমিশনের চেয়ারম্যান অন্যদের চেয়ে একটু বেশিই এগিয়ে ছিলেন। সুতরাং সেই নির্বাচনকে কেন্দ্র করে এ রকম ঘৃণ্য অপরাধ সংঘটনের বিষয়টি স্বীকার করে নিলে যে তাঁর নিজের বিবৃতির অসারতা প্রমাণিত হয়!
এ ক্ষেত্রে আরও লক্ষণীয় হচ্ছে প্রতিবেদনে সচেতনভাবে ‘গণধর্ষণ’ বিশেষণটি পরিহার করা হয়েছে। বরং বলা হয়েছে ‘আসামিরা ঘরে ঢুকে বাদীকে পিটিয়ে আহত করে এবং সন্তানসহ তাঁকে বেঁধে রেখে দল বেঁধে ধর্ষণ করে তাঁর স্ত্রীকে।’ ভিন্নমত প্রকাশের কারণে সংঘটিত ঘৃণ্যতম অপরাধের বিরুদ্ধে ক্ষোভ ও প্রতিবাদের উত্তাপকে নিয়ন্ত্রণের চেষ্টাই কি এর কারণ? আইনত যে প্রতিষ্ঠানের নিরপেক্ষ অবস্থান নিয়ে স্বাধীনভাবে মানবাধিকার রক্ষার দায়িত্ব পালনের কথা, সেই প্রতিষ্ঠানের এ ধরনের রাজনৈতিক পক্ষপাতমূলক ভূমিকা হতাশাজনক।
কামাল আহমেদ: সাংবাদিক
আরও পড়ুন: