ধর্ষণের পেছনে কাজ করে যে মনস্তত্ত্ব

ধর্ষণের একটা প্রধান কারণ হলো, নারীকে ব্যক্তি হিসেবে দেখতে পারার অক্ষমতা। অধিকাংশ পুরুষের কাছেই নারী ভোগ্যবস্তু

নারীকে যে পুরুষ ধর্ষণ করে তার পেছনে রয়েছে মনস্তাত্ত্বিক, জৈবিক, সাংস্কৃতিক ও অবস্থাগত কারণ। তবে এর মধ্যে সবচেয়ে প্রধান হলো, ধর্ষক তাঁর প্রথম জীবনে কীভাবে বেড়ে উঠেছিল, সেই হিস্ট্রি যে সময়টাতে যৌনতা, বিশেষ করে নারীপ্রকৃতি সম্পর্কে তাঁর মধ্যে জন্ম হয়েছে একটি বিকৃত ধারণা।

ইভোলিউশনারি সাইকোলজি তথা বিবর্তনবাদী মনস্তত্ত্ব বলছে, যে মন নিয়ে একটা শিশু জন্মাল, সংস্কৃতিই সেই মনের গঠনটি তৈরি করে। বিবর্তনবাদী মনস্তত্ত্ব জৈবিক তথা জেনেটিক প্রভাব বাদ দিয়ে মনের গঠনের ওপর সমাজ-সংস্কৃতির প্রভাবকেই প্রধান বলে গণ্য করে। সম্ভবত বিবর্তনবাদী মনস্তত্ত্বর আলোকেই লেনিন এই মন্তব্যটি করেছিলেন: ‘প্রেম হলো যৌনতা ও সংস্কৃতির সমন্বিত রূপ’। প্রাবন্ধিক ও চিন্তাবিদ মোতাহের হোসেন চৌধুরী যখন বলেন, ‘নিষ্ঠুরতা থেকে মুক্তি পাওয়ার অন্যতম উপায় যৌনতৃপ্তি...শুধু কামে তৃপ্তি নেই, তা পরিণামে ক্লান্তি ও অবসাদ নিয়ে আসে। প্রেমের সঙ্গে যুক্ত হয়েই কাম স্নিগ্ধ ও তৃপ্তিকর হয়ে ওঠে’, তখন তিনি যেন লেনিনেরই প্রতিধ্বনি করেন।

যৌনতার সঙ্গে সংস্কৃতির যোগ না থাকলে সেটা সহিংসতা, যৌনসন্ত্রাস ও ধর্ষণের দিকে ধাবিত হয়। একটা শিশু কী শিক্ষা পেল ও কেমন সংস্কৃতির মধ্যে সে বড় হলো—সেটাই নির্ধারণ করে যৌনতা সম্পর্কে, নারী সম্পর্কে, প্রেম সম্পর্কে তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি কী রকম হবে। ধর্ষণ সম্পর্কে কথা বলতে গেলে প্রেমের প্রসঙ্গ আসবেই। কারণ নারী-পুরুষের যৌন সম্পর্কের একমাত্র মাধ্যম হলো প্রেম-ভালোবাসা, অন্য কোনো মাধ্যম নেই। এই শিক্ষা না পাওয়ার ফলই ধর্ষণের এই মহামারির প্রকোপ।

পুরুষতান্ত্রিক এই সমাজ আমাদের শিখিয়েছে নারী দুর্বল। নারী অবলা। শিখিয়েছে যে, বুক ফাটলেও মুখ ফাটা নারীর শোভা পায় না। প্রশংসার ছলে বলা হয়েছে যে, নারীর সহ্য ক্ষমতা অসীম মানে নারীকে সবকিছু সহ্য করে যেতে হবে। এমনকি ধর্ষণও। পরিসংখ্যান বলছে, মেয়েরা সবচে বেশি ধর্ষিত হন নিকট আত্মীয় দ্বারা। মেয়ে যখন নিকট আত্মীয় দ্বারা ধর্ষিত হয়, নিজের মা-ও মেয়েকে ঘটনাটি চেপে যেতে বলেন অর্থাৎ মেয়েটা নিজের মাকেও আপন ভাবতে পারে না, ধর্ষণের শিকার এই মেয়েটিকেই সারাটা জীবন একা একা কষ্টটা বয়ে বেড়াতে হয়। তখন এই পরিবার, এই সমাজ, এই রাষ্ট্র সবকিছু তাঁর কাছে বৈরী—এ সবের অংশ হওয়া তো দূরের কথা।

ধর্ষণের একটা প্রধান কারণ হলো, নারীকে ব্যক্তি হিসেবে দেখতে পারার অক্ষমতা। অধিকাংশ পুরুষের কাছে নারী ভোগ্যবস্তু। অনেকের মনে এই ধারণা গেড়ে বসে আছে যে সমাজের সদস্য হলো শুধুই পুরুষ এবং নারী হলো দৈনন্দিন জীবনে ব্যবহার্য অনেকগুলো উপকরণের একটা উপকরণ মাত্র। আরেকটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, নারীর মন ও শরীর সম্পর্কে পুরুষের জ্ঞানের অভাব। পুরুষ মনে করে, গায়ে হাত দিলেই তো তাঁর ভালো লাগার কথা। কিন্তু এটা একটা মারাত্মক ভুল ধারণা। নারী তা চান না। তিনি যা চান তা হলো, একমাত্র ভালোবাসার মানুষটিই তাঁকে স্পর্শ করবে, আর কেউ নয়। না হলে, গৃহপরিচারিকাকে গৃহকর্তার সুদর্শন ছেলেও যদি শ্লীলতাহানি করে, লজ্জায় অপমানে আত্মহত্যার ঘটনা ঘটতো না। কারণ সেই হতভাগ্য মেয়েটি জানে যে, ওই স্পর্শের মধ্যে ভালোবাসা নেই। মেয়েটি বরং তাঁর শ্রেণির, অন্য বাড়ির গৃহকর্মে নিয়োজিত একটি ছেলের ভালোবাসার জন্য অপেক্ষা করবে। এই জ্ঞানের জন্য পাঠ্যপুস্তকে অন্তর্ভুক্ত করা দরকার মনোবিজ্ঞান, যেখানে থাকবে ব্যক্তি হিসেবে নারী-পুরুষ উভয়েরই শরীর ও মনের ওপরে বৈজ্ঞানিক আলোচনা।

যে সব দেশে আইনের শাসন আছে, সে সব দেশেও ধর্ষককে রক্ষা করার একটা ধ্বংসাত্মক প্রবণতা এস্টাব্লিশমেন্ট তথা প্রতিষ্ঠানের মধ্যে আছে। হলিউডে মেয়েরা পরিচালক বা সহঅভিনেতার বিরুদ্ধে, এমনকি অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটিতেও মেয়েরা শিক্ষকদের বিরুদ্ধে যৌন হয়রানির অভিযোগ করে। এ সব ঘটনা পুরুষতান্ত্রিকতার উদাহরণ। ক্ষমতাসীন দল যদি তাঁর লোকদের রক্ষার চেষ্টা করে, পুলিশ যদি তাঁর সদস্যদের বাঁচাতে চায়, প্রতিষ্ঠান যদি বিচার না করে, পিতা যদি সন্তানকে আইনের হাতে সোপর্দ না করে, মা যদি নিকট আত্মীয় দ্বারা কন্যার নিগ্রহে উচ্চকণ্ঠ না হন, তাহলে যৌন হয়রানি, ধর্ষণ কোনো দিন বন্ধ হবে না। ধর্ষণের যত ঘটনা আমরা জানি, তার চেয়ে অনেক গুণ বেশি ধর্ষণ বাস্তবে ঘটে। মাত্র দুইটা খাতের কথা এখানে উল্লেখ করি। বাড়ির গৃহপরিচারিকা ও গার্মেন্টসকর্মী। যৌন হয়রানি বা ধর্ষণ— দুই ক্ষেত্রেই এরা হচ্ছে সহজ টার্গেট। মালিক ও ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার তাঁদের দারিদ্র্যের সুযোগ নেয়। এসব সমস্যা যুগের পর যুগ চলে আসছে। বস্তুত প্রায় সব কর্মক্ষেত্রেই নারীরা এর শিকার। দেখার কেউ নেই।

পর্নোগ্রাফি ধর্ষণের একটা বড় কারণ। ইন্টারনেটের বদৌলতে মোবাইলে ফোনে পর্নোগ্রাফি দেখার সুযোগ আছে। পর্নোগ্রাফি আছে অথচ নারী-পুরুষের অবাধ মেলামেশার সুযোগ নেই, সুস্থ যৌনচর্চার সুযোগ নেই—এই অস্বাভাবিক ও বৈপরীত্যপূর্ণ পরিস্থিতি থেকে পরিত্রাণের উপায় কী? আমাদের দেশের সমাজ বিজ্ঞানীদের এই বিষয়গুলো নিয়ে গভীরভাবে ভাবতে হবে।

মানুষকে ব্যাপকভাবে সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে, খেলাধুলায় ও শরীরচর্চায় নিয়োজিত করতে পারলে সুফল পাওয়া যাবে। নান্দনিক কাজ যেমন চিত্রকলা, গান-বাজনা, গল্প-কবিতা পাঠ ও লেখা, প্রতিযোগিতা ও আকর্ষণীয় পুরস্কার, নাটক, যাত্রা, ফিল্ম, থিয়েটার এবং খেলাধুলা ও শরীরচর্চার জন্যও থাকা দরকার আকর্ষণীয় পুরস্কার। এ জন্য সরকারি বরাদ্দ দরকার। দরকার ব্যাপকভাবে সাংস্কৃতিক ও স্পোর্টস সেন্টার গড়ে তোলা। এই সব কর্মযজ্ঞের পাশাপাশি আইনের প্রয়োগ নিশ্চিত করা দরকার। ধর্ষণের শাস্তি মৃত্যুদণ্ড হলে ধর্ষণ কমে—এ রকম কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি। অপরাধী যদি জামিন না পায় এবং শাস্তি যদি যাবজ্জীবন না হয়ে আমৃত্যু হয়, সম্ভাব্য ধর্ষক যদি বুঝতে পারে যে, সে কোনো মতেই শাস্তি এড়াতে পারবে না, তাহলেই ধর্ষণ হ্রাস পাবে।

সর্বোপরি, জীবনের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গির আমূল পরিবর্তন দরকার। সংস্কৃতির ছায়ায় নান্দনিকতা ও প্রেম নিয়ে বাঁচতে হবে। রেনেসাঁর মূল সুরের সঙ্গে মিল রেখে মোতাহের হোসেন চৌধুরী যথার্থই বলেন, ‘সংস্কৃতি মানে সুন্দর ভাবে, বিচিত্র ভাবে, মহৎ ভাবে বাঁচা;...কাব্যপাঠের মারফতে ফুলের ফোটায়, নদীর ধাওয়ায়, চাঁদের চাওয়ায় বাঁচা; আকাশের নীলিমায়, তৃণগুল্মের শ্যামলিমায় বাঁচা, বিরহীর নয়নজলে, মহতের জীবনদানে বাঁচা...নর-নারীর বিচিত্র সুখ-দুঃখে বাঁচা...দুঃখীজনের দুঃখ নিবারণের অঙ্গীকারে বাঁচা। বাঁচা, বাঁচা, বাঁচা। প্রচুরভাবে, গভীরভাবে বাঁচা। বিশ্বের বুকে বুক মিলিয়ে বাঁচা।’

ড. এন এন তরুণ রাশিয়ার সাইবেরিয়ান ফেডারেল ইউনিভার্সিটির অর্থনীতির ভিজিটিং প্রফেসর ও সাউথ এশিয়া জার্নালের এডিটর অ্যাট লার্জ
nntarun@gmail. com