দেশে একের পর এক নারী ধর্ষণ ও নির্যাতনের ঘটনা ঘটে চলেছে। অথচ ক্ষমতার রাজনীতি সাফাই গাইতে ব্যস্ত। জনগণের মধ্য থেকে যে প্রতিবাদ হচ্ছে সেটাও খুব জোরালো নয়। এই অবিমৃশ্য পরিস্থিতি আমাদের কোথায় নিয়ে যাচ্ছে?
মাত্র কয়েক দিন আগে সিলেটে এমসি কলেজের ছাত্রাবাসে ধর্ষণের শিকার হলেন এক গৃহবধূ। ধর্ষকেরা সবাই ছাত্রলীগের নেতা-কর্মী। কেউ ছাত্র, কারও ছাত্রত্ব অনেক আগে শেষ হয়েছে। এরপরও তাঁরা ছাত্রলীগের পরিচয়ে ছাত্রাবাস দখল করে ছিলেন। কলেজের অধ্যক্ষ, ছাত্রাবাসের তত্ত্বাবধায়ক—কেউ তাঁদের নিবৃত্ত করতে পারেননি। কেননা তাঁরা নিজেদের আইনের ঊর্ধ্বে ভাবতেন।
একই সময়ে খাগড়াছড়িতে দুর্বৃত্তরা এক পাহাড়ি বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী তরুণীকে ধর্ষণ করে। ঢাকায় হাসপাতালে চিকিৎসাধীন স্বামীর জন্য রক্ত নিতে গিয়ে ধর্ষণের শিকার হলেন আরেক নারী। গাইবান্ধায় তরুণী ও নারায়ণগঞ্জে স্কুলছাত্রী ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে। গোপালগঞ্জে স্কুলছাত্রীকে ধর্ষণ করে ভিডিও ভাইরাল করার অভিযোগও এসেছে।
এরপরই নোয়াখালীর বেগমগঞ্জে নারী নির্যাতনের রোমহর্ষক খবর এল। সেখানে দেলোয়ার বাহিনী নামে এক সন্ত্রাসী দলের ক্যাডারেরা একজন নারীকে নির্যাতন করেই ক্ষান্ত হয়নি, সেই নির্যাতনের ভিডিও সামাজিক যোগযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে দিয়েছে। ঘটনাটি ঘটে ২ সেপ্টেম্বর।
মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিস কেন্দ্রের (আসক) হিসাব অনুযায়ী, ২০১৯ সালে ১ হাজার ৪১৩ জন নারী ধর্ষণের শিকার হন। ২০১৮ সালে এই সংখ্যা ছিল ৭৩২ জন৷ অর্থাৎ গত বছরের তুলনায় ধর্ষণের ঘটনা বেড়েছে দ্বিগুণ। আর চলতি বছরে প্রতিদিন অন্তত ৩ জন নারী ধর্ষিত হয়েছেন। বলার অপেক্ষা রাখে না যে এই হিসাব অসম্পূর্ণ। পত্রিকায় সব খবর আসে না। সব ভুক্তভোগী থানা-পুলিশের কাছেও যান না। প্রথমত, লোকলজ্জার ভয়ে। দ্বিতীয়ত, তাঁরা ভাবেন, অভিযোগ করেও কোনো লাভ হবে না। বিশেষ করে অভিযুক্ত ব্যক্তিরা যদি হন ক্ষমতাসীন দলের নেতা-কর্মী কিংবা প্রভাবশালী বা তাদের পরিবারের সদস্য।
আমরা দেখেছি, যেসব নারী নির্যাতন ও ধর্ষণের ঘটনা নিয়ে তোলপাড় হয়, সেসব ঘটনায় আসামিরা গ্রেপ্তার হয়। কোনো কোনো ক্ষেত্রে বিচারও হয়। আর বাকি মামলা কবিরহাটের ঘটনার মতো শেষ হওয়ার আগেই শেষ হয়ে যায়। আসামিরা বেকসুর ছাড়া যায়।
পুলিশ স্বেচ্ছায় এসব মামলা শেষ করে, না ক্ষমতাধর ব্যক্তি কিংবা নেতার হুকুমে ঘটে—সেটাও প্রশ্ন বটে। যেসব অপরাধের সঙ্গে রাজনীতির সম্পৃক্ততা থাকে না, সেসব ঘটনায় পুলিশ টাকা খেয়ে অসত্য প্রতিবেদন দেয়। জীবিত ব্যক্তিকে মৃত বানায়, দিনকে রাত করে। যেমনটা নারায়ণগঞ্জে তরুনী অপহরণ মামলায় ঘটেছে। আর যেসব অপরাধের সঙ্গে রাজনীতির সম্পৃক্ততা থাকে, সেখানে কাকে ধরা হবে আর কাকে ছাড়া তা ঠিক হয় রাজনৈতিক হিসাব–নিকাশ থেকে।
আমাদের নেতা-মন্ত্রীরা চড়া গলায় বলেন, আইন নিজস্ব গতিতে চলবে। কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না। কিন্তু বাস্তবে আইন নিজস্ব গতিতে চলে না। আদালতের রায়ে শাস্তি পেলেও অলৌকিকভাবে তারা ক্ষমা পেয়ে যায়।
ধর্ষণ ও নারী নির্যাতন বেড়ে যাওয়ার কারণ যে বিচারহীনতা, সে কথা বলার অপেক্ষা রাখে না। কয়েক বছর আগে প্রথম আলোর অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছিল, নারী ধর্ষণ ও নির্যাতনের মামলার শাস্তি হয় মাত্র ৩ ভাগের; বাকি ৯৭ ভাগ মামলার আসামিরা শাস্তির বাইরেই থেকে যায়। ক্ষমতার ছত্রচ্ছায়ায় থাকা অপরাধীরা মনে করেন, তাদের কিছু হবে না। পার পেয়ে যাবেন।
নোয়াখালীর ঘটনার পর একজন মন্ত্রী বললেন, নারী নির্যাতনের ঘটনা আগেও ঘটেছে। এখন গণমাধ্যমে বেশি প্রচার পাচ্ছে। এর মাধ্যমে তিনি নারী নির্যাতনের মতো ভয়ংকর অপরাধকে হালকা করে দেখলেন। অতীতে খুন–ধর্ষণ হয়েছে বলে এখনো হবে, এটি যুক্তির কথা হতে পারে না। প্রত্যেক নাগরিকের নিরাপত্তা দেওয়া রাষ্ট্রের দায়িত্ব।
নোয়াখালীর নারী নির্যাতনের ঘটনায় ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে প্রতিবাদ হয়েছে। উত্তরায় মহাসড়ক বন্ধ করে কয়েক শ মানুষ বিক্ষোভ করেছে। শাহবাগে ছাত্র-তরুণেরা 'বন্দী সময়ের চিৎকার', 'ধর্ষণ ও নির্যাতনের বিরুদ্ধে ছাত্র-জনতা' প্রভৃতি ব্যানার নিয়ে বিক্ষোভ করেছেন। বিশিষ্ট ব্যক্তিরা ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রতিবাদের ঝড় উঠেছে। প্রশ্ন হলো এই আওয়াজ রাষ্ট্রযন্ত্রের কর্ণকুহরে পৌঁছাবে কি?
অনেকে আসামিদের ক্রসফায়ারে দেওয়ার দাবি করেছেন। এটা আবেগী প্রতিক্রিয়া। বিচার বিহর্ভূত হত্যা যে কোনো সমাধান নয়, মাদকবিরোধী অভিযানই তার প্রমাণ। এ রকম আত্মঘাতী প্রবণতা থেকে রাষ্ট্র তখনই বের হতে পারবে, যখন প্রতিটি অপরাধের সুষ্ঠু তদন্ত ও বিচার হবে এবং অপরাধীর সর্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিত করা সম্ভব হবে। বিচারহীনতা অপরাধের মাত্রাই বাড়ায় না, অপরাধীকেও করে তোলে হিংস্র ও বেপরোয়া। বিচারেরর আগে বিচার কিংবা তদন্তের নামে মামলা শেষ করে দেওয়ার কুঅভ্যাস থেকে রাষ্ট্রকে বেরিয়ে আসতেই হবে।
সোমবার শাহবাগের সমাবেশে তারুণ্যের উজ্জীবন দেখা গেল। প্রতিবাদের জনকল্লোল ধ্বনিত হয়েছে নোয়াখালী, চট্টগ্রাম, ময়মনসিংহসহ আরও অনেক স্থানে। ২০১৩ সালে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে শাহবাগে গণজাগরণ মঞ্চ গড়ে উঠেছিল। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারও হয়েছিল। আজ ধর্ষক-নির্যাতকদের বিরুদ্ধেও আরেকটি গণজাগরণ প্রয়োজন।
সোহরাব হাসান: প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক ও কবি।