প্রতিটি ধর্ষণ আসলে কয়েকবার ঘটে। প্রথমে শারীরিক রাজনীতি আকারে। দ্বিতীয়বার সেটার রাজনৈতিক দিক আড়াল করার মাধ্যমে। তারপর বিচারপ্রক্রিয়ার সময়ও। ‘সফল’ বিচার শেষেও ধর্ষণের শিকার নারী পুরো অপরাধের মানসিক ক্ষতি বয়ে বেড়ান আজীবন। আর আদালতের রায় হওয়ার পর সমাজ সেই যন্ত্রণা অগ্রাহ্য করে, ভুলে যায়। এই ভুলে যাওয়াটা পুরোদস্তুর সচেতন ক্রিয়া। কথিত ‘দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি’র পরও ধর্ষণের শিকার কোনো নারী কি আগের জীবনের স্বাভাবিক মানসিক শান্তি নিয়ে বাকি দিনগুলো কাটাতে পারেন? নাকি তাঁর ওই মানসিক ক্ষত সমাজে অন্য সব নারীর জন্য অদৃশ্য এক স্থায়ী ভীতির বার্তা ছড়ায়?
এ রকম ‘ক্ষত’ ও ‘ভীতি’ অবশ্যই রাজনৈতিক ঘটনা। রাজনীতি সেই বাস্তবতা তৈরি করে, যেখানে ধর্ষণ সংস্কৃতি হয়ে ওঠে। এ রকম সমাজ তো অতীত ও বর্তমান রাজনীতিরই নির্মাণ।
ধর্ষণের কারণ রয়েছে সমাজের ভেতরে
কেন নারীকে শরীর নিয়ে উদ্বিগ্ন থাকতে হয় এবং পুরুষ তাঁর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়তে চান? সমাজের মধ্যেই এর ব্যাখ্যা আছে। সমাজের তাবৎ সংলাপ, শিক্ষা, সংস্কৃতি, অর্থনৈতিক সম্পর্ক, রাজনৈতিক আবহাওয়া মিলিয়েই পুরুষের হাতে নারীর নিপীড়ন। ধর্ষকামিতার সামাজিক সম্পর্ক সমাজপতিরাই তৈরি করেছেন বহুদিনে, বহু চেষ্টায়, বহু দরকারে। সেই চেষ্টারই ফল প্রত্যেক পুরুষের সম্ভাব্য ধর্ষণকারী হয়ে ওঠা। সামাজিক ওই চেষ্টার মধ্যেই আছে জনগোষ্ঠী হিসেবে নারীকে সব উপায়ে নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্য। সেই লক্ষ্যেরই অংশ ধর্ষণ। এটা অতি প্রচলিত একটা সামাজিক শিক্ষা কর্মসূচির অপ্রচলিত অস্ত্রমাত্র। এর একমাত্র কাজ সমষ্টিগতভাবে নারীকে ভয়ে রাখা।
সমাজে নারীরা কমবেশি ভীতির আবহেই আছেন। এভাবে থাকতেই তাঁদের শেখানো হয়। পুরুষেরা কিন্তু সম্মিলিতভাবে নারীদের নিয়ে ভীতিতে থাকেন না। পুরুষ কীভাবে আচরণ করতে পারবেন এবং নারী কীভাবে আচরণ করবেন—এই দ্বিমুখী শিক্ষার মধ্যেই ধর্ষণের বীজ লুকিয়ে থাকে। ভালো মাটি-জল-হাওয়া পেলে সেই বীজ থেকে চারা গজায়। এই উৎপাদন ও পুনরুৎপাদন বিরামহীন। এটাকে কেবল শহীদ মিনারে মোমবাতি জ্বেলে থামানো কঠিন।
কাজটা রাজনৈতিক। ধর্ষণ একটা প্রাতিষ্ঠানিক ব্যাপার। আমাদের প্রতিষ্ঠানগুলোর সংস্কার ছাড়া ধর্ষণ কীভাবে থামতে বা কমতে পারে?
ধর্ষণ রাজনৈতিক ঘটনা
আজ থেকে ঠিক ১ বছর ১০ মাস আগে বেগমগঞ্জের একলাশপুর থেকে ৩০ কিলোমিটার দূরে একই জেলার সুবর্ণচরে জাতীয় নির্বাচনের রাতে যে গণধর্ষণ ঘটেছিল, তার কথা কিন্তু ইতিমধ্যে আমরা ভুলে গেছি। অনেক অনেক মোমবাতি-প্রতিবাদের পরও পাশের থানার একলাশপুরে ধর্ষণ কিন্তু থামেনি।
৫০ বছর আগের বান্দরবানের সমাজে কিংবা টাঙ্গাইলের গারো জনপদে ধর্ষণের নজির অতি বিরল ছিল। এখন সেটা আর বিরল নেই। বান্দরবানের এই নতুন সামাজিক বৈশিষ্ট্য কি সেখানকার কোনো নৈতিক সংকট? স্থানীয় লোকজন বলছেন, রাজনীতি সমতল থেকে ওখানে রেপ সংস্কৃতি পরিবহন করে নিয়ে গেছে। অর্থাৎ একটা ‘ব্যবস্থা’ সমতল থেকে স্থানান্তরিত হয়েছে। হঠাৎ কোনো নৈতিক অধঃপতন ঘটেনি সেখানে।
ধর্ষণ বা বলাৎকারের সঙ্গে বল বা শক্তিপ্রয়োগের সম্পর্ক। শব্দের ভেতরই তার রাজনীতি স্পষ্ট হয়ে আছে। আগেও তাই ছিল।
ধর্ষণ কেন আপাতত বন্ধ হবে না
ধর্ষণ পুরুষদের জন্য একটা রাজনৈতিক যুদ্ধাস্ত্র বললে অনেক পুরুষ কষ্ট পান। নিশ্চয়ই সব পুরুষ ধর্ষকামী নন। আর নারীমাত্রই ধর্ষণের শিকার নন। পুরুষ সমাজের একাংশই কেবল ধর্ষণপ্রবণতায় আক্রান্ত। ওইটুকুই সেই রাজনীতির জন্য যথেষ্ট। এতেই সমগ্র নারী সমাজে ভীতি ও নিয়ন্ত্রণের আবহ জারি থাকে ভালোভাবে।
ধর্ষণ থামাতে দাবিদাওয়া খেয়াল করলেও আমরা একে ঘিরে থাকা রাজনীতির ভয়াবহতা বুঝতে পারব। বলা হয়, ‘নারীর নিরাপত্তা দরকার।’ কে দেবে সেই নিরাপত্তা? কার হাতে সেই নিরাপত্তা নামের বর্ম? উত্তর আমাদের জানা। কই, কেউ কি কোনো দিন পুরুষের নিরাপত্তা চেয়েছেন? সমাজ এত আহাম্মক নয়।
‘নারীর নিরাপত্তা দরকার’, এই দাবির মধ্যেও আমরা ওই সামাজিক রাজনীতিকেই স্বীকার করছি—নারী নিয়ন্ত্রিত আর পুরুষ নিয়ন্ত্রক।
দাঙ্গার সময় কিংবা যুদ্ধের মধ্যে যে ধর্ষণ ঘটছে, সেটাকে খুব কম দেশেই বিচারযোগ্য মনে করা হয় আজও। ওটা জয়-পরাজয়ের পার্শ্বফল হিসেবেই সভ্যতার খাতায় জমা পড়ছে।
অনেকের মধ্যেই ধর্ষণ নিয়ে ক্ষোভ আছে। এই অনাচার কেন বাড়ছে—এটাই তাঁদের আক্ষেপ। ধর্ষকদের বিচার চান তাঁরা। এ রকম ‘দৃষ্টান্তমূলক’ অনেক বিচার হয়েছে। দেলোয়ার বাহিনীরও ‘বিচার’ হয়তো হবে। কিন্তু এ রকম বিচার মানে আদতে এক-দুটি পুরুষকে কারাগারে আটকে রাখা বা ফাঁসিতে ঝোলানোমাত্র। কিন্তু ধর্ষণ কি কেবলই দেহবিদ্যার মোকদ্দমা? যে পারিবারিক, শিক্ষামূলক ও অর্থনৈতিক সম্পর্ক থেকে ধর্ষণ কায়েম হয়, তা নিয়ে তেমন ক্ষোভ আছে কি কোথাও? আমরা সমস্যার গোড়ায় তাকাতে হিম্মত পাই না।
ফলে আপাতত ধর্ষণ বন্ধ হওয়ার সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে না। কোনো কোনো ধর্ষক দ্রুত, কেউ আস্তে-ধীরে ধরা পড়বে। কেউ কখনোই ধরা পড়বে না। আর ধর্ষণের রাজনীতিকে ধরার কথা ‘আমরা’ কল্পনাও করতে পারব না।
হঠাৎ হঠাৎ কয়েকজন ধর্ষককে ‘চিহ্নিত করে’ ‘দৃষ্টান্তমূলক’ শাস্তির মাধ্যমে আসলে ধর্ষণের রাজনৈতিক-অর্থনীতিই তরতাজা থেকে যায়। একলাশপুরের দেলোয়ার বাহিনীকে নিয়ে জাতীয় ক্ষোভ-বিক্ষোভের পরও একই রকম ঘটনা ঘটতে পারে, যদি না আমরা ধর্ষণের দেড় মিনিটের ভিডিওগুলোর বদলে দশকের পর দশকে তৈরি বড় ভিডিওটি না দেখি। ছোট ভিডিওগুলো বড় ভিডিওর অংশ। ধর্ষণ বন্ধ করতে দরকার ওদিকে তাকানো। ওখানে হাত দেওয়া।
কিন্তু আমরা কি তা করব? মানবাধিকার সংগঠন অধিকারের প্রতিবেদনে দেখা গেল, ২০১৮ সালের ৬৩৫টি ধর্ষণের ঘটনার পরের বছর বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১ হাজার ৮০—প্রায় দ্বিগুণ। এর মধ্যে ২০১৮ সালে গণধর্ষণ ছিল ৮৯; পরের বছর সেটা হলো ১৫০।
ধর্ষণ ক্রমে বাড়ছে কেবল নয়, ‘গণ’ চরিত্রের কারবারে পরিণত হয়েছে। আগামীর জন্য সতর্কবাণী আছে এসব তথ্যে। যদি আদৌ আমরা সতর্ক হই।
আলতাফ পারভেজ: দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার ইতিহাস বিষয়ের গবেষক