২৬তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর আয়োজন দেখতে ক্লিক করুন
মূল সাইট দেখতে ক্লিক করুন

ধর্ষণ কি এভাবে চলতেই থাকবে?

এনওসি কথাটার মানে হচ্ছে নো অবজেকশন সার্টিফিকেট বা অনাপত্তি সনদ। বিদেশ গমনের ক্ষেত্রে বা অন্য নানা কাজে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে অনাপত্তি সনদের প্রয়োজন পড়ে। সারা দেশে এখন যেভাবে প্রতিনিয়ত ধর্ষণের ঘটনা ঘটছে, তাতে মনে হচ্ছে, ধর্ষকামীরা ধর্ষণ করার অনাপত্তি সনদ পেয়ে গেছেন, যা তাঁদের এমন জঘন্য অপরাধ ঘটনার সুযোগ করে দিয়েছে।

৩০ ডিসেম্বর জাতীয় সংসদ নির্বাচনের রাতে গণধর্ষণের শিকার হন নোয়াখালীর সুবর্ণচর উপজেলার চার সন্তানের এক জননী। স্বামী ও সন্তানদের বেঁধে রেখে তাঁকে ধর্ষণ করেন ধর্ষকেরা। এরপরই যেন শুরু হয়েছে ধর্ষণের মহোৎসব। চলতি বছরের প্রথম ২৩ দিনে ধর্ষণের শিকার হয়েছেন ৩০ জন। অর্থাৎ প্রতিদিনই দেশের কোথাও না কোথাও ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে। ধর্ষণের শিকার বেশির ভাগই শিশু ও কিশোরী। কী ভয়াবহ ব্যাপার! এ রকম চলতে থাকলে বছর শেষে এ সংখ্যা কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে, তা কি অনুমান করা যায়?

আসলে কী হচ্ছে বলুন তো? হঠাৎ কী এমন ঘটল যে এ দেশের ধর্ষণের ঘটনা এভাবে বেড়ে গেল? এর পেছনে কোন বিষয়টি কাজ করেছে উসকানি হিসেবে?

আসলে অনেক দিন ধরে দেশে যে বিচারহীনতার এক সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে, সে কারণেই অহরহ ঘটছে ধর্ষণের ঘটনা। ধর্ষণ ও যৌন নির্যাতনের খবর যত বেশি পাওয়া যায়, এসব অপরাধের দায়ে অপরাধীদের শাস্তির দৃষ্টান্ত তার চেয়ে অনেক কম। ধর্ষকামীরা এত দিনে জেনে গেছেন, ধর্ষণ করলে তাঁদের খুব একটা সমস্যা হবে না। প্রথম প্রথম একটু হইচই হবে। মামলা হবে, পুলিশ হয়তো তাঁদের ধরবেও। কিন্তু শেষমেশ কিছুই হবে না। পার তাঁরা পেয়ে যাবেন।

প্রথম আলোয় প্রকাশিত এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, সরকার ২০০১ সালে নারী ও শিশু নির্যাতন প্রতিরোধে মাল্টিসেক্টরাল প্রোগ্রামের আওতায় ঢাকা, রাজশাহী, চট্টগ্রাম, সিলেট, বরিশাল, খুলনা, রংপুর ও ফরিদপুর জেলায় ওয়ান স্টপ ক্রাইসিস সেন্টার চালু করে। ২০১৭ সাল পর্যন্ত এই সেন্টারগুলো থেকে ৪ হাজার ৫৪১টি ধর্ষণের মামলা হয়। এর মধ্যে ১ হাজার ২২৯টি মামলার নিষ্পত্তি হয়েছে। নিষ্পত্তি হওয়া মামলার মধ্যে মাত্র ৬০টিতে দোষী ব্যক্তিরা শাস্তি পেয়েছেন। অন্যদিকে, ৩ হাজার ৩১২টি মামলার নিষ্পত্তিই হয়নি।

নারী ও শিশুদের অধিকার নিয়ে কাজ করা সংস্থাগুলোর মতে, ধর্ষণের আলামত সংগ্রহ থেকে শুরু করে মামলার তদন্তপ্রক্রিয়ায় পুলিশের অদক্ষতা, আন্তরিকতাহীনতা, দুর্নীতিপ্রবণতা, ধর্ষকের রাজনৈতিক পরিচয়, প্রভাবশালীদের হস্তক্ষেপ ইত্যাদি কারণে অধিকাংশ ধর্ষণ মামলায় আদালতে অপরাধ প্রমাণিত হয় না বলে ধর্ষকেরা ছাড়া পেয়ে যান। বিশেষত, ধর্ষণের শিকার নারী যদি হন দরিদ্র, ক্ষমতাহীন, প্রভাব-প্রতিপত্তিহীন, আর ধর্ষকেরা যদি হন ধনী, ক্ষমতাধর ও প্রভাবশালী, তাহলে তো কথাই নেই।

পাঠকদের অনেকের নিশ্চয়ই মনে আছে বনানীর দ্য রেইনট্রি হোটেলে বিশ্ববিদ্যালয়পড়ুয়া দুই ছাত্রীকে ধর্ষণের ঘটনার কথা। ২০১৭ সালের ২৮ মার্চ ওই হোটেলে জন্মদিনের পার্টির কথা বলে ডেকে নিয়ে ওই দুই ছাত্রীকে ধর্ষণ করা হয়। এ ঘটনায় আপন জুয়েলার্সের মালিকের ছেলেসহ পাঁচজনের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়। কিন্তু প্রায় দুই বছর হতে চলল। এখনো এই মামলার কোনো সুরাহা হয়নি। ভয়ের কথা হচ্ছে, আসামিরা সবাই বিত্তশালী। হয়তো দেখা যাবে, এঁদের কোনো শাস্তিই হচ্ছে না।

এমন পরিস্থিতিতে নোয়াখালীর সুবর্ণচরে চার সন্তানের জননীর ধর্ষকের ঘটনায় প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক, শেষতক এ মামলার বিচার শেষ পরিণতি পর্যন্ত গড়াবে তো? দায়ী ব্যক্তিরা সাজা পাবেন তো? কারণ, তাঁরা সবাই খুব প্রভাবশালী।

১৮ জানুয়ারি রাতে নোয়াখালীর কবিরহাটে একইভাবে মা ও সন্তানদের অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে এক গৃহবধূকে গণধর্ষণ করা হয়। এই ধর্ষকেরাও পার পেয়ে যেতে পারেন। কারণ, তাঁরা সবাই রাজনৈতিকভাবে ক্ষমতাশালী। এর আলামত এরই মধ্যে পাওয়া গেছে। এই গণধর্ষণের ঘটনায় গঠিত মেডিকেল বোর্ড যে প্রতিবেদন জমা দিয়েছে, তাতে বলা হয়েছে, ডাক্তারি পরীক্ষায় ধর্ষণের আলামত পাওয়া যায়নি। যেখানে খোদ ধর্ষকেরা ধর্ষণ করার কথা স্বীকার করছেন, সেখানে কীভাবে বলা হয় যে ধর্ষণের আলামত পাওয়া যায়নি?

প্রশ্ন হচ্ছে, এ রকমই কি চলবে? কোনো প্রতিকার, কোনো বিচার কি পাবেন না ধর্ষণের শিকার নারীরা? কারও কি কিছুই করার নেই?

দেখেশুনে মনে হচ্ছে, আসলেই কারও কিছু করার নেই। ধর্ষককামী পুরুষদের কি তাহলে অলিখিত অনাপত্তিপত্র দেওয়া হয়েছে?

আসলে ধর্ষণ বিষয়টা আমাদের দেশে এখনো জাতীয় সমস্যার মধ্যে অন্তর্ভুক্ত হতে পারেনি। এ অপরাধকে লঘু অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হয়। কিন্তু ধর্ষণকে কোনো অবস্থাতেই লঘু অপরাধ হিসেবে দেখার কোনো সুযোগ নেই। এটি জঘন্য একটি অপরাধ। এ অপরাধ সংঘটনকারীকে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতেই হবে।

রোকেয়া রহমান: সাংবাদিক