ছোটবেলায় শুনতাম, ঘরের চৌকাঠে বসতে নেই, বালিশের ওপরেও নয়। কেন? বসলে কী হয় জিজ্ঞেস করলে গুরুজনেরা বলতেন, পেছনে ফোড়া বেরোবে। ফোড়া মানে যন্ত্রণার একশেষ। সেই ভয়ে চৌকাঠ বা বালিশ ছাড় পেত। অনেক পরে বুঝেছিলাম, চৌকাঠে বসলে যাতায়াতের অসুবিধা। বালিশে বসলে ফেটে যাওয়ার আশঙ্কা। তাই ফোড়ার ভয় দেখিয়ে বাচ্চা সামলানো।
বাচ্চাবেলা উতরে যাওয়ার পর কৈশোর-যৌবনের দামাল দিনগুলোয় কয়েকটি বাংলা উপন্যাস দারুণ টেনেছিল। সমরেশ বসুর বিবর ও প্রজাপতি, আর বুদ্ধদেব বসুর রাত ভ’ের বৃষ্টি। অশ্লীলতার দায়ে উপন্যাসগুলো নিষিদ্ধ করায় সে এক ব্যাপক চাঞ্চল্য! তৎকালীন বাঙালি সমাজপতিদের একাংশ সমাজ ও সাহিত্যকে উচ্ছন্নে যাওয়ার হাত থেকে বাঁচাতে কোমর কষে নেমেছিলেন। শ্লীল-অশ্লীলের সংজ্ঞা নিয়ে মামলা-মোকদ্দমা পর্যন্ত হয়েছিল। শেষ পর্যন্ত নিষেধাজ্ঞার পরাজয় ঘটেছিল।
এই সেদিন একটা খবরের কাগজ লিখল, নিষেধাজ্ঞার অন্যতম প্রাচীন উদাহরণ হলো লক্ষ্মণের গণ্ডি। গণ্ডির বাইরে বের হলেই সীতার বিপদ। পইপই করে তা বলা সত্ত্বেও সীতা সেই নিষেধাজ্ঞা মানলেন না। তারপর কী রকম লঙ্কাকাণ্ড ঘটে গেল, সে তো সবারই জানা।
এ রকম লঙ্কাকাণ্ড ঘটানোর একটা সলতে পাকানোর কাজ ভারতের রাজ্যে রাজ্যে ইদানীং শুরু হয়েছে। ব্যাপারটা ঠিক আমিষ-নিরামিষ দ্বন্দ্ব নয়, আবার দ্বন্দ্বের প্রাথমিক অবস্থা বলাও যেতে পারে। প্রথম শুরু হলো গরুর মাংস বিক্রির ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি নিয়ে। মহারাষ্ট্রে। দেখাদেখি অন্য বেশ কিছু রাজ্যও নতুন করে গোমাংস বেচাকেনা নিয়ে নড়েচড়ে বসল। দিল্লিতে বহু বছর গরু জবাই নিষিদ্ধ। তবে মহিষের মাংস পাওয়া যায়। দিল্লির লাগোয়া উত্তর প্রদেশের অংশে তো ঢালাও গোমাংস মেলে। তথ্য বলে, পৃথিবীতে সবচেয়ে বেশি মাংস রপ্তানি করে ব্রাজিল। তার পরেই ভারত।
গরু-মহিষের প্রসঙ্গই যখন চলছে এবং নিষেধাজ্ঞা, তখন অন্য যে ভাবনাটা ঘুরঘুর করছে, সেটা সেরে ফেলা যেতে পারে। ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর (বিএসএফ) কর্তারা একান্তে যা বলেন এবং তার সঙ্গে এই ‘গ্রে মার্কেটের’ হদিস যাঁরা রাখেন, তাঁদের হিসাব অনুযায়ী, ফি বছর ভারত থেকে বাংলাদেশে গরু-বাণিজ্যের বহর নাকি কমবেশি ২০ হাজার কোটি টাকা! এই বাণিজ্যের একটা অংশ বাংলাদেশ সরকার আইনত লাভ করে। কিন্তু ভারত সরকারের ভাঁড়ারে কানাকড়িও আসে না, যেহেতু এটা চোরাকারবার। অথচ ভারত থেকে আইনত মাংস (প্রধানত মহিষের) রপ্তানি হচ্ছে বছরে ১৫ হাজার কোটি টাকার। সবটাই ‘প্রসেসড মিট’। তাহলে বাংলাদেশের সঙ্গে এই অবৈধ বাণিজ্য বৈধ করতে বাধা কোথায়, সেই প্রশ্নটা জাগে। বাধাটা কি ভারত মানে ‘হিন্দুস্তান’ এবং গরু হিন্দুদের একাংশের কাছে ‘গো-মাতা’ বলে?
সেই গো-মাতারা কিন্তু হিন্দু-অহিন্দুদের হাত ধরে প্রায় বিনা বাধায় রাজস্থান, গুজরাট, হরিয়ানা, উত্তর প্রদেশ ও বিহার হয়ে পশ্চিমবঙ্গের গো-পাচারের করিডর পর্যন্ত দিব্যি চলে আসছে। প্রতিদিন, হাজারে হাজারে। বিজিবি-বিএসএফ মিটিংয়ের সময় বিএসএফের এক বড় কর্তার সঙ্গে এই নিয়ে কথা হচ্ছিল। তিনি বলছিলেন, ‘দোষটা চাপে আমাদের ঘাড়ে। আমরা কেন পাচার রুখি না। কিন্তু বলুন তো, এত পথ পাড়ি দিয়ে গরু-মহিষ সীমান্তে পৌঁছায় কী করে? রাজ্য সরকারগুলো, পুলিশ কী করে? কেন আটকাতে পারে না?’
হক কথা। সীমান্ত তো একেবারে শেষ ধাপ। তার আগে এত সব ধাপ গরুগুলো ডিঙোয় কী করে? এর উত্তর দেওয়ার দায় রাজ্য ও কেন্দ্রীয় সরকারের। কিন্তু উত্তর নেই। বিএসএফ একটা প্রস্তাবও সরকারকে দিয়েছে। যে যে করিডর দিয়ে গরু পাচার হয়, সেখানে সীমান্তে যেন পাট ও আখ চাষ নিষিদ্ধ করা হয়। কারণ, পাট ও আখের লম্বা খেতে গরু-মহিষদের লুকিয়ে রাখা সহজ। বিএসএফ সব সময় ঠাওর করতে পারে না। এ দুই ফসলের চাষ নিষিদ্ধ হলে সীমান্তরক্ষীদের কাজও সহজ হয়। নিষেধাজ্ঞা অবশ্য জারি করা হয়নি।
নিষেধাজ্ঞা নিয়েই এই নিবন্ধের শুরু। অতএব, সেখানেই ফিরে যাওয়া যাক। জৈন ধর্মাবলম্বীরা বছরের এই সময়টায় ‘পযুর্সান’ বলে একটা পরব পালন করেন। এই সময়টায় আট দিন ধরে তাঁরা উপবাস করেন। শরীর ও মনের শুদ্ধকরণ উৎসব। ১৯৯৪ সালে মহারাষ্ট্রের বৃহন্মুম্বাই পুরসভা পযুর্সানের সময় দুই দিনের জন্য মাংস বিক্রি নিষিদ্ধ রাখতে কসাইখানাগুলো বন্ধ রাখার একটা প্রস্তাব দিয়েছিল। ১০ বছর পরে কংগ্রেস-এনসিপি সরকার নিষেধাজ্ঞার মেয়াদ বাড়িয়ে চার দিন করে। আর এই বছর কসাইখানা বন্ধ রাখার পাশাপাশি খোলাবাজারে মুরগির মাংস বিক্রিও বন্ধ রাখার নির্দেশ দেওয়া হয়। বিজেপি-শাসিত পুরসভাগুলোর কেউ কেউ আবার পযুর্সানের আট দিনই মাছ-মাংস-ডিম বিক্রি নিষিদ্ধ করতে নির্দেশ দেন। পরে অবশ্য মাছ ও ডিমকে ছাড় দেওয়া হয়। মাস কয়েক আগে এই সরকারই রাজ্যে গরুর মাংস নিষিদ্ধ করেছিল। সে জন্য রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সংঘ (আরএসএস) এবং দেশের কট্টর হিন্দুত্ববাদীরা মুখ্যমন্ত্রীর পিঠ চাপড়েছে। কিন্তু এবার প্রতিরোধ শুরু হলো। শিবসেনা ও মহারাষ্ট্র নবনির্মাণ সেনা প্রবল আপত্তি জানাল। শেষ পর্যন্ত মামলা-মোকদ্দমা। হাইকোর্ট প্রশাসনিক নির্দেশের ওপর স্থগিতাদেশ দিলেন। তাঁকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে জৈনদের এক সংগঠন সুপ্রিম কোর্টে গেল। সুপ্রিম কোর্টের দুই বিচারপতি টি এস ঠাকুর ও কুরিয়েন যোসেফ আবেদন অগ্রাহ্য করে বললেন, এ ধরনের সিদ্ধান্ত হুটহাট করে নেওয়া ও চাপিয়ে দেওয়া ঠিক নয়। লোকজনকে আরও সহিষ্ণু হতে হবে। সুপ্রিম কোর্টের এই মন্তব্যে এই কারবারের সঙ্গে জড়িত মানুষ ও ধর্মনিরপেক্ষতায় বিশ্বাসীদের ধড়ে প্রাণ এসেছে বলা যেতে পারে।
গরুর মাংস নিষিদ্ধ করার পেছনে একটা কট্টর হিন্দুত্ববাদী মনোভাব যেমন আছে, তেমনি রয়েছে মুসলমানবিরোধিতা। গরু শুধু মুসলমানরাই খায় না, অমুসলমানরাও গরুর মাংসের ওপর নির্ভরশীল। এই নির্ভরশীলতার একটা সহজ কারণ হলো দাম। গরুর মাংস খাসি বা পাঁঠার মাংসের তুলনায় সস্তা। ডিম আরও সস্তা। গরিব মানুষের সস্তায় প্রোটিন এরাই জোগান দেয়। সেই অধিকার কেড়ে নেওয়ার অন্য অর্থ হলো গরিবদের ভাতে মারার ব্যবস্থা করা।
মাস দুয়েক আগে মধ্যপ্রদেশের বিজেপির মুখ্যমন্ত্রী শিবরাজ সিং চৌহান খামখেয়ালিপনার একটা অদ্ভুত নিদর্শন রাখলেন। তিনি নিজে শাকাহারী। মাছ-মাংস-ডিমের ত্রিসীমানা মাড়ান না। হঠাৎ তাঁর খেয়াল হলো, রাজ্যে সরকারি স্কুলগুলোয় মিড ডে মিলে ডিম দেওয়া হয়। যেহেতু তিনি ডিম খান না, সে জন্য কলমের এক খোঁচায় তিনি মিড ডে মিলে ডিম দেওয়া নিষিদ্ধ করে দিলেন। গরিব ঘরের ছেলেমেয়েরা যারা এক বেলা পেট পুরে খেতে পাবে বলে স্কুলে যায় এবং সেই সুবাদে কিছুটা লেখাপড়াও হয়তো শেখে (এটা রাজীব গান্ধীর অবদান), সস্তায় প্রোটিনও পায়, তাদের পেটে কোপ মারলেন শিবরাজ। আপত্তি উঠল আমলাদের মধ্য থেকেই। কিন্তু মুখ্যমন্ত্রী অনড়। এমন তুঘলকি সিদ্ধান্ত নেওয়ার পেছনে শিবরাজের যুক্তি হলো, শাকাহারী হয়েও স্বাস্থ্যবান হওয়া সম্ভব। কিন্তু তিনি এটা বুঝলেন না, সেই স্বাস্থ্যের অধিকারী হতে গেলে পকেট যত ভারী হওয়া দরকার, গরিব মানুষের পক্ষে সেই রেস্ত জোটানো সম্ভব নয়। সস্তার প্রোটিনই তাদের মুশকিল আসান।
ইন্ডিয়া মানে হিন্দুস্তান, আর হিন্দু মানেই নিরামিষাশী, মানে শাকসবজি খাওয়া মানুষ—এ রকম একটা ভ্রান্ত ধারণা কেন জানি বিশ্বে বেশ চালু। একবার ব্রাজিলে যাচ্ছি। নিউইয়র্ক থেকে ব্রাজিলের বারিগ এয়ারওয়েজের বিমানে উঠেছি। খেতে দিয়েছে। দেখি ফয়েল-মোড়া খাবারের ওপর ‘হিন্দু’ স্টিকার সাঁটা। মেঘবালিকাকে জিজ্ঞেস করলাম, এর মানে কী? বিস্মিত মেঘবালিকা বললেন, ইন্ডিয়ান মানে হিন্দুরা তো নিরামিষ খাবার খান! আমি তখন তাঁকে বোঝালাম, আমি ইন্ডিয়ান, হিন্দুও, কিন্তু আমি ঘোরতর আমিষাশী। এ কথাও বললাম, ইন্ডিয়ান মানেই হিন্দু নয়, সেখানে সব ধর্মের মানুষ থাকে। সে কথা শুনে মেঘবালিকা বোকা বোকা হাসি নিয়ে তাকিয়ে দারুণ নন-ভেজ খাবারের ট্রে এগিয়ে দিলেন। খাবারদাবারের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি আমার কাছে একটা মহা অপরাধ। আমার বিশ্বাসে আঘাত করে, এমন কিছু আমি না-ই খেতে পারি, কিন্তু আমার বিশ্বাসটা আমি অন্যের ওপর চাপিয়ে দিতেও পারি না।
এই যে রাজ্যে রাজ্যে গরুর মাংস নিষিদ্ধ করা হচ্ছে, জৈন পরবে মাংস বিক্রি বন্ধ রাখার নির্দেশ নতুনভাবে জারি করা হচ্ছে, মিড ডে মিলে ডিম বাতিল করা হচ্ছে, দেশের ইতিহাস নতুনভাবে লেখানোর উদ্যোগ চলছে, পুনে ফিল্ম ও টিভি ইনস্টিটিউটের শীর্ষপদে হিন্দুত্ববাদী আদর্শে বিশ্বাসী প্রায় অজ্ঞাতকুলশীল অনামী অকিঞ্চিৎকর এক অভিনেতাকে বসানো হয়েছে, নেহরু মিউজিয়ামের পরিচালককে ইস্তফা দিতে বাধ্য করা হলো, ইন্দিরা-রাজীব গান্ধীদের ডাকটিকিট তুলে নেওয়া হচ্ছে, সরকারি প্রকল্পগুলো থেকে কংগ্রেসের সাবেক প্রধানমন্ত্রীদের নাম ছেঁটে ফেলা হচ্ছে—সবকিছুই সেই চালচিত্রের টুকরো টুকরো অংশ, যা ধীরে অথচ নিশ্চিতভাবে ভারতের বহুত্ববাদী চরিত্রকে হিন্দুত্ববাদী একধর্মিতায় টেনে আনবে।
আজ মাংসের ওপর কোপ পড়ছে, নিষিদ্ধের তালিকায় কাল অন্য কিছু যে যোগ হবে না, তা কে বলতে পারে? স্বঘোষিত সমাজপতিদের তৈরি নৈতিক পুলিশ রাজ্যে রাজ্যে ‘ভ্যালেন্টাইনস ডে’তে উপদ্রব চালানো প্রায় নিয়ম করে ফেলেছে। মেয়েরা কোন ধরনের পোশাক পরবে, রাত কটার পর তাদের বাড়ি ফিরতে হবে, মোবাইল ফোন ব্যবহার করতে পারবে কি না, পুরুষবন্ধুর সঙ্গে বের হতে পারবে না, পার্টিতে যাবে না, হিন্দু মেয়েদের অন্তত চার-পাঁচটা করে বাচ্চার জন্ম দিতে হবে—এ ধরনের তালেবানি হুকুমের খবরও প্রায়ই শোনা যাচ্ছে। সংঘের আদর্শে দীক্ষিত নেতারা চুপ করে থাকেন। সরকারও। রাষ্ট্রের বহুত্ববাদী চরিত্রের জৌলুস এভাবেই ক্রমশ ফিকে হয়।
সুখের কথা, রুখে দাঁড়িয়েছেন ভারতের সুপ্রিম কোর্ট। নিষিদ্ধতায় অবিশ্বাসীদের শেষ ভরসা।
সৌম্য বন্দ্যোপাধ্যায়: প্রথম আলোর নয়াদিল্লি প্রতিনিধি।