মানবতার জন্য গুরুত্বপূর্ণ এ বছরে সাহসী জলবায়ু কার্যক্রমের এখনই সময়। বিজ্ঞান অকাট্য এবং বিশ্বব্যাপী স্বীকৃত। জলবায়ু সংকটকে স্থায়ী বিপর্যয় থেকে দূরে রাখতে আমাদের বৈশ্বিক উষ্ণায়ন মাত্রা ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসে সীমাবদ্ধ রাখতে হবে। এই লক্ষ্যে মধ্যশতাব্দীর মধ্যে আমাদের গ্রিনহাউস গ্যাসের নির্গমন নিট শূন্য নিশ্চিত করতে হবে। বিশ্ব অর্থনীতির প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ দেশ এটি করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। এটি উৎসাহজনক, কিন্তু আমাদের অবিলম্বে প্রতিটি দেশ, শহর, ব্যবসায়িক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানকে এই জোটে যোগ দিতে হবে এবং নিট শূন্যে রূপান্তরের জন্য দৃঢ় পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে।
এর চেয়েও জরুরি হচ্ছে সরকারগুলোর জন্য এই দীর্ঘমেয়াদি উচ্চাকাঙ্ক্ষাকে এখন দৃঢ় পদক্ষেপের সঙ্গে সামঞ্জস্য করা। কারণ, কোভিড-১৯ মহামারি কাটিয়ে উঠতে ট্রিলিয়ন ডলার একত্র করা হয়েছে। আমাদের ভবিষ্যৎ পুনর্গঠন করার সুযোগ অর্থনীতিকে পুনরুজ্জীবিত করে। এ-সংক্রান্ত কার্যক্রম গ্রহণের জন্য বিশ্বের একটি শক্তিশালী কাঠামো রয়েছে: প্যারিস চুক্তি, যেখানে সব দেশ তাদের নিজস্ব জাতীয় জলবায়ু কর্মপরিকল্পনা নির্ধারণ এবং প্রতি পাঁচ বছর অন্তর তাদের শক্তিশালী করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। পাঁচ বছরের বেশি সময় পর, কঠিন প্রমাণ দিয়ে বলা যায়, যদি আমরা কাজ না করি, তবে আমরা আমাদের গ্রহকে ধ্বংস করব। সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়ার এটাই সময়। এ কারণে জাতিসংঘ সব দেশকে নভেম্বরে গ্লাসগোতে কপ-২৬ সম্মেলনে যোগদানের জন্য আহ্বান করছে।
নতুন জাতীয় পরিকল্পনাগুলোতে অবশ্যই ২০১০ সালের স্তরের তুলনায় ২০৩০ সালের মধ্যে বিশ্বব্যাপী গ্রিনহাউস গ্যাস দূষণ কমপক্ষে ৪৫ শতাংশ হ্রাস করতে হবে। ইতিমধ্যে অনেক উপস্থাপন করা হয়েছে এবং জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবগুলোর সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে এবং নবায়নযোগ্য শক্তির ব্যবহারযোগ্যতা বাড়াতে আরও স্পষ্ট নীতি নির্ধারণ করা হয়েছে। কিন্তু এখন পর্যন্ত এই পরিকল্পনাগুলো নির্গমন ক্ষেত্রে ১ শতাংশের কম হ্রাস অর্জন করেছে। এটি মানুষ ও ধরিত্রীর জন্য একটি সত্যিকারের সতর্কবার্তা।
সামনের মাসগুলোতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আয়োজিত আসন্ন বিশ্বনেতৃত্ব শীর্ষ সম্মেলনের মধ্য দিয়ে সরকারগুলোকে নাটকীয়ভাবে তাদের লক্ষ্যমাত্রা বাড়াতে হবে, বিশেষ করে সবচেয়ে বড় নির্গমনকারী দেশগুলোকে, যারা এই সংকটের বিশাল অংশ সৃষ্টি করেছে। বিদ্যুৎ খাত থেকে কয়লা বন্ধ করা ১.৫ ডিগ্রি লক্ষ্যের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ করার ক্ষেত্রে সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। বিদ্যুৎ খাত থেকে সবচেয়ে নোংরা ও ক্ষতিকর জীবাশ্ম জ্বালানি অপসারণের জন্য দ্রুত পদক্ষেপ আমাদের বিশ্বে লড়াকু সুযোগ সৃষ্টি করেছে।
২০৩০ সালের মধ্যে বিদ্যুৎ উৎপাদনে বিশ্বব্যাপী কয়লার ব্যবহার অবশ্যই ২০১০ সালের স্তরের নিচে ৮০ শতাংশ হ্রাস করতে হবে। এর অর্থ হলো উন্নত অর্থনীতিগুলোকে অবশ্যই ২০৩০ সালের মধ্যে কয়লা পর্যায়ক্রমে বন্ধ করার প্রতিশ্রুতি দিতে হবে। অন্য দেশগুলোকে অবশ্যই ২০৪০ সালের মধ্যে এটি করতে হবে। কোথাও নতুন কয়লা কারখানা নির্মাণের কোনো সুযোগ নেই। বিশ্বব্যাপী কয়লা ব্যবহারের এক-তৃতীয়াংশ ইতিমধ্যে নতুন নবায়নযোগ্য এবং স্টোরেজ নির্মাণের চেয়ে পরিচালনা করা বেশি ব্যয়বহুল। কপ-২৬ অবশ্যই কয়লা সমাপ্তির সংকেত দেবে।
বিশ্ব যখন পরিচ্ছন্ন বায়ু ও নবায়নযোগ্য শক্তির দিকে এগিয়ে যাচ্ছে, তখন আমাদের একটি ন্যায়সংগত রূপান্তর নিশ্চিত করা অপরিহার্য। প্রভাবিত শিল্প ও অনানুষ্ঠানিক খাতের শ্রমিকদের অবশ্যই সহায়তা করতে হবে। কারণ, তাঁরা চাকরি পরিবর্তন করেন বা আবার দক্ষতা অর্জন করেন। রূপান্তর ক্ষেত্রে আমাদের অবশ্যই নারী ও মেয়েদের বিশাল ক্ষমতা উন্মুক্ত করতে হবে, যার মধ্যে শাসন ও সিদ্ধান্ত গ্রহণে সমান অংশগ্রহণ নিশ্চিত হয়।
যে দেশগুলো জলবায়ু পরিবর্তনে সবচেয়ে কম অবদান রেখেছে, তারা অনেক খারাপ প্রভাব ভোগ করছে। আমরা যদি পদক্ষেপ গ্রহণে এগিয়ে না আসি, তবে অনেক ছোট দ্বীপরাষ্ট্রের অস্তিত্ব বিলীন হয়ে যাবে। উন্নত দেশগুলোকে বার্ষিক ১০০ বিলিয়ন ডলার সরবরাহ, সংগঠিত করাসহ যে প্রতিশ্রুতিগুলো পালন করতে হবে, সেগুলো হলো: জলবায়ু অর্থের বর্তমান স্তর দ্বিগুণ করা, পুরো জলবায়ু অর্থের অর্ধেক অভিযোজনের জন্য নিয়োজিত করা, কয়লার আন্তর্জাতিক তহবিল বন্ধ করা এবং জীবাশ্ম জ্বালানি থেকে নবায়নযোগ্য শক্তিতে ভর্তুকি স্থানান্তর করা।
জুনের জি-৭ শীর্ষ সম্মেলন বিশ্বের ধনী দেশগুলোর জন্য পদক্ষেপ নেওয়ার এবং প্রয়োজনীয় আর্থিক প্রতিশ্রুতি দেওয়ার সম্ভাবনা তৈরি করেছে, যা কপ-২৬-এর সাফল্য নিশ্চিত করবে।
সরকারকেই নেতৃত্ব দিতে হবে, সিদ্ধান্ত গ্রহণকারীদের সর্বদাই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে।
জাতীয় বাজেটের ওপর খারাপ ঋণের মাত্রা ও বিশাল চাপের কথা বিবেচনা করে আমি কপ-২৬-এর মাধ্যমে সব বহুপক্ষীয় ও জাতীয় উন্নয়ন ব্যাংকগুলোকে কোভিড পুনরুদ্ধার এবং উন্নয়নশীল দেশগুলোতে স্থিতিস্থাপক অর্থনীতিতে রূপান্তরের জন্য অর্থায়নে সুস্পষ্ট নীতি গ্রহণ করতে বলছি। অনেক স্থানীয় সরকার ও বেসরকারি ব্যবসা ২০৫০ সালের মধ্যে নিট শূন্য নির্গমনের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে এবং তাদের ব্যবসায়িক মডেলগুলোর উল্লেখযোগ্য পর্যালোচনায় নিয়োজিত হয়েছে। আমি সবাইকে দৃঢ় লক্ষ্য ও নীতিনির্ধারণের আহ্বান জানাচ্ছি।
জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলা, জীববৈচিত্র্য রক্ষা, প্রকৃতির বিরুদ্ধে মানবতার যুদ্ধ বন্ধ এবং টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্য অর্জনের প্রচেষ্টা ত্বরান্বিত করার জন্য আমি সর্বত্র তরুণদের উৎসাহিত করছি।
সময় শেষ হয়ে আসছে এবং সামনে অনেক কঠিন কাজ রয়েছে। শুধু সাদা পতাকা উত্তোলনের সময় এখন নয়। জাতিসংঘ আমাদের সংহতি ও আশার নীল পতাকা ওড়াতে থাকবে। এই ধরিত্রী দিবস ও সামনের গুরুত্বপূর্ণ মাসগুলোতে আমি সব জাতি ও মানুষকে এ মুহূর্তে একত্র হওয়ার আহ্বান জানাই।
আন্তোনিও গুতেরেস জাতিসংঘের মহাসচিব