দ্বিজাতি তত্ত্বের ভূত এখনো রয়ে গেছে
১৯৯২ সালের শেষ দিকে বাংলাদেশে কিছু ঘটনা ঘটেছিল, যার ফলে পরিস্থিতি ছিল বেশ উত্তপ্ত। কলকাতা থেকে প্রকাশিত সাপ্তাহিক দেশ ম্যাগাজিনে নীরদ সি চৌধুরীর একটি প্রবন্ধ ছাপা হলো। এই লেখায় তিনি ‘তথাকথিত বাংলাদেশ’ শব্দ দুটি উল্লেখ করেছিলেন। আর যায় কোথায়! দেশের তাবৎ সাংবাদিক-বুদ্ধিজীবী তাঁর ওপর হামলে পড়লেন। তথ্যমন্ত্রী নাজমুল হুদা বিষয়টি আমলে নিতে দেরি করলেন না। দেশ দেশে নিষিদ্ধ হলো। কেউ কেউ লিখলেন, নীরদ বাবু ‘বাহাত্তরে বুড়ো’। তাঁর কথার গুরুত্ব দেওয়ার দরকার নেই।
ওই সময় প্রতিক্রিয়া জানিয়ে আজকের কাগজ-এ আমি একটি কলাম লিখেছিলাম নীরদ চৌধুরীকে সমর্থন ও সহানুভূতি জানিয়ে। আমার প্রশ্ন ছিল, বাংলাদেশ বাঙালির জাতীয় রাষ্ট্র হবে, এমন আকাঙ্ক্ষা ছিল। কিন্তু তা হয়নি। এটি বাঙালি মুসলমানের রাষ্ট্র হয়েছে। সুতরাং আক্ষেপ থাকতেই পারে। মনে পড়ে, বদরুদ্দীন উমর ১৯৭২ বা’ ৭৩ সালে ‘বাংলাদেশে জাতীয়তাবাদের ভিত্তি’ শিরোনামে একটি প্রবন্ধ লিখেছিলেন। এটিও একটি সাপ্তাহিকে ছাপা হয়। তিনি একই প্রশ্ন তুলেছিলেন। তখনো ধর্মাশ্রয়ী রাজনীতি মাথাচাড়া দিয়ে ওঠেনি। ফলে বদরুদ্দীন উমরের কুশপুত্তলিকা দাহ করতে যাননি কেউ। ঠিক ওই সময়েই আরেকটি কেলেঙ্কারি ঘটল ভারতের অযোধ্যায়। ৬ ডিসেম্বর ১৯৯২ প্রায় দেড় লাখ লোকের একটি জঙ্গি সমাবেশ ঘটল ষোড়শ শতকের বাবরি মসজিদকে ঘিরে। রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ এবং ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) আশ্রয়ে-প্রশ্রয়ে বিশ্ব হিন্দু পরিষদের ‘কর সেবকরা’ মসজিদের গম্বুজে উঠে কুড়াল দিয়ে তা ভাঙতে শুরু করে। ওই সময় ভারতজুড়ে সাম্প্রদায়িক সহিংসতায় প্রায় দুই হাজার মানুষ প্রাণ হারায়।
বিজেপির নেতা লালকৃষ্ণ আদভানির নেতৃত্বে ‘রাম জন্মভূমির’ দিকে ধাবমান রথযাত্রা সাম্প্রদায়িক সহিংসতা উসকে দিয়েছিল। ভারতে কিছু ঘটলে তার প্রভাব পড়ে আশপাশের দেশে। ঢাকায় তখন চলছে চার জাতি দক্ষিণ এশীয় ক্রিকেট টুর্নামেন্ট। ৭ ডিসেম্বর ছিল ভারত বনাম বাংলাদেশের খেলা। পাঁচ হাজার লোক রড আর বাঁশ নিয়ে স্টেডিয়ামে হামলা চালায়। ৮.১ ওভার বল হওয়ার পর খেলা পরিত্যক্ত হয়। পুলিশ কাঁদানে গ্যাস আর রাবার বুলেট ছুড়ে মারমুখী জনতাকে ছত্রভঙ্গ করে দেয়। ঘটনার এখানেই শেষ নয়। কয়েক জায়গায় দাঙ্গাকারীরা হিন্দু মন্দিরে হামলা চালায়, ভাঙচুর করে, অনেকের বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেয়। ‘মাইনরিটি অ্যাট রিস্ক’ প্রকল্পের আওতায় ইউএনএইচসিআর প্রকাশিত ‘ক্রনোলজি অব হিন্দুস ইন বাংলাদেশ’ শীর্ষক প্রতিবেদনে বলা হয়, সাম্প্রদায়িক সহিংসতায় ১০ জন নিহত এবং ১১টি মন্দির ভেঙে ফেলা হয়েছিল। ভাঙা মন্দির পুনর্নির্মাণ এবং মন্দির ধ্বংসের তদন্তের দাবিতে হিন্দু সম্প্রদায় ১৯৯৩ সালে আড়ম্বরহীনভাবে দুর্গাপূজা উদ্যাপন করেছিল।
বাংলাদেশে অমুসলমান, বিশেষ করে হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকেরা নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে এবং দেশান্তরি হচ্ছে, এ রকম একটি ভাবনা মাথায় ঢোকে। পাকিস্তান আমলে দেশ ছিল ইসলামিক রিপাবলিক। সেখানে ‘হিন্দুরা’ ছিল দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক। ১৯৬৪ সালের দাঙ্গা আমি নিজ চোখে দেখেছি। চোখের সামনে ঢাকার রায়েরবাজার কীভাবে জাফরাবাদ হয়ে গেল, তার সাক্ষী আমি। ১৯৭১ সালের কথা আমরা সবাই জানি। ভারত সরকারের হিসাব অনুযায়ী, সেপ্টেম্বরের শেষে ভারতে আশ্রয় নেওয়া বাংলাদেশের শরণার্থীর সংখ্যা ৮০ লাখে পৌঁছে। বাঙালি মাত্রই পাকিস্তানিদের আক্রমণের লক্ষ্য ছিল। তবে হিন্দু সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধেই আক্রোশ ছিল বেশি।
নিউইয়র্ক টাইমস-এ ৬ অক্টোবর ১৯৭১-এ ছাপা হওয়া সিডনি শনবার্গের একটি প্রতিবেদনে বলা হয়, মোট ৮০ লাখ ৪৫ হাজার শরণার্থীর মধ্যে ৭১ লাখ ২০ হাজার ছিল ‘হিন্দু’ (সূত্র: মহিউদ্দিন আহমদ, আওয়ামী লীগ: যুদ্ধদিনের কথা ১৯৭১, প্রথমা প্রকাশন)।
একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতার মধ্য দিয়ে সাম্প্রদায়িকতার একটি নিষ্পত্তি হবে এবং পুরোনো ধারার রাজনীতি আর জেঁকে বসবে না, এমনটাই ছিল স্বপ্ন। স্বপ্নভঙ্গ হতে দেরি হয়নি। ১৯৯৩ সালের শেষ দিকে আমি এ নিয়ে একটু গবেষণার চেষ্টা করেছিলাম। পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্যে দেখেছি, মুসলমানদের মধ্যে জন্মহার অমুসলমানদের চেয়ে বিভিন্ন ধর্ম সম্প্রদায়ভেদে ৭ থেকে ১২ শতাংশ বেশি। আমি একটি সরল হিসাব কষলাম। জন্মহার ১০ শতাংশ কমিয়ে এবং মৃত্যুহার একই রেখে দেখলাম, ‘হিন্দু’ জনসংখ্যা যা হওয়ার কথা ছিল, তার চেয়ে কম। বাংলাদেশের প্রথম আদমশুমারি হয় ১৯৭৪ সালে এবং আমার কাছে শেষ শুমারির তথ্য ছিল ১৯৯১ সালের। আমি দেখলাম, ১৯৭৪ থেকে ১৯৮১ সালের শুমারি পর্যন্ত ‘হিন্দু’ জনসংখ্যা কমেছে ১২ লাখ ২০ হাজার এবং ১৯৮১-৯১ সময়ে কমেছে ১৭ লাখ ৩০ হাজার। অর্থাৎ ১৯৭৪-৯১ সময়ে গড়ে প্রতিদিন ৪৭৫ জন হিন্দু হারিয়ে গেছে। আমার লেখাটি ‘দ্য মিসিং পপুলেশন’ নামে সাপ্তাহিক হলিডে ছাপল ৭ জানুয়ারি ১৯৭৪। এর দুই সপ্তাহ পরে, ২১ জানুয়ারি হলিডে একটি সম্পাদকীয় ছাপল ‘এক্সোডাম অব হিন্দুস’ শিরোনামে।
আমি একটি একাডেমিক কাজ করতে চেয়েছিলাম। এই হারিয়ে যাওয়া মানুষ কোথায় গেল? আমি লিখলাম, তারা দেশত্যাগ করেছে। এটাকে আমরা প্রচলিত অর্থে বলি অভিবাসন। তবে স্বেচ্ছায় দেশত্যাগ এবং জোরজবরদস্তি করে দেশ থেকে তাড়িয়ে দেওয়ার মধ্যে পার্থক্য আছে।
আমাদের পাশের দেশ ভারত। ওখানে ‘হিন্দু’রা সংখ্যাগরিষ্ঠ। বাংলাদেশের ‘হিন্দুরা’ সীমান্ত পেরোলেই ওখানে যেতে পারে। মানুষ গ্রাম ছেড়ে শহরে যায়, ছোট শহর ছেড়ে বড় শহরে যায়, দেশ ছেড়ে বিদেশে যায় একটু নিরাপদে থাকার জন্য, উন্নত জীবনের আশায়। যাঁরা ইউরোপ, অস্ট্রেলিয়া বা উত্তর আমেরিকায় গেছেন এবং থিতু হওয়ার চেষ্টা করছেন, তাঁরা তাঁদের সন্তান, নাতি-পুতিদের জন্য নিরাপদ ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করার জন্যই যাচ্ছেন। এটাকে আমরা স্বাভাবিক অভিবাসন হিসেবেই দেখি। কিন্তু ধর্মীয় ‘সংখ্যালঘু’র দেশত্যাগে অন্য একটি মাত্রা যোগ হয়, নিরাপত্তাহীনতা। যাঁদের সুযোগ ও সংযোগ আছে, তাঁরা যাচ্ছেন শিল্পোন্নত দেশগুলোতে। যাঁদের সে সুযোগ নেই, তাঁদের গন্তব্য ভারত। ওখানে গিয়েও যে তাঁরা ভালো আছেন, তা নয়। শখ করে কেউ ভিটেমাটি ছেড়ে দেশান্তরি হয় না।
বাংলাদেশের যাত্রা শুরু হয়েছিল একটি সেক্যুলার রাষ্ট্র হিসেবে। সেটি আর থাকেনি। ১৯৭৭ আর ১৯৮৮ সালে সংবিধানে কাঁচি চালিয়ে এটাকে ধর্মরাষ্ট্র বানানোর সিঁড়ি তৈরি হয়েছে। একই সঙ্গে তৈরি হয়েছে সংখ্যাগুরুর শভিনিজম। এটা শুধু বাংলাদেশেই নয়, অনেক দেশেই আছে, অনেকেই যুক্তি দেন, ভাই, ইন্ডিয়ায় তো মুসলমানদের ওপর অত্যাচার হচ্ছে, জোর করে ‘জয় শ্রীরাম’ বলাচ্ছে, পেটাচ্ছে, খুন করছে। এটা ঠিক, দক্ষিণ এশিয়ার প্রায় সব দেশই এখন ধর্মরাষ্ট্র হওয়ার প্রক্রিয়ায় আছে। কেউ আগে আছে, আর কেউ একটু পিছিয়ে। কিন্তু আমরা তো একটা ‘জনযুদ্ধ’ করে দেশ বানিয়েছি। আমরা অন্যদের মতো হব কেন। অথচ আমরা এখনো ‘সংখ্যালঘু’ শব্দটি হরহামেশা ব্যবহার করি। কী লজ্জা!
আমরা গণতন্ত্রের কথা বলি। গণতন্ত্র হলো সংখ্যাগরিষ্ঠের শাসন। কিন্তু গণতন্ত্রের পরীক্ষা হয় সংখ্যালঘুর ওপর সংখ্যাগুরুর আচরণের মধ্য দিয়ে। আমরা এ পরীক্ষায় এখনো পাস করতে পারিনি। দ্বিজাতি তত্ত্বের ভূত এখনো মাথায় রয়ে গেছে, চেতনে কিংবা অবচেতনে। লেখক-রাজনীতিবিদ আবুল মনসুর আহমদকে উদ্ধৃত করে বলা যায়। ‘প্রকৃত অবস্থাটা এই যে বাংলাদেশের স্বাধীনতায় পাকিস্তানও ভাঙে নাই। “দ্বিজাতি তত্ত্ব”ও মিথ্যা হয় নাই। এক পাকিস্তানের জায়গায় লাহোর প্রস্তাবমতো দুই পাকিস্তান হইয়াছে। ভারত সরকার লাহোর প্রস্তাব বাস্তবায়নে আমাদের সাহায্য করিয়াছে। তারা আমাদের কৃতজ্ঞতার পাত্র।...পশ্চিমা জনগণ তাদের রাষ্ট্র-নাম রাখিয়াছে “পাকিস্তান”। আমরা পুরবীরা রাখিয়াছি বাংলাদেশ। এতে বিভ্রান্তির কোনো কারণ নাই।’ (সূত্র: আমার দেখা রাজনীতির পঞ্চাশ বছর, প্রথমা প্রকাশন)।
মহিউদ্দিন আহমদ লেখক ও গবেষক
[email protected]