এখন ঘোর বিক্ষোভের কাল। বৈরুত থেকে বাগদাদ, হংকং থেকে প্যারিস, সান্তিয়াগো থেকে দিল্লি, সাওপাওলো থেকে তেহরান, সব জায়গাতেই বিক্ষোভ হয়েছে। নতুন শতকের দ্বিতীয় দশকটা বিক্ষোভের সময় হিসাবেই ইতিহাসের পাতায় ঠাঁই করে নেবে। শুরুটা হয়েছিল তিউনিসিয়ায়। সবাই এর নাম দিয়েছিল আরব বসন্ত।
এরপর বিক্ষোভের বসন্ত কেবলই দীর্ঘায়িত হয়েছে। এই বসন্তের বাতাসে বৈষম্য ও অসাম্যের রোদন। ফ্রান্সে এ সপ্তাহেও বিক্ষোভ হয়েছে। সবশেষ ভারতে কৃষি আইন পরিবর্তনের দাবিতে আন্দোলনে থাকা কৃষকেরা মঙ্গলবার প্রজাতন্ত্র দিবসে দিল্লির লালকেল্লায় আন্দোলনের ঝান্ডা উড়িয়ে দিয়েছে। এসব আন্দোলন বিভিন্ন দেশ ও সমাজে হলেও সব একসূত্রে গাঁথা। লড়াইগুলো হচ্ছে বৈশ্বিক বৈষম্যের বিরুদ্ধে, অসাম্যের বিরুদ্ধে।
ভারতের কৃষকেরা হঠাৎ করেই এতটা বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠলেন কেন? তাঁদের আচরণে অনেকেই হতচকিত হয়েছেন। কথা ছিল ট্রাক্টর নিয়ে র্যালি করে ফিরে যাবেন কৃষকেরা। কিন্তু হুট করে তাঁরা বানের জলের মতো লালকেল্লায় ঢুকতে শুরু করেন। এ ঘটনায় কে লাভবান হলো, ক্ষতির মুখে পড়ল কারা, এ নিয়ে চুলচেরা বিশ্লেষণ হবে। লালকেল্লায় নিশান সাহিব উড়িয়ে জাতীয় পতাকাকে অসম্মান করা হলো কি না, এসব নিয়েও কথা হচ্ছে। জাতীয় সংগীত, পতাকা, প্রতীক এসব জাতীয়তাবাদের চিহ্ন। কালের গর্ভে এসব চিহ্ন হারিয়ে যায়। সৃষ্টি হয় নতুন নতুন জাতীয়তাবাদ। কিন্তু মানুষের অধিকার চিরন্তন।
ভারতের কৃষকেরা চিরন্তন নাগরিক অধিকারের নিশ্চয়তা চান। ঋণের বোঝা মাথায় নিয়ে গলায় ফাঁস না, স্বাভাবিক মৃত্যুর নিশ্চয়তা চান। এখন আর প্রলেতারিয়েত নেই সমাজে। প্রেকারিয়েত (যাদের জীবিকা ও জীবনমান অনিশ্চিত) নামে নতুন এক শ্রেণির উদ্ভব হয়েছে। দেশে দেশে আন্দোলন করছে লাখো প্রেকারিয়েত । হংকং শহরেই এক দিনে ১৭ লাখ মানুষ বিক্ষোভে অংশ নিয়েছিল। গণ–আন্দোলনের মুখে কয়েকটি দেশে সরকারের পতন হয়েছে। নতুন করে জাঁকিয়ে বসেছে স্বৈরতন্ত্র। কিন্তু এত মানুষের বিক্ষোভ হচ্ছে কেন? কেউ কেউ মনে করেন, গণতন্ত্র সঠিকভাবে কাজ করছে বলেই জনগণ পথে নামতে পারছে।
বিপরীত মতও আছে। গণতন্ত্র এখন মহাসংকটে আছে। এই বিপরীত মতের অনুসারীর সংখ্যাই বেশি। নয়া উদারপন্থী গণতান্ত্রিক রীতিনীতি নাগরিকের চাহিদা পূরণ করতে পারছে না। আয়বৈষম্য বেড়ে যাচ্ছে। আয়ের সঙ্গে ব্যয়ের হিসাব কিছুতেই মেলাতে পারছে না সাধারণ নাগরিকেরা।
বিক্ষোভের কারণগুলো লক্ষ করলে দেখা যাবে, প্রতিটি বিক্ষোভের সঙ্গেই অর্থনৈতিক ইস্যু জড়িত। তিউনিসিয়াতে জীবনযাত্রার ব্যয় বৃদ্ধি, দুর্নীতি, অনিয়মের প্রতিবাদে বুআজিজি নামের এক ফেরিঅলা গায়ে আগুন দিয়েছিল। রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক নিয়মকে যদি বদলাতে না পারো, তবে নিজেকেই ক্ষোভের আগুনে পুড়িয়ে দাও।
সেই ক্ষোভের আগুনে পুড়ে খাক হয়েছিল অভিমানী আজিজি। চিলিতে গণপরিবহনের মূল্যবৃদ্ধির প্রতিবাদে আন্দোলন হয়েছে। তেহরানে গ্যাসের দাম বৃদ্ধিকে নাকচ করে বিক্ষোভ হয়েছে। ভারতে শত শত কৃষক ঋণের দায় মাথায় নিয়ে গলায় ফাঁস দিয়েছেন।
একটি কথা কিছুদিন ধরে বারবারই উচ্চারিত হচ্ছে, নয়া উদারবাদী অর্থনৈতিক কাঠামো আর কাজ করছে না। এটা কেন কাজ করছে না এবং এর পরিনতি নিয়ে আলাপ–আলোচনা করছেন গবেষকেরা। সমাজে নয়া উদারবাদী ব্যবস্থার তিনটি প্রত্যক্ষ প্রভাবকে চিহ্নিত করেছেন গবেষকেরা। এই প্রভাবগুলোই জনসাধারণকে পথে নামিয়েছে।
প্রথমত, সমাজে এখন আয় ও সম্পদের চরম বৈষম্য বিরাজ করছে। জাতিসংঘের উন্নয়ন কর্মসুচির হিসাব অনুসারে, ১৯৯০ সালের তুলনায় উন্নয়নশীল ও দরিদ্র দেশগুলোতে বৈষম্য চরম আকার ধারণ করেছে। এই দেশগুলোর সংখ্যাগরিষ্ট জনসাধারণই বৈষম্যের শিকার হচ্ছে। জাতিসংঘ সতর্ক করে দিয়ে বলেছে, এই অবস্থা চলতে থাকলে বিশ্বের দশমিক ১ শতাংশ মানুষের আয় মধ্য আয়ের ৪০ শতাংশ মানুষের আয়ের সমান হয়ে যাবে।
এর বড় উদাহরণ হতে পারে আমাদের দেশ। সম্প্রতি সানেমের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, কোভিড-১৯-এর কারণে বর্তমানে দেশে দারিদ্র্যের হার বৃদ্ধি পেয়ে ৪২ শতাংশ হয়েছে। সরকারি প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর হিসাবে, কোভিড-১৯–এর আগে দারিদ্র্যের হার ছিল ২০ শতাংশ। এক বছরে দারিদ্র্য বেড়েছে ২২ শতাংশ। কিন্তু গত এক দশকে দেশের মানুষের আয় বেড়েছে। এখন গড় আয় ২০২৪ ডলার। মাথাপিছু আয় এই পর্যায়ে বৃদ্ধির পর হুট করে এক বছরে দারিদ্র্য এতটা বৃদ্ধি পাওয়ার কথা না। ধরে নিলাম, মাথাপিছু ২০২৪ ডলার করে আয় হচ্ছে। তাহলে বাস্তব অবস্থা হচ্ছে গুটিকয় মানুষের আয় ২০২৪ ডলারের অনেক অনেক বেশি। আর কিছু মানুষের আয় একেবারেই কম। তাই দারিদ্র্যও বাড়ছে। যে কারণে কোভিড-১৯–এর ধাক্কায় ২২ শতাংশ নতুন করে দরিদ্র হয়েছে। আবার কোভিডের সময় দেশে কোটিপতির সংখ্যাও বেড়েছে। বৈদেশিক আয়ও বেড়েছে।
এই হতাশার দিন একদিন নিশ্চয়ই ফুরাবে। উনিশ ও বিশের শতক ছিল উপনিবেশবাদের বিরুদ্ধে লড়াই। জাতীয় মুক্তিসংগ্রামের যুদ্ধ। এখনো লড়াই জারি আছে। এটা হচ্ছে অর্থনৈতিক বৈষম্যের বিরুদ্ধে সংগ্রাম।
নয়া উদারবাদী অর্থনীতির ফাঁকিটাই এখানে। যদি পরিসংখ্যান ও উপাত্তের হিসাবে যান, তাহলে দেখতে পারবেন সবগুলো সূচকই ঊর্ধ্বগামী। আয় বাড়ছে, কোটিপতির সংখ্যা বাড়ছে, গরিবের সংখ্যাও বাড়ছে। এটা শুধু আমাদের দেশেই না। বা কেবলই উন্নয়নশীল ও গরিব দেশেই না। গরিবের সংখ্যা এখন উন্নত দেশেও বাড়ছে। ফ্রান্সে দুই বছর ধরে নিয়মিত বিক্ষোভ হচ্ছে। ইউরোপের অন্যান্য দেশেও একই পরিস্থিতি। নিজস্ব অর্থনৈতিক সংকট মোকাবিলা করতে না পেরেই ব্রেক্সিট বাস্তবায়ন করে পরিস্থিতি সামলানোর চেষ্টা করছে ব্রিটেন।
দশকজুড়েই সারা বিশ্বে গণ–বিক্ষোভ বেড়ে যাওয়ার আরেকটি কারণ গণতন্ত্র ক্রমেই সংকুচিত হয়ে পড়ছে। কার্নেগি এনডাওমেন্ট ফর ইন্টারন্যাশনাল পিসের হিসাব অনুসারে, ২০১৭ সাল থেকে ১১০টি দেশে ২৩০টি বিক্ষোভ হয়েছে। ৭৮ শতাংশ কর্তৃত্ববাদী সরকার বিক্ষোভের মুখে পড়েছে। এ ছাড়া কোভিড-১৯ পরিস্থিতি যথাযথভাবে মোকাবিলা করতে না–পারায় ২৫টি দেশের জনতা বিক্ষোভ করেছে।
নয়া উদারবাদী অর্থনীতির আরেকটি দিক, শাসকদের এটা গণতন্ত্রের টুঁটি চেপে ধরার সুযোগ করে দেয়। উন্নয়নের বিভিন্ন ঊর্ধ্বমুখী সূচক ও উপাত্তের আড়ালে নাগরিকের গণতান্ত্রিক অধিকার হারিয়ে যায়। উন্নয়ন না গণতন্ত্র, এ কুতর্কে লিপ্ত হয় জনসাধারণ। সর্বগ্রাসী দুর্নীতি, অনিয়ম ও অদক্ষতার কারণে জনমনে ক্ষোভও তৈরি হতে থাকে। কার্নেগি এনডাওমেন্ট ফর ইন্টারন্যাশনাল পিসের ২০১৯ সালের জরিপে দেখা যাচ্ছে, মেক্সিকোর ৮৫ শতাংশ, ৮৩ শতাংশ ব্রাজিলিয়ান, ৭০ শতাংশ তিউনিসিয়ান, ৬৪ শতাংশ দক্ষিণ আফ্রিকান ও ৬৩ শতাংশ আর্জেন্টাইন নাগরিক সরকারের কর্মকাণ্ডে অসন্তুষ্ট। অন্যান্য দেশেও দিন দিন হতাশা বাড়ছে।
কিন্তু এই হতাশার দিন একদিন নিশ্চয়ই ফুরাবে। উনিশ ও বিশের শতক ছিল উপনিবেশবাদের বিরুদ্ধে লড়াই। জাতীয় মুক্তিসংগ্রামের যুদ্ধ। এখনো লড়াই জারি আছে। এটা হচ্ছে অর্থনৈতিক বৈষম্যের বিরুদ্ধে সংগ্রাম। এই সংগ্রামে লাখো প্রেকারিয়েতদের হাত ধরে বৈষম্যহীন পৃথিবীতে নতুন এক ভোরের সূচনা হবে নিশ্চিতভাবে। বিশ্বজুড়ে কর্তৃত্ববাদী শাসনের অবসান হবে। এই দমবন্ধ করা পরিস্থিতির অবসান হতেই হবে। কিন্তু এই পথে নানা ঘাত–প্রতিঘাত আসবে। চারদিকে থাকবে ষড়যন্ত্রের বিষবাষ্প। তাই লক্ষ্যে পৌঁছানো কঠিন কিন্তু অসম্ভব না। গত পাঁচ হাজার বছরের মানবসভ্যতার ইতিহাসে এমন অনেক কঠিন লক্ষ্যে পৌঁছানোর সাফল্যগাথা লেখা আছে।
ড. মারুফ মল্লিক রাজনৈতিক বিশ্লেষক