আজ গদ্যকার্টুন লিখতে গিয়ে বিষয়ের সংকটে ভুগছি। দেশে এখন গরম বিষয় বা হট টপিক কী?
গরম নিজে একটা টপিক বটে! খুবই গরম পড়েছে। প্রচণ্ড গরম। অবস্থা চরম। প্রতিটা খারাপ জিনিসেরই একটা ভালো দিক থাকে। ইংল্যান্ডের সাবেক ক্রিকেটার কেভিন পিটারসেন বলেছেন, এবার ইংল্যান্ডে প্রচণ্ড রোদ হবে এবং প্রচণ্ড খটখটে থাকবে আবহাওয়া।
তা যদি হয়, তাহলে ভালো করবে উপমহাদেশের দলগুলো। বিশ্বকাপের আবহাওয়ার পূর্বাভাস দেখলাম। আফগানিস্তান আর পাকিস্তান খেলার সময় বৃষ্টি পাবে। বাংলাদেশের খেলাগুলো হবে রোদে ঝলসানো দিনে। কেভিন পিটারসেনের মুখে ফুলচন্দন পড়ুক।
দ্বিতীয় গরম বিষয় দেখছি, ডাকসু সহসভাপতিকে মারধর। তাঁকে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় ইফতার করতে দেওয়া হয়নি, বগুড়ায় মেরে অ্যাম্বুলেন্সে তুলে ঢাকা পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। খুবই নিষ্ঠুর একটা কৌতুক দেখলাম ফেসবুকে। নুরুকে মারা হচ্ছে কেন? কারণ সে অসুস্থ। অসুস্থ হলে মারতে হবে কেন? কারণ, মাইরের ওপরে ওষুধ নাই।
জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অসমাপ্ত আত্মজীবনী আর কারাগারের রোজনামচা বই দুটো আমি সব সময় আমার টেবিলে রাখি। তিনি অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে বলেছেন:
‘আশ্চর্যের বিষয় সরকারি দল প্রকাশ্যে গুন্ডাদের সাহায্য করত ও প্রশ্রয় দিত। মাঝে মাঝে জগন্নাথ কলেজ, মিটফোর্ড ও মেডিকেল স্কুলের ছাত্ররা শোভাযাত্রা করে বিশ্ববিদ্যালয়ের দিকে রওনা করলেই হঠাৎ আক্রমণ করে মারপিট করত। মুসলিম লীগ নেতারা একটা ত্রাসের রাজত্ব সৃষ্টি করতে চেষ্টা করছিল যাতে কেউ সরকারের সমালোচনা করতে না পারে। মুসলিম লীগ নেতারা বুঝতে পারছিলেন না, যে পন্থা তারা অবলম্বন করেছিলেন সেই পন্থাই তাদের ওপর একদিন ফিরে আসতে বাধ্য। ওনারা ভেবেছিলেন গুন্ডা দিয়ে মারপিট করেই জনমত দাবাতে পারবেন। এ পন্থা যে কোনো দিন সফল হয় নাই, আর হতে পারে না—এ শিক্ষা তারা ইতিহাস পড়ে শিখতে চেষ্টা করে নাই।’
বঙ্গবন্ধু বলছেন, ‘ওনারা ভেবেছিলেন গুন্ডা দিয়ে মারপিট করেই জনমত দাবাতে পারবেন। এ পন্থা যে কোনো দিন সফল হয় নাই, আর হতে পারে না—এ শিক্ষা তারা ইতিহাস পড়ে শিখতে চেষ্টা করে নাই।’
এরপর দেখলাম, ফেসবুক সরব ৩০ টাকার ইফতারি নিয়ে। বিএনপি নাকি ৩০ টাকার ইফতার পার্টির আয়োজন করেছিল। ছেলেপুলে হিসাব কষে দেখিয়েছে, পার্টিতে ইফতার আছে ৩৮ টাকার। আর পানির বোতলের ১৫ টাকা যোগ করলে দাঁড়ায় ৫৩ টাকা। কাজেই বিএনপির হিসাবে ভুল আছে। আমি বরং বলব, ভুল হলেও তারাই বিতর্কে জেতে, কারণ তাতে প্রমাণিত হয়, ৩০ টাকায় ইফতার হয় না।
ওবায়দুল কাদের বলেছেন, ইফতার নিয়ে আপত্তি থাকলে, খালেদা জিয়ার কষ্ট হলে আমরা অতিরিক্ত ব্যবস্থা করব। ইফতার নিয়ে রাজনীতি হবে, এটা প্রত্যাশা করা যায় না।
এ বিষয়ে আমার প্রেসক্রিপশন হলো, বঙ্গবন্ধুর লেখা কারাগারের রোজনামচা বইটা যেন কর্তৃপক্ষ বারবার পড়ে। বঙ্গবন্ধু কারাগারের কষ্ট নিয়ে তার প্রতিকার দাবি করে অনেক কিছু লিখেছেন।
এরপর গরম বিষয় দেখছি, প্রকৌশলীর স্ত্রীর এত সম্পদ! আমি নিজে একজন প্রকৌশলী! এই বিষয় নিয়ে কথা বলতে আমার লজ্জা লাগে। শুধু বলি, আমরা যখন প্রথম বর্ষে প্রথম প্রথম ক্লাসে যাই, তখন স্যাররা আমাদের জিজ্ঞেস করতেন, তোমরা কে কে স্ট্যান্ড করেছ। পুরো ক্লাস দাঁড়িয়ে যেত। স্যাররা বলতেন, তোমরা হচ্ছ ক্রিম অব দ্য ক্রিম। তোমাদের ছেঁকে আমরা বের করে এনেছি। চার বছর পড়ার পরে প্রকৌশলীদের একাংশ এত ধরা খায় কেন। দুদক এক প্রকৌশলী আর তাঁর স্ত্রীর বিরুদ্ধে মামলা করেছে। তাঁদের আয়ের সঙ্গে সম্পদ মেলে না। প্রকৌশলীর স্ত্রী আবার
পেশায় গৃহিণী!
অবশ্য খবরটা পড়ে দেখলাম, তিনি ঠিক বিএসসি ইঞ্জিনিয়ার না, ডিপ্লোমা। যা–ই হোক, প্রকৌশলী তো। এর আগে বালিশের দাম নিয়ে মাত্র একজনকে দায়ী করে প্রত্যাহার করা হয়েছে, তিনিও প্রকৌশলী। আপনাদের মনে থাকার কথা, এক–এগারো সরকারের সময় ট্রুথ কমিশন গঠিত হয়। অবৈধ অর্থের ওপরে কর দিয়ে নিজেদের তুলসীপাতা ধোয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছিল। যাঁরা এই সুযোগ নেন, তাঁদের প্রায় সবাই ছিলেন প্রকৌশলী। সরকার বদল হওয়ার পর প্রত্যেকের চাকরি চলে যায়, তাঁদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়। আমার প্রশ্ন হলো, ক্রিম অব দ্য ক্রিমেরা ধরা পড়েন কেন! এমন কী হয়ে গেছে যে সমাজের অন্য পেশাজীবীরা সবাই ধোয়া তুলসীপাতা? সব পাখি যদি একই কাজ করে, প্রকৌশলী পাখিরা কেন ধরা পড়ে!
কৌতুক দিয়ে শেষ করি। একজন ডাক্তার, একজন প্রকৌশলী আর একজন রাজনীতিবিদ বাহাস করছে। পৃথিবীর আদিতম শাস্ত্র কোনটি?
ডাক্তার বলল, ডাক্তারি। পৃথিবীতে মানুষের জন্ম হলো, এটা তো একটা ডাক্তারি বিষয়।
ইঞ্জিনিয়ার বলল, তারও আগে ইঞ্জিনিয়ারিং কাজ হয়েছে। মহাবিশ্বে ছিল বিশৃঙ্খলা। পুরো ব্যাপারটাকে সুন্দর করে চক্রাকারে সাজানো হলো, এই কাজ তো ইঞ্জিনিয়ারিং।
তখন রাজনীতিবিদ গম্ভীর মুখে বলল, বিশৃঙ্খলাটা কে তৈরি করেছিল?
আনিসুল হক: প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক ও সাহিত্যিক