এমন একটা সময় ছিল, যখন বাসাবাড়ি কিংবা অ্যাপার্টমেন্টটি শহরের কোন জায়গায় অবস্থিত, সেখান থেকে ছেলেমেয়েদের লেখাপড়ার স্কুল-কলেজ কত দূরে, বাজার কাছে-পিঠে কি না—এগুলোর ওপর ভিত্তি করে তরতর করে বেড়ে যেত প্রতি স্কয়ার ফুট জায়গার মূল্য। জনসাধারণের পছন্দের তালিকায় থাকত এসব। কিন্তু এখন দিন বদলাচ্ছে। অ্যাপার্টমেন্ট পছন্দ করার ক্ষেত্রে সেটি কোন জায়গায় তার থেকে বছরজুড়ে শক্তির অপচয় কম হয় কি না এবং শহুরে টেকসই শক্তির উন্নতির তালিকায় আছে কি না—সেটিই এখন জনসাধারণের কাছে বেশি দেখার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। এককথায় এর গ্রহণযোগ্যতা বাড়ছে। আর এই তথ্যটি পাঁচ বছর ধরে অস্ট্রেলিয়ার বিখ্যাত মেলবোর্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থাপত্য ও পরিকল্পনা অনুষদের একদল গবেষক তাঁদের গবেষণায় প্রমাণ করেছেন।
তাঁরা শক্তির অপচয়ের ওপর ভিত্তি করে আবাসন খাতকে সংখ্যা অনুযায়ী এক থেকে সাত পর্যন্ত বিভিন্ন ধরনের রেটিংয়ে ভাগ করেছেন এবং এই রেটিং সংখ্যা বাড়ি বিক্রির সময় অবশ্যই সাইনবোর্ডে উল্লেখ থাকতে হবে, যা স্থানীয় কর্তৃপক্ষের বাঁধাধরা নিয়ম। যে স্থাপনার রেটিং যত বেশি, তার বিক্রয়মূল্যও তত বেশি এবং এসব বাড়ির প্রতি জনসাধারণের আগ্রহও বেশি। তাঁদের ধারণামতে, এই গবেষণায় প্রাপ্ত ফল ভবিষ্যতে তাঁদের অঞ্চলের আবাসনগুলোতে ডেভেলপার এবং ক্রেতাদের মধ্যে টেকসই প্রযুক্তি ব্যবহারে আরও আকৃষ্ট করবে। বিশেষজ্ঞদের মতে, শিগগিরই নীতিমালায় আবাসনসমূহের ক্ষেত্রে কমপক্ষে ছয় মাত্রার রেটিং থাকা বাধ্যতামূলক করা হবে। এ ক্ষেত্রে তাঁরা শুধু এখনকার কথা চিন্তা করছেন না, ভাবছেন আগামী ১০০ বছরের কথা। আমাদের দেশেও এমন চিন্তা করার সময় এসেছে বৈকি। তবে চিন্তা করতে হবে আমাদের নিজেদের মতো করে। প্রয়োজন আবাসনশিল্পে দেশীয় প্রযুক্তির সঠিক ব্যবহার এবং দিকনির্দেশনা।
আরেকটি প্রযুক্তিতে চোখ রাখা যাক। বিশ্বের বেশ কিছু বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রী নতুন একটি প্রযুক্তি নিয়ে প্রায় অনেক দিন ধরেই কাজ করে আসছিল। সম্প্রতি কয়েকটি প্রাইভেট কোম্পানি এসব প্রযুক্তি বাজারজাত করার কথা ভাবতে শুরু করেছে। সেটি হলো রাস্তার মধ্যবর্তী রোড ডিভাইডারের মাঝখানে ছোট সাইজের টারবাইন স্থাপন এবং সেখান থেকে স্বয়ংক্রিয়ভাবে বিদ্যুৎ উৎপাদন।
বিষয়টিকে আরও সহজভাবে বোঝানো যাক। বড় বড় রাস্তায় যেখানে দুই দিক থেকে যানবাহন চলাচল করে, স্বভাবতই সেখানে বাতাস তৈরি হয়। আর রোড ডিভাইডারে স্থাপিত টারবাইনের পাখাগুলো সেই দুই দিক থেকে আসা বাতাসে অনবরত ঘুরতে থাকে। আর তখনই স্বয়ংক্রিয়ভাবে সেখানে বিদ্যুৎ উৎপন্ন হয়। তাঁদের ধারণামতে, এমন ৩০০টি টারবাইন বছরজুড়ে প্রায় কয়েক হাজার ছোট আবাসনের জন্য বিদ্যুৎ উৎপন্ন করতে সক্ষম। আমাদের দেশেও যে এমন পরিকল্পনা হচ্ছে না, তা নয়। বাংলাদেশের প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে হরহামেশাই এমন অনেক সহজ কিন্তু বাস্তবমুখী পরিকল্পনার খবর পাওয়া যায় জাতীয় দৈনিকগুলোতে।
এবার আসা যাক আমাদের দেশের একটি উদ্ভাবনের কথায়। বুয়েট থেকে তড়িৎ প্রকৌশলে গ্র্যাজুয়েশন শেষ করে বাইরের দেশে যাওয়ার সব ধরনের সুযোগ থাকা সত্ত্বেও নিজ দেশেই থেকে গেলেন চট্টগ্রামের ছেলে নিলয় দাশ। চোখে স্বপ্ন দেশের জন্য এমন কিছু একটা করা, যার মাধ্যমে দেশ উপকৃত হবে। দেশের সম্পদকে সঠিকভাবে ব্যবহার করতে পারবেন।
ভর্তি হলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সোলার ইনস্টিটিউটে উচ্চতর ডিগ্রির জন্য। কোথাও চাকরি না খুঁজে নিজেই কয়েকজন বন্ধুকে সঙ্গে নিয়ে গড়ে তুললেন নিজেদের উদ্ভাবনী প্রতিষ্ঠান, যা বর্তমানে বিভিন্ন স্থাপনার শক্তি সাশ্রয়ের কাজ করে যাচ্ছে এবং নবায়নযোগ্য শক্তিকে কীভাবে আমাদের দেশে সঠিকভাবে ব্যবহার করা যায়, সেগুলো নিয়ে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলেও রয়েছে তাঁদের পদচারণ।
সম্প্রতি তাঁর সঙ্গে যখন দেখা হলো, মোবাইল বের করে তাঁদের নতুন উদ্ভাবনের ভিডিওটি দেখালেন। এর জন্য নাকি তাঁরা দেশের বাইরের অর্থের সাহায্যও পেয়েছেন। দেশের বাইরে এটি প্রদর্শনের জন্য ডাকও পাচ্ছেন। তাঁরা খুব কম খরচে সহজে বহনযোগ্য একটি বায়োগ্যাস প্ল্যান্ট তৈরি করেছেন, যার ওজন মাত্র ১০ কেজি। তাঁদের প্ল্যান্টটি মাত্র দুই ঘণ্টায় যেকোনো জায়গায় স্থাপন করা যায়, যেখানে একটি সাধারণ প্ল্যান্ট বসাতে প্রায় সাত দিন সময় লাগে। এতে পিভিসি পাইপ এবং প্লাস্টিক ব্যবহার করা হয়েছে। এই প্ল্যান্ট বাসাবাড়ির বর্জ্য থেকে প্রায় তিন সপ্তাহের মধ্যে পচন প্রণালির মাধ্যমে গ্যাস উৎপন্ন করবে খুব সাধারণভাবে এবং অত্যন্ত কম খরচে, যা রান্না থেকে শুরু করে ঘরবাড়ির অন্যান্য কাজে ব্যবহার করা সম্ভব।
কথা বলে জানতে পারলাম, ঘরবাড়ির বর্জ্য যেগুলো চারদিকে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকে, পরিবেশ নোংরা করে, এগুলো কীভাবে লাভজনকভাবে কম খরচে বাসায় ব্যবহার করা যায়, সেই চিন্তা থেকেই তাঁদের এই উদ্ভাবন। দেখে গর্বে মনটা ভরে উঠল। ভবিষ্যতে প্লাস্টিকের পরিবর্তে অন্য কোনো বিশেষ ব্যাগ গ্যাস সংরক্ষণের জন্য ব্যবহার করা যায় কি না, সেটির চিন্তাও তাঁদের মাথায় রয়েছে। তাই তাঁরা দেশে পাটের পলিথিন আবিষ্কারে নতুন একটি সম্ভাবনার মুখ দেখছেন। সেই সঙ্গে কষ্টও পেলাম, যখন শুনলাম দেশের বাইরে তাঁদের এই কাজের কদর বাড়ছে ঠিকই, কিন্তু দেশের মধ্যে এখনো সেই সুযোগ সৃষ্টি হয়নি। তবে আশা, একদিন দেশে এ প্রযুক্তির মাধ্যমে তাঁরা কিছু সুফল আনবেনই।
শুধু নিলয় একা নন, এই বাংলাদেশে প্রতিবছর অনেক নতুন প্রযুক্তির উদ্ভব হয়। কিন্তু বিকাশ হয় না, অঙ্কুরেই ঝরে যায়। ল্যাবরেটরিতেই সেসব প্রযুক্তির অকালমৃত্যু ঘটে প্রয়োজনীয় উদ্যোগের অভাবে। কোটি কোটি টাকা খরচ করে প্রতিনিয়ত ব্যবহার করছি বাইরের প্রযুক্তি। অথচ আমাদের সামগ্রিক টেকসই উন্নয়নে দেশীয় প্রযুক্তির ভূমিকা অনেক। আমরা কি পারি না আমাদের দেশীয় প্রযুক্তিকে নিজেদের কাজে আরও বেশিমাত্রায় ব্যবহার করতে? প্রয়োজন শুধু সদিচ্ছা আর পৃষ্ঠপোষকতার।
সজল চৌধুরী চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থাপত্য বিভাগের সহকারী অধ্যাপক