দেখি না কী হয়
ঢাকায় ক্যাসিনোতে জুয়া খেলা চলছিল, খবরটায় চমকিত হলাম। কারণ জুয়ার আসর আর ক্যাসিনোর গ্যাম্বলিংয়ের মধ্যে তফাত আছে। জুয়ার আসর জমাতে সে রকম জাঁকাল কোনো জায়গা লাগে না।
ছোটবেলায় দেখেছি, ভরদুপুরে রাস্তার পাশে রেনট্রিগাছের নিচে ট্রাকচালকেরা বসে তাস পেটাচ্ছেন। গামছার ওপর ফেলছেন বিভিন্ন অঙ্কের নোট। পরে বুঝেছি ওটাই জুয়া। কাজেই প্রচলিত জুয়া রাস্তার ধার থেকে অভিজাত মহলেও বসে। আর ক্যাসিনো বসে উচ্চশ্রেণির আখড়ায়। সেখানে যন্ত্রের মাধ্যমে লাখো টাকার বাজি চলে। ঢাকার কয়েকটি ক্লাব ও নির্দিষ্ট স্থানে যে জুয়ার আসর বসে, এটা জানতাম। কিন্তু ক্যাসিনোর কথা কখনো শুনিনি।
আমেরিকার লাস ভেগাস বা মরক্কোর কাসাব্লাঙ্কার সঙ্গে ক্যাসিনো কথাটা যেমন ঐতিহ্যের লেবাস বহন করে, ঢাকার বহু পুরোনো খানদানের সঙ্গে ক্যাসিনো ঠিক যায় না। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে প্রসিদ্ধ ক্যাসিনোগুলোতে মদের ফোয়ারা নামে, চলে নগ্ননৃত্য। মায়ের-ভাইয়ের ভালোবাসায় বেড়ে ওঠা আমাদের কি এসব করা সাজে?
কিন্তু বাস্তবতা নির্মম। চোখা সত্য বেরিয়ে এসেছে। ঢাকায় বিভিন্ন ক্লাবের ছদ্মাবরণে চলা চারটি ক্যাসিনো বন্ধ করে সিলগালা করা হয়েছে। উদ্ধার করা হয়েছে বিপুল পরিমাণ মদ ও টাকা। একটি ক্যাসিনোর পেছনে জড়িত থাকার অভিযোগে গ্রেপ্তার করা হয়েছে যুবলীগের নেতা খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়াকে। একই সঙ্গে আরও অনেককে গ্রেপ্তার করা হয়। তবু ভাগ্যিস, কোনো নর্তকী পাওয়া যায়নি!
আজই আবার সংবাদমাধ্যমের টাটকা খবর, পুলিশ পাহারায় চলত এসব জুয়া। খবরে বলা হয়, নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর একাধিক কর্মকর্তা বলেন, রাজধানীর অনেক ক্লাবের প্রচলিত জুয়ার আসরকে আধুনিক যন্ত্রপাতি ও উপকরণে সজ্জিত করে ক্যাসিনোতে রূপান্তরিত করেন একদল নেপালি। জুয়া চালাতে তাঁদের ভাড়া করে আনেন আওয়ামী লীগ, যুবলীগ ও স্বেচ্ছাসেবক লীগের কিছু নেতা-কর্মী। মূল টাকা চলে যেত নেতাদের পকেটে। জুয়ার কারবার নির্বিঘ্ন করত পুলিশ প্রশাসন। সরষের ভেতর ভূত থাকলে আমরা আমজনতা যাব কোথায়?
আমাদের দেশের প্রচলিত আইনে জুয়া খেলা দণ্ডনীয় অপরাধ। এতে জেল-জরিমানার বিধান রয়েছে। কাজেই জুয়ার প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে সহযোগিতা করা ব্যক্তিরা কি দায় এড়াতে পারবেন?
মাদকদ্রব্য আর কিশোর গ্যাংয়ের মতো জুয়াও যদি সারা দেশে বিষবৃক্ষের ডালপালা মেলে, তবে কি আর রক্ষা আছে? এর বিধ্বংসী ক্ষমতা সর্বগ্রাসী।
জুয়াড়ি নিয়ে একটা কৌতুক আছে। এক জুয়াড়ি রোজ ক্যাসিনোর স্লট মেশিনে রাতভর জুয়া খেলে বিরসমুখে বাসায় ফেরে। সাতসকালেই বউ তাকে কথার কাঁটা দিয়ে মোরব্বার মতো কেঁচে ফেলে। তবু নেশা কাটে না জুয়াড়ির। একদিন জুয়াড়ির কপাল খুলে গেল। ভোরে ছুটতে ছুটতে বাসায় এসে হাজির। ঘুমন্ত বউকে ঝাঁকুনি দিয়ে ঘুম থেকে ডেকে তুলে বলল, ‘তোমার যা আছে, ঝটপট গুছিয়ে নাও। আমি এইমাত্র ১ লাখ পাউন্ড বাজি জিতেছি।’
বউ তো মহাখুশি। মিছেই এত দিন স্বামীকে চোপার ওপর রেখেছে। জুয়ায় এমন দান মারা স্বামী কজন নারীর ভাগ্যে জোটে! এখন নিশ্চয়ই তাকে নিয়ে কোথাও বেড়াতে যাবে।
আবেগে বিগলিত হয়ে বউ বলল, ‘তা গরম কাপড় নেব, না হালকা কাপড় নেব?’
জুয়াড়ি বলল, ‘তোমার মন যা চায় তা-ই নাও। চাইলে উত্তর মেরুতে যাওয়ার প্রস্তুতিও নিতে পারো। কারণ তোমার সঙ্গে আর থাকছি না। তোমাকে দুপুরের মধ্যে এ বাসা ত্যাগ করতে হবে।’
এ তো গেল জুয়ায় জিতে বউ পরিত্যাগ করার কাণ্ড। তবে জুয়ায় হেরে বউ খোয়ানোর ঘটনাও আছে। হিন্দু পুরাণে আছে, পঞ্চপাণ্ডবদের একজন যুধিষ্ঠির কুটিল শকুনির সঙ্গে পাশা খেলায় হেরে স্ত্রী দ্রৌপদীসহ রাজ্যপাট হারিয়ে ছিলেন। পুরাণ বাদেই জুয়ায় হেরে বউ খোয়ানোর ঘটনা বাস্তবে কম ঘটেনি। খবরের কাগজে এমন সংবাদ বহুবার এসেছে।
জুয়ায় হারজিত যা-ই ঘটুক না কেন, পরিণতি সর্বনেশে। জুয়া খেলে টাকাপয়সা, ঘরবাড়ি, সহায়সম্পদ হারিয়েছেন, এমন নজির ভূরি ভূরি।
নন্দিত কথাশিল্পী হুমায়ূন আহমেদ তাঁর ‘হোটেল গ্রেভার ইন’ বইয়ে ক্যাসিনোর শহর লাস ভেগাস সফরের সময় তিক্ত অভিজ্ঞতা অর্জনের বর্ণনা দিয়েছেন। একটা অধিবেশনে যোগ দিতে সেখানে যান তিনি। ওই সময় এক প্রফেসরের পাল্লায় পড়ে স্লট মেশিনের হাতল টানাটানি করেছিলেন। তাঁর পকেটের সত্তর ডলার নিমেষে সাফ।
বিখ্যাত রুশ লেখক ফিওদোর দস্তয়েভস্কি জুয়াড়ি সম্পর্কে বলেছেন, ‘একজন জুয়াড়ি ডানে-বামে না তাকিয়ে ২৪ ঘণ্টা একঠায় বসে থাকতে পারে।’ নিজের বাস্তব অভিজ্ঞতা থেকেই এ কথা বলেছেন দস্তয়েভস্কি। তিনি নিজেও জুয়াড়ি ছিলেন। আর এ অভিজ্ঞতা থেকেই লিখেছেন ‘দ্য গাম্বলার’ উপন্যাস।
একজন জুয়াড়ি যদি ২৪ ঘণ্টা জুয়া নিয়েই পড়ে থাকে, তাহলে তাকে আর কাজকর্ম করে খেতে হবে না। উচ্ছন্নে যাবে ঘরসংসার।
আমাদের দেশ বিপুল মানবসম্পদের বিশাল খনি। বিশ্বের অনেক দেশে বস্তুগত সহায়সম্পদের অভাব নেই, কিন্তু মানবসম্পদের অভাবে উন্নয়ন থেমে থাকে। মন খারাপ করে তারা অঢেল অর্থের বিনিময়ে দক্ষ-অদক্ষ মানবসম্পদ আমদানি করে। আর আমাদের দেশে মানবসম্পদের রোশনাই থাকা সত্ত্বেও কিছু লোক অলস বসে জুয়া খেলে অঢেল টাকা ওড়াবে, ভাবতে কষ্ট হয়।
কারণ এখনো এ দেশের বেশির ভাগ মানুষ কায়ক্লেশে দিন গুজরান করেন। অনেক মানুষ দুবেলা দুমুঠো অন্ন জোগাতে গায়ের রক্ত পানি করে দেন। সংসারের দৈন্য ঘোচাতে অনেক মা-বাবা শেষ সম্বলটুকু বেচে প্রিয় সন্তানকে বিদেশে পাঠান। এখানে তাঁরাও জুয়া খেলেন। শখের বশে টাকা ওড়াতে নয়, ভাগ্য বদলাতে জীবনের সঙ্গে জুয়া খেলেন তাঁরা। এ জুয়ায় কখনো আসে নির্মম হার। দালালের খপ্পরে পড়ে হয় ছেলেটি বিদেশে কোনো কারাগারে পচেন, নয় তো ফেরেন নিথর লাশ হয়ে।
টাকার অভাবে যেখানে মায়ের কোল ছেড়ে একটি শিশুকে ফিরে আসতে হয় মাদকসেবী বাবার কাছে, বাবার নির্মম পিটুনিতে যেতে হয় হাসপাতালে, সেখানে কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা বেহুদা ওড়াতে দেখলে কষ্ট লাগা স্বাভাবিক।
তবে আশার কথা এই যে, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান এ ব্যাপারে কঠোর অবস্থান নিয়েছেন। তিনি বলেছেন, প্রশাসনের কেউ যদি এখানে জড়িত থাকেন, বা কারও বিরুদ্ধে যদি সহযোগিতার প্রমাণ পাওয়া যায়, তবে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তাঁরা বিচারের মুখোমুখি হবেন।’
চারপাশে একের পর এক এভাবে কত ঘটনা ঘটে যাচ্ছে, আমরা শুধু দেখি। দেখা আর শোনা ছাড়া কীই–বা করার আছে? অবস্থা অনেকটা সুশীল চক্রবর্তীর কৌতুকের সেই নাদান গৃহকর্তার মতো। থানায় চুরির বিষয়ে ডায়েরি করতে গেছেন কর্তা। বর্ণনা দিচ্ছেন চোর কী কী করল। দারোগা বলছেন, ‘আপনি চোরকে ধরলেন না কেন?’ কর্তা উত্তর, ‘আমি তো তখনো ভাবছি, দেখি না কী করে?’
আমরাও শুধু চাক্ষুষ অভিজ্ঞতা অর্জন করি আর ভাবি, দেখি না কী হয়!
শরিফুল ইসলাম ভূঁইয়া: প্রথম আলোর সহকারী বার্তা সম্পাদক ও সাহিত্যিক।
[email protected]