দেখা ভোট, শোনা ভোট, না দেখা ভোট
সকাল আটটায় ভোট গ্রহণ শুরু। গতকাল সকাল নয়টায় মগবাজার দিলু রোডের প্রভাতী স্কুলের ভোটকেন্দ্রে গিয়ে দেখলাম, লাইন দিয়ে ভোটাররা ভেতরে ঢুকছেন। তখনো শীতের রেশ ছিল। কারও গায়ে চাদর, কারও গায়ে জ্যাকেট। গেটের বাইরে ও ভেতরে পুলিশ-আনসারদের সতর্ক পাহারা। একজন প্রৌঢ় ভদ্রলোক বাইরে দাঁড়িয়ে আছেন। তাঁকে জিজ্ঞেস করি, ভোট দিয়েছেন কি না। বললেন, তাঁর স্ত্রী ভোট দিতে ভেতরে গিয়েছেন। ফিরে এলে যিনি ভোট দেবেন, তাঁর কাছে সেলফোন আছে বলে পুলিশ যেতে দিচ্ছে না।
একজন পুলিশ সদস্যকে জিজ্ঞেস করলাম, তাঁকে যেতে দিচ্ছেন না কেন? টেলিফোন নিয়ে যেতে তো কোনো বাধা নেই। সেটটি অফ করে গেলেই হলো। এরপর তাঁকে ভেতরে যেতে দেওয়া হলো। ভেতরে গিয়ে দেখা গেল, নৌকা ছাড়া অন্য কোনো প্রার্থীর এজেন্ট নেই। প্রিসাইডিং কর্মকর্তা বললেন, যেসব প্রার্থী এজেন্ট দিয়েছেন, তাঁরা সবাই আছেন। কোনো প্রার্থীর এজেন্ট না এলে তাঁরা কী করতে পারেন? তাঁর বক্তব্যের সঙ্গে প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) নূরুল হুদার কথা হুবহু মিলে যায়। তিনি উত্তরা ৫ নম্বর সেক্টরের আইইএস স্কুল কেন্দ্রে ভোট দিতে যান বেলা পৌনে ১১টার দিকে। সাংবাদিকেরা জানতে চান, কেন্দ্রে কেন ধানের শীষের কোনো এজেন্ট নেই? জবাবে সিইসি বলেন, তাঁরা (ধানের শীষের এজেন্ট) না এলে তিনি কী করতে পারেন?
মগবাজার থেকে আমরা হেঁটে যাই বাংলামোটর। সেখানে তিনটি নির্বাচনী আসনের সংযোগস্থল। দক্ষিণে ঢাকা-৮, পশ্চিমে ঢাকা-১০ ও উত্তরে ঢাকা-১২। নৌকার তিন জাঁদরেল প্রার্থী—স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান, সমাজকল্যাণমন্ত্রী রাশেদ খান মেনন ও আইনজীবী ফজলে নূর তাপস। ধানের শীষে তাঁদের প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন যথাক্রমে সাইদুল আলম নীরব, সাবেক মন্ত্রী মির্জা আব্বাস ও সাবেক প্রতিমন্ত্রী আবদুল মান্নান। ঢাকা-১২ আসনে গণতান্ত্রিক বাম জোটের প্রার্থী জোনায়েদ সাকি। এর মধ্যে নীরব ছাড়া সবাই কমবেশি সরব ছিলেন।
কাজী নজরুল ইসলাম অ্যাভিনিউ পার হয়ে ইস্টার্ন প্লাজার পশ্চিম পাশে ধানমন্ডি উচ্চবিদ্যালয় কেন্দ্রে যাই। সেখানে তখন ভোটারদের লম্বা লাইন। ভেতরে গেলাম। ‘শান্তিপূর্ণ’ ভোট হচ্ছে। কেন্দ্রের বাইরে স্লিপ দেওয়ার জন্য বেশ কটি বুথ নৌকার। ভেতরে ভোটারদের পাশাপাশি নৌকার ব্যাজ পরা নেতা-কর্মীরাও আছেন। বুথে ধানের শীষের এজেন্ট আছেন কি না জানতে চাইলে দুজন এজেন্ট নিজেদের নৌকা ও লাঙ্গলের প্রতিনিধি বলে দাবি করে বললেন, ধানের শীষের প্রতিনিধিও ছিলেন। কোথাও গেছেন হয়তো। মেহেরুন্নেসা স্কুল ও আইডিয়াল কলেজ কেন্দ্রেও প্রায় একই চিত্র। কোথাও ধানের শীষের কোনো এজেন্ট নেই। কেউ বলেন, এসেছিলেন, থাকতে পারেননি। কেউ বলেন, তাঁরা ভয়ে আসেননি।
এর মধ্যে চট্টগ্রাম, রংপুর, বরিশাল, জামালপুর থেকে পরিচিতজন টেলিফোন করে সেখানকার পরিস্থিতি জানান তাঁদের মতো করে। জামালপুরের সরিষাবাড়ী থেকে একজন জানালেন, সেখানে আরামবাগ কামিল মাদ্রাসা ও বলারদিয়া প্রাইমারি স্কুল কেন্দ্রে সকাল ১০টার মধ্যেই ভোট হয়ে গেছে। এই আসনে ধানের শীষের কোনো প্রার্থী নেই। তারপরও নৌকার সমর্থকেরা আশ্বস্ত হতে পারেননি। চট্টগ্রাম থেকে একজন চাকরিজীবী টেলিফোনে জানান, তাঁরা চট্টগ্রাম-১১ আসনের ভোটার। তিনি ভোট দিতে পারলেও তাঁর স্ত্রী ভোট দিতে পারেননি। সেখানে তাঁরা যাওয়ার পর বলা হয়েছে, আপনারা চলে যান। চট্টগ্রাম-১০ আসনে লালখান বাজারে নির্বাচনের দায়িত্বে নিয়োজিত একজন কর্মকর্তা বলেন, ‘আপনার ধানের শীষে ভোট দিলে আমরা ঝুঁকি নিতে পারব না।’ কুড়িগ্রাম থেকে এক শিক্ষক বন্ধু বললেন, এখানের একটি কেন্দ্রে দেখা গেছে যে ভোট পড়েছে, তা তালিকাভুক্ত ভোটের চেয়ে বেশি।
এরই মধ্যে খবর এল মালিবাগ ও মগবাজারের কিছু কেন্দ্রে গোলযোগ হয়েছে। আমাদের একজন প্রতিবেশী বললেন, তেজগাঁওয়ে একজন ধানের শীষ সমর্থককে গণপিটুনি দিয়েছেন নৌকার সমর্থকেরা। পরে নারী ভোটাররা তাঁকে উদ্ধার করেন।
বেলা একটায় গণফোরাম অফিসে ড. কামাল হোসেন জরুরি সংবাদ সম্মেলন ডাকেন। পথে বিএনপি অফিসের সামনে বেশ জটলা। গাড়ি থামিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, কী হয়েছে। বিএনপির ১৫-১৬ জন কর্মী রাস্তায় দাঁড়িয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করলেন, বিভিন্ন কেন্দ্র থেকে আমাদের বের করে দেওয়া হয়েছে। তাঁরা সংবাদমাধ্যমের প্রতি ক্ষোভ প্রকাশ করে বললেন, আপনারা তো আমাদের কথা লেখেন না। প্রচার করেন না। তিনতলায় উঠতেই সম্মেলনকক্ষে সাংবাদিকদের ভিড়। ১২টায় এক দফা ব্রিফিং হয়ে গেছে। পাশের রুমে জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বসে আছেন। তাঁকে ঘিরে আছেন বেশ কয়েকজন দলীয় নেতা-কর্মী। বললেন, বিভিন্ন স্থান থেকে কেন্দ্র দখল ও হতাহতের খবর পাওয়া যাচ্ছে। আমাদের ছয়জন কর্মী নিহত হয়েছেন।
সেখানেই অবস্থান করছিলেন ঢাকা-৩-এ ধানের শীষের প্রার্থী গয়েশ্বর রায়। মাথায় ব্যান্ডেজ। তিনি বললেন, সকালে কেরানীগঞ্জে নিজের ভোটকেন্দ্রে গিয়ে দেখলাম, আমাদের সব কর্মীকে বের করে দিয়েছে। বিএনপির কাউকেই সেখানে ঢুকতে দিচ্ছে না। প্রতিবাদে আমি ভোট না দিয়েই চলে এসেছি। যদি বিকেলে ভালো পরিবেশ দেখি যাব। ভোট দেব। না হলে ভোট দেব না। যেখানে আমার কর্মীরা ভোট দিতে পারেননি, সেখানে আমি কী করে ভোট দিই?
গণফোরাম অফিসে গিয়ে দেখি কামাল হোসেন সাংবাদিকদের সারা দেশের ভোট পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করছেন। তিনি ক্ষোভের সঙ্গে বললেন, স্বৈরাচারী এরশাদের আমলেও এ রকম নির্বাচন হয়নি। বিরোধী দলের এজেন্ট দূরের কথা, ভোটারদেরও কেন্দ্রে যেতে দেওয়া হয়নি। স্বাধীনতার ৪৭ বছর পর এটি দেখতে হবে, ভাবতেও কষ্ট হয়। সারা দেশে ক্ষমতাসীন দল ত্রাস সৃষ্টি করেছে, দেশের মালিকানা হাতছাড়া হয়ে গেছে।
একজন বিদেশি সাংবাদিক তাঁকে জিজ্ঞেস করেন, নির্বাচন নিয়ে আপনি হতাশ কি না। জবাবে কামাল হোসেন বলেন, শুধু হতাশ নয়, মর্মাহত। অভিধানে এর চেয়েও কঠিন শব্দ থাকলে লিখুন। সেখানে গণফোরামের দুই প্রার্থী সুব্রত চৌধুরী ও মোস্তফা মহসিন মন্টু নিজ নিজ আসনের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করে বলেন, কোথাও ভোট হয়নি। ইভিএমের নামে তামাশা করা হয়েছে। সেখানে উপস্থিত গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের সভাপতি ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী বললেন, আজকের (রোববার) ভোট ছিল ছলনাময়ী। বাইরে সুন্দর পরিবেশ। ভেতরে যাচ্ছেতাই অবস্থা।
গণফোরাম অফিস থেকে আমরা সোজা চলে যাই বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউতে আওয়ামী লীগ অফিসে। অফিসের নিচে বেশ কয়েকজন দলীয় কর্মী বসে গল্প করছিলেন। জিজ্ঞেস করলাম, কেমন ভোট হচ্ছে? তাঁরা বললেন, খুব ভালো ভোট হচ্ছে। ওপরে আওয়ামী লীগের কোনো নেতা আছেন কি না। তাঁরা বললেন, নেতা নেই। আমরা কর্মীরা আছি। বললাম কর্মীরাই তো ভবিষ্যতের নেতা। তাঁরা বললেন, দোয়া করবেন।
সেখান থেকে আমরা জাতীয় প্রেসক্লাবে গেলাম। সেখানেও নির্বাচন নিয়ে জোর আলোচনা চলছে। ঘুরেফিরে ঢাকা-১ নির্বাচনী আসনের প্রসঙ্গ এসেছে। একজন সাংবাদিক বন্ধু বললেন, জয়ের জন্য প্রার্থীরা নানা কৌশল নিয়ে থাকেন। কিন্তু তাই বলে একটি টেলিভিশনের সম্প্রচার বন্ধ করে দিতে হবে? এটি কী রকম কৌশল? ওই আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থী সালমা ইসলামের বিরুদ্ধে নৌকা নিয়ে নির্বাচন করছেন সালমান এফ রহমান। তিনি আবার বেসরকারি টেলিভিশন মালিকদের সংগঠন অ্যাটকোর সভাপতি। আলোচনা চলতেই খবর এল সালমা ইসলাম প্রার্থিতা প্রত্যাহার করে নিয়েছেন।
বিএনপির সমর্থক হিসেবে পরিচিত একজন সাংবাদিক বন্ধু জানান, শান্তির নির্বাচন তবে, সেই শান্তি দুই পক্ষের জন্য নয়। যাঁরা ক্ষমতায় আছেন, তাঁদের জন্য।
প্রেসক্লাব থেকে সহকর্মী অরুণ কর্মকারকে নিয়ে ধানমন্ডিতে আওয়ামী লীগের সভানেত্রীর অফিসে গিয়ে দেখি, নেতা-কর্মীদের বেশ ভিড়। সেখানে সাংগঠনিক সম্পাদক মোজাম্মেল হক, কেন্দ্রীয় নেতা ডা. মোস্তফা জালাল মহিউদ্দিন, সহদপ্তর সম্পাদক বিপ্লব বড়ুয়া, প্রধানমন্ত্রীর উপ-প্রেস সচিব আশরাফুল আলম খোকন, উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক আরিফা রুমাসহ অনেকেই ছিলেন। নির্বাচন নিয়ে কথা উঠতেই তাঁরা বললেন, ‘সারা দেশে সুষ্ঠু পরিবেশে ভোট হয়েছে। বিএনপি বলে আমরা সন্ত্রাস করছি, কিন্তু আজ আমাদের ১২ জন নেতা-কর্মীকে হত্যা করা হয়েছে। বিএনপির কজন নিহত হয়েছে?’
আওয়ামী লীগ অফিস থেকে বের হতেই ভোট গ্রহণের সময় শেষ। তখন বিতর্ক চলছিল কোন দল কতটি আসন পাবে তা নিয়ে।
এ হলো গতকাল চোখে দেখা ও কানে শোনা ভোটের কিছু খণ্ডিত চিত্র। এ দেখা ও শোনার বাইরেও ভোটের অনেক অবিশ্বাস্য চিত্র দেশি-বিদেশি বিভিন্ন সংবাদমাধ্যম তুলে ধরেছে।
সোহরাব হাসান: প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক ও কবি
[email protected]