দূষিত নগরীতে রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ির মহোৎসব
শৈশবে একটি খেলা খুব পছন্দ ছিল আমাদের। খেলাটির নাম আমরা দিয়েছিলাম ‘কাটাকাটি খেলা’। খাতার পাতা সামান্য ফাঁকা পেলেই সেখানে শুরু করতাম কাটাকাটির খেলা। প্রথমে খাতার পাতায় পেনসিল কিংবা কলম দিয়ে ৯ ঘরবিশিষ্ট চৌকোনা বাক্স আঁকতাম; এরপর শুরু হতো ক্রস কিংবা গোল চিহ্ন দিয়ে ঘরগুলো পূরণের যুদ্ধ। অত্যন্ত সহজ-সরল এই খেলায় প্রয়োজন হতো মাত্র দুজন খেলোয়াড়। দৈর্ঘ্যে, প্রস্থে কিংবা কোনাকুনিভাবে ক্রস কিংবা গোল চিহ্ন যে প্রথম মেলাতে পারত, সে-ই খেলায় বিজয়ী হতো। কাগজ ও পেনসিল ছাড়া আর কিছুরই প্রয়োজন হতো না সেই খেলায়। সম্পূর্ণ বিনিয়োগবিহীন এই খেলায় সন্তানকে আনন্দ লাভ করতে দেখে মা-বাবাও খুশি থাকতেন।
কাটাকাটির সেই খেলা আজও পিছু ছাড়েনি আমার। কিন্তু আজ আর আমি খেলোয়াড় নই। বরং অন্য এক কাটাকাটির খেলার এক নীরব দর্শক আমি কিংবা আমার মতো অনেকেই। এই খেলা এখন আর আনন্দ দেয় না আমাদের। এই খেলার নাম রাস্তা কাটাকাটির খেলা, যা আমাদের নগরজীবনকে অভিশপ্ত করে তুলেছে। মহানগরের রাজপথে আর অলিগলিতে প্রতিবছর চলে রাস্তা কাটাকাটির মহোৎসব। এই খেলার কুশীলবেরা কিন্তু আমাদের মতো সাধারণ কেউ নন। বরং তাঁরা হলেন সিটি করপোরেশন, টিঅ্যান্ডটি, ওয়াসা, গ্যাস কিংবা বিদ্যুৎ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের অত্যন্ত ক্ষমতাবান ব্যক্তিরা। তাঁরা বলেন, নগরবাসীর উন্নয়নের জন্যই এই রাস্তা কাটাকাটি বা খোঁড়াখুঁড়ি। উন্নয়নের এই খেলা বছর বছর চলতেই থাকে; কিন্তু উন্নয়ন নামের সোনার হরিণ আর ধরা দেয় না নাগরিক জীবনে। উন্নয়নের এই খেলায় বিনিয়োগ কম নয়। কিন্তু সেই বিনিয়োগের সুফল পায় না নগরবাসী।
কোনো নোটিশ ছাড়াই রাস্তাঘাট কোন উন্নয়নের স্বার্থে ফি বছর খোঁড়াখুঁড়ি করা হয়, সে সম্পর্কে নেই সংশ্লিষ্টদের কোনো ব্যাখ্যা কিংবা জবাবদিহি। সকালে যে পথে কর্মস্থলে যাওয়া হয়, সন্ধ্যায় সেই পথ ধরে যে ফিরে আসা যাবে, সে রকম কোনো নিশ্চয়তা নেই। যার যখন খুশি রাস্তা কেটে-খুঁড়ে সংস্কার কিংবা উন্নয়নকাজ পরিচালনা করছে। সিটি করপোরেশন, টিঅ্যান্ডটি, ওয়াসা, তিতাস গ্যাস কিংবা বিদ্যুৎ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের মধ্যে নেই কোনো সমন্বয়। যদি এই সব উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের প্রতিফলন নগরবাসী দেখতে পেত, তা হলেও সান্ত্বনা মিলত। কিন্তু বাস্তবতা এই যে এসব হয়রানি প্রতিবছর সয়েও নগরবাসীর ভাগ্যের কোনো পরিবর্তন আসে না। মহানগরগুলোর উন্নয়নে নেই কোনো মাস্টারপ্ল্যান। ফলে একই রাস্তা বারবার কাটাছেঁড়া করা হয়। ভাঙা রাস্তাটির পাশ গলে পানির লাইনটির সংস্কার করা হলেও একই সময়ে সমন্বয়ের মাধ্যমে ভাঙা রাস্তাটি সংস্কারের কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করা হয় না। গ্যাসের লাইন কিংবা পয়োনিষ্কাশনের লাইনটিও যে একই সঙ্গে তদারকি করা যেতে পারে, সে বিষয়ে নেই কারও মাথাব্যথা। উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের ফলাফল এতটাই ক্ষণস্থায়ী হয় যে তা নগরবাসীর ভাগ্যে কোনো দীর্ঘস্থায়ী পরিবর্তন আনে না।
দিন দিন বসবাসের অনুপযুক্ত হয়ে উঠছে রাজধানী ঢাকা। ঢাকার শ্রী হারানোর বিষয়টি বড্ড বেশি প্রকট হয়ে উঠছে আজকাল। গ্রিন ঢাকা আর ক্লিন ঢাকা নির্মাণের প্রতিশ্রুতির ব্যানার ময়লার ভাগাড়ের পাশ থেকে উঁকি দেয়। রাস্তাজুড়ে স্বয়ং সিটি করপোরেশনের গাড়ি ময়লা ফেলতে ফেলতে দাপিয়ে বেড়ায়। একদিকে সীমাহীন যানজট আর অন্যদিকে নোংরা ময়লা রাস্তাঘাট যেন আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে ফেলছে নগরবাসীর জীবন। প্রায় ২ কোটি মানুষের প্রতিদিনের বর্জ্যের ভার নিতে নিতে ঢাকা শহর আজ ক্লান্ত। ইতিমধ্যে বিশ্বের সবচেয়ে বেশি বায়ুদূষণের শিকার শহরের একটিতে পরিণত হয়েছে ঢাকা।
দূষিত নগরীতে খোঁড়াখুঁড়ির বেড়াজালে বন্দী হয়ে এভাবে আর কতকাল থাকব আমরা? বছর বছর রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ির খেলা থেকে এবার মুক্তি পেতে চাই। খুব অসুস্থতায় কিংবা অন্তিমযাত্রায় প্রিয় স্বজনের অ্যাম্বুলেন্সটি যেন নির্বিঘ্নে পাড়া-মহল্লার গলি পেরিয়ে এগিয়ে যেতে পারে, অন্তত সেই নিশ্চয়তাটুকু চাই।
নিশাত সুলতানা: লেখক ও গবেষক
[email protected]