‘শরণার্থী’ শব্দটি সব যুগে সব দেশেই একধরনের অস্বস্তি, উৎকণ্ঠা ও আতঙ্কের জন্ম দিয়েছে। মানুষ হিসেবে তাদের অস্তিত্ব আছে, নেই পরিচয়। তারা নিশ্চয়ই কোনো না কোনো দেশের নাগরিক, কিন্তু নেই সে নাগরিকত্বের স্বীকৃতি। বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের ক্ষেত্রেও আমরা তা-ই দেখি। অবশ্য আমাদের দেশে শরণার্থীর সংখ্যা নিতান্তই নগণ্য! মাত্র ৩৫ হাজার ৫১৯ জন (দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইট অনুযায়ী)। সরকার কর্তৃক ‘শরণার্থী’ হিসেবে স্বীকৃতির নমুনাস্বরূপ পাওয়া কার্ডটি তাদের জীবনযাপনকে (আপাতদৃষ্টিতে) নির্বিঘ্ন করেছে অনেকাংশে। কিন্তু আশ্রয় নেওয়াদের মধ্যে তাদেরই স্বজাতির আরও ১১ লাখ মানুষ এখানে আছে। যারা শরণার্থী হয়েও শরণার্থী নয়। নানা জটিলতা ও অনিশ্চয়তায় জীবনযাপন করতে হচ্ছে তাদের।
রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দান থেকে শুরু করে প্রয়োজনীয় সহায়তা দেওয়ার মাধ্যমে বাংলাদেশ বিশ্বে মানবিকতার অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। এমনকি মহামারিকালে রোহিঙ্গাদের দেশ মিয়ানমারে যখন তাদের টিকা কার্যক্রমের বাইরে রাখা হয়েছে, বাংলাদেশ তখন রোহিঙ্গাদের টিকা প্রদানের কাজ শুরু করেছে এবং সেই কার্যক্রমে বয়স্ক রোহিঙ্গাদের অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে। এসব উদ্যোগ মানবিকতার দৃষ্টিতে প্রশংসনীয় ও অনুসরণীয় হলেও রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে যে আরও কিছু প্রয়োজন, তা বুঝতে হয়তো আমাদের দেরিই হয়েছে। কেননা মানবিকতা, সেটি রাষ্ট্র পর্যায়ে হোক কিংবা স্থানীয় জনগণের উদার ব্যক্তি উদ্যোগেই হোক—এমন বিপুলসংখ্যক জনগোষ্ঠীর চাহিদা যেমন বছরের পর বছর পূরণ করতে পারে না, তেমনি স্থানীয় বাসিন্দা যাঁরা মানবিকতা দেখান, সেটিও এক সময় ফিকে হয়ে আসে।
মিয়ানমারে জাতিগত নির্মূলের অভিযানের শিকার হয়ে রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে পালিয়ে আসার চার বছর পর যে প্রশ্ন অনিবার্যভাবে চলে আসে তা হলো, এরপর কী হবে? একদিকে রোহিঙ্গাদের জন্য মানবিকতার নিদর্শনমূলক নানা আয়োজন, অন্যদিকে ক্যাম্পের ভেতর কঠোর নিরাপত্তার মধ্যে একের পর এক হত্যাকাণ্ড, যা বরাবরই রয়ে যাচ্ছে বিচার প্রক্রিয়ার বাইরে।
রোহিঙ্গাদের প্রতি উদারতায় ভাটার প্রকাশ ক্রমশ স্পষ্টতর হয়ে উঠছে। স্থানীয় জনগণ তো বটেই, রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে পর্যন্ত স্বীকার করা হচ্ছে যে রোহিঙ্গারা পরিবেশ নষ্ট করছে, নারী ও শিশু পাচার, মাদক পাচারসহ নানা ধরনের অপরাধমূলক কাজে যুক্ত হচ্ছে, এমনকি তারা বাংলাদেশের জন্য একটি বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে। যদিও চার বছর আগের বক্তব্যের সম্পূর্ণ বিপরীত, তবে বিদ্যমান পরিস্থিতিতে এ ধরনের বক্তব্য অস্বাভাবিক নয়। মূলত অতীতে রোহিঙ্গাবিষয়ক সিদ্ধান্ত, দূরদর্শিতার বদলে নীতিনির্ধারকদের একপেশে কর্তৃত্ব ও ক্ষমতা দিয়ে কতটুকু প্রভাবিত হয়েছিল, সে প্রশ্ন চলে আসে। এ প্রশ্নের উত্তরই বলে দেবে, কেন আজ রোহিঙ্গাদের বোঝা মনে হচ্ছে।
কী পরিহাসের বিষয় যে ১৯৭৮ সাল থেকে আজ অবধি একটিও আলোচনা বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের মধ্যে হয়নি, যার ফলাফল হিসেবে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের জন্য ইতিবাচক পদক্ষেপ নেওয়া সম্ভব হয়েছে। অথচ প্রতিবার আলোচনা ও বৈঠকে মিলিত হতে পেরেই যেন আমরা তৃপ্তির ঢেকুর তুলেছি। এমনকি এ বছরের ফেব্রুয়ারিতে মিয়ানমারে সামরিক শাসন জারির প্রারম্ভেও কেউ কেউ অত্যুৎসাহী হয়ে ধরেই নিয়েছিল, এই বুঝি সামরিক সরকার নিজেদের বৈধতা লাভের উদ্দেশ্যে রোহিঙ্গা ইস্যুকে পুঁজি করে তাদের প্রত্যাবাসনের ঘোষণা দেবে। আবার মিয়ানমারের ঐক্য সরকার কর্তৃক রোহিঙ্গাদের স্বীকৃতি দানের মধ্যেও অনেকে আশান্বিত হয়েছে, এই ভেবে যে এবার সত্যিই রোহিঙ্গারা ফিরে যাবে।
কিন্তু বাস্তবে কুতুপালংয়ের রোহিঙ্গারা কুতুপালংয়ে রয়ে গেল। শরণার্থী না হয়ে তারা পরিচিতি হলো এফডিএমএন (ফোর্সিবলি ডিসপ্লেসড মিয়ানমার ন্যাশনালস) হিসেবে। প্রত্যাবাসন বা তৃতীয় কোনো দেশে পুনর্বাসন, কোনোটিই ঘটল না। অদ্ভুত ব্যাপার হলো, সরকারিভাবে তাদের শরণার্থী বলা না হলেও যেসব আন্তর্জাতিক সংস্থা সেখানে কাজ করছে, তাদের কাছে রোহিঙ্গারা শরণার্থী। খোদ শরণার্থী কমিশনারের কার্যালয়ের নামেও ‘শরণার্থী’ শব্দটি আছে। তবু ২০১৭ সালে যারা মিয়ানমার থেকে এসেছে, তারা শরণার্থী নয়। রোহিঙ্গাদের এফডিএমএন হিসেবে অভিহিত করায় না হলো বাংলাদেশের লাভ, না হলো রোহিঙ্গাদের লাভ। বরং ‘শরণার্থী’ পরিচয় পেলে তৃতীয় দেশে পুনর্বাসনের সুযোগ সন্ধান করা যেত প্রত্যাবাসনের চেষ্টা অব্যাহত রেখেই। তৃতীয় দেশে পুনর্বাসনের সুযোগ করা হলে মিয়ানমার আর কখনোই রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেবে না, এ ধরনের উদ্ভট যুক্তি দেখানো হলো। অথচ ভাসানচরে রোহিঙ্গাদের স্থানান্তর হলো। এতে মিয়ানমার কী বার্তা পেল তা যেমন বলার অপেক্ষা রাখে না, তেমনি মিয়ানমারের পৃষ্ঠপোষক রাষ্ট্রগুলোও কতটুকু সন্তুষ্ট হলো, তা-ও বোঝার বাকি থাকে না।
মানবিকতার পাশাপাশি দূরদর্শিতা নিয়ে এমন কোনো নীতি রোহিঙ্গাদের জন্য বাংলাদেশে গ্রহণ করা হয়নি, যা বর্তমানে বাংলাদেশে অবস্থানরত রোহিঙ্গাদের হত্যার বিচার করতে এবং মিয়ানমারকে নিজ দেশের মানুষকে ফিরিয়ে নিতে বাধ্য করতে পারত। পেঁয়াজ থেকে আইস—বৈধ বা অবৈধ সব পথেই বাণিজ্য অব্যাহত রেখে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন নিয়ে মিয়ানমারের সঙ্গে কথা বলা অর্থহীন।
রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন কোনো আন্তর্জাতিক সংস্থার দায়িত্ব নয়। সরকার নির্দেশ দিলে তারা কাজ গুটিয়ে চলে যেতে বাধ্য। অবশ্য উখিয়ার মতো স্থানে নর্থ এন্ডের কফি শপের অবস্থান রোহিঙ্গা প্রতিপালনে তাদের দৃঢ় অবস্থানেরই ইঙ্গিত দেয়। কিছুদিন পর পর বাংলাদেশের পক্ষ থেকে তাদের কার্যক্রম বন্ধ করে দেওয়ার কথা বলা হলেও তাদের গ্রহণ করা টেকসই কর্মসূচি উদ্বোধন কিংবা অনুমোদন বাংলাদেশ সরকারের সমর্থনেই হয়ে থাকে। ক্যাম্প এলাকায় বেড়া দেওয়া হলে কিংবা ভাসানচরে রোহিঙ্গাদের স্থানান্তর করা হলে, তাদের উৎকণ্ঠা ও দুশ্চিন্তার প্রকাশ ঘটে। কিন্তু মিয়ানমারের সঙ্গে এ বিষয়ে কথা বলা তাদের ‘ম্যান্ডেট’ নয়। কাজেই রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের দায়িত্ব বাংলাদেশেরই।
প্রত্যাবাসন সিদ্ধান্তে মিয়ানমারের প্রধানতম পৃষ্ঠপোষক চীনের সঙ্গে বাণিজ্যিক সম্পর্ক অব্যাহত থাকলেও রোহিঙ্গা নিয়ে ফলপ্রসূ আলোচনা সুদূরপরাহতই রয়ে গেল। জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ থেকে চীনকে সরানোর সামর্থ্য বাংলাদেশের না থাকলেও চীনের সঙ্গে অন্তত রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে ফিরিয়ে নেওয়ার জন্য কৌশলগত আলোচনা করা যেতে পারত। কারণ, কুতুপালং থেকে ভাসানচরে এক লাখ রোহিঙ্গাকে সরিয়ে নিলে আন্তর্জাতিকমহলের কেউ কেউ খুশি হলেও এটি যে রোহিঙ্গা সমস্যাকে জটিলতর করবে, তা সহজেই অনুমেয়।
আমরা দেখতে পারছি, উখিয়ার ঘন জঙ্গল ন্যাড়া মাথা হয়ে গিয়েছে, সুলভে (রোহিঙ্গা) শ্রমিক পাওয়ায় স্থানীয় বাসিন্দাদের রোজগারে ভাটা পড়েছে কিংবা সন্ত্রাসী কার্যক্রমে রোহিঙ্গারা অংশ নিচ্ছে। এ পর্যন্ত গৃহীত ও অকার্যকর সিদ্ধান্তগুলোই কি এফডিএমএন তথা রোহিঙ্গা শরণার্থীদের সে পথে ঠেলে দেয়নি? ৪ বছরে ১০৮ জন রোহিঙ্গা হত্যার কোনো বিচার না হওয়ায় মুহিবুল্লাহ হত্যার বিচার না হওয়াটাও কি স্বাভাবিক নয়? কে করবে এ বিচার? কোন আইনের আওতায় হবে সে বিচার? রোহিঙ্গাদের জন্য কোনো জাতীয় আইনগত কাঠামো না থাকায় উখিয়ায় সেপ্টেম্বরে একজন এফডিএমএন নেতা হত্যার বিচার অনিশ্চিত হওয়ায় ভবিষ্যতে এ-জাতীয় ঘটনা আরও ঘটার পথ যে প্রশস্ত হলো, তারই প্রমাণ মেলে ক্যাম্পের ভেতর আবার রোহিঙ্গা হত্যার ঘটনায়।
বিশ্বব্যাংকের ৫৯০ মিলিয়ন ডলারের অনুদান প্রদানের আশ্বাস নিয়ে শরণার্থীবিষয়ক প্রতিবেদন প্রকাশ, রোহিঙ্গাদের ‘ত্রাণ ও জীবনমান উন্নয়নের’ জন্য আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর নিত্যনতুন প্রকল্প ও কর্মসূচি গ্রহণ, ‘মুহিবুল্লাহ হত্যা গোটা দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়াকে অশান্ত করবে’ মর্মে বিশেষজ্ঞদের ভবিষ্যদ্বাণী প্রদান এবং বাংলাদেশের ক্রমাগত মানবিকতার দৃষ্টান্ত হয়ে ওঠার ভাষ্যের মধ্যে একটি হত্যাকাণ্ডের রেশ কাটতে না কাটতেই ক্যাম্পের ভেতর আরও ছয়জনকে হত্যা। ক্যাম্প ও তৎসংলগ্ন এলাকায় জনবল ও নিরাপত্তা বেড়ে চলেছে আর ক্যাম্পের ভেতর একটির পর একটি মর্মান্তিক ঘটনা ঘটছে। অস্ত্রধারী সন্ত্রাসীদের অস্তিত্ব কর্তৃপক্ষ স্বীকার না করলেও ক্যাম্পের ভেতর ‘কিছু দুর্বৃত্তের’ অস্তিত্বের স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। এ দুর্বৃত্তায়ন কি রোধ করা এতই কঠিন যে জীবন বাঁচাতে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের রুটিন অনুযায়ী কিছুদিন পরপর জীবন হারাতে হবে? এবং তারপর কিছুদিন মাঠ-মঞ্চ গরম করা কিছু বক্তব্য প্রদান করা হবে, আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো ‘যথাযথ ও সুষ্ঠু তদন্ত ও বিচারের দাবিতে’ বিবৃতি দেবে কিন্তু অবস্থা তথৈবচ রয়ে যাবে?
বাংলাদেশের অন্যতম জনপ্রিয় চোরাচালান রুট ও অপরাধপ্রবণ এলাকা হিসেবে খ্যাত উখিয়া-টেকনাফে খোদ এ দেশীয় চোরাচালানি ও অপরাধীদের বিচরণ ও কার্যক্রম যখন প্রকাশ্যে ঘটমান, তখন কিছু রোহিঙ্গা সেখানে ব্যবহৃত হবে বা নিজ উদ্যোগে সেসব ঘটনার অংশীদার হবে, এমনটা বিচিত্র নয় মোটেও। দুঃখজনক হলেও সত্য যে মানবিকতার পাশাপাশি দূরদর্শিতা নিয়ে এমন কোনো নীতি রোহিঙ্গাদের জন্য বাংলাদেশে গ্রহণ করা হয়নি, যা বর্তমানে বাংলাদেশে অবস্থানরত রোহিঙ্গাদের হত্যার বিচার করতে এবং মিয়ানমারকে নিজ দেশের মানুষকে ফিরিয়ে নিতে বাধ্য করতে পারত। পেঁয়াজ থেকে আইস—বৈধ বা অবৈধ সব পথেই বাণিজ্য অব্যাহত রেখে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন নিয়ে মিয়ানমারের সঙ্গে কথা বলা অর্থহীন। বাংলাদেশ দুর্বল নয়, কিন্তু রোহিঙ্গা ইস্যুতে উদারতা ও মানবিকতা দেখানোর পাশাপাশি বাংলাদেশের দূরদর্শী সবল দিকটি বোধ করি প্রকাশ করার সময় হয়েছে।
ইশরাত জাকিয়া সুলতানা সহকারী অধ্যাপক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান ও সমাজবিজ্ঞান বিভাগ এবং সদস্য, সেন্টার ফর পিস স্টাডিজ, নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়।