সেদিন বগুড়ায় ওই বিষয়েই কথা হচ্ছিল। পৌরসভা নির্বাচনের ফলাফল জানার পর অনেকেরই কৌতূহল সৃষ্টি হয়েছে। গণমাধ্যমের খবর এ রকম যে, বিএনপির দুর্গ ‘লন্ডভন্ড’ করে দিয়েছে আওয়ামী লীগ। জিয়াউর রহমানের জন্মস্থান বগুড়ায় এবার নয়টি পৌরসভার মেয়র পদের
মধ্যে একজন বিদ্রোহী প্রার্থীসহ পাঁচটি পদ পেয়েছে আওয়ামী লীগ। আর একজন বিদ্রোহী প্রতিদ্বন্দ্বীসহ চারটিতে জয়লাভ করেছে বিএনপি। ২০১১ সালের নির্বাচনে এই জেলায় মাত্র দুটি পৌরসভা আওয়ামী লীগ দখলে নিতে পেরেছিল। এবার অতিরিক্ত তিনটি মেয়র পদ ছিনিয়ে নিয়েছে তারা।
ওদিকে জেলার শিবগঞ্জে ৪২ বছর পর নৌকা প্রতীক নিয়ে এবারই প্রথম কোনো প্রার্থী জয়লাভ করলেন। ২০০৮ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সারা দেশে বিএনপির ভরাডুবি হলেও বগুড়ায় বিএনপির অবস্থান ছিল শক্ত। জেলার সাতটি আসনের পাঁচটিই পেয়েছিল তারা। এ ছাড়া গত উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে জেলার ১২টি উপজেলার সব কটিতেই বিএনপি জয়ী হয়। বিএনপির এমন ইস্পাতদৃঢ় দুর্গ কি এবার সত্যি সত্যিই নড়বড়ে হয়ে গেল? বগুড়ায় এ নিয়ে চলছে ব্যাপক আলোচনা। সারা দেশের রাজনীতিসতর্ক মানুষের আগ্রহও কম নয়।
২ জানুয়ারি বগুড়া সরকারি শাহ্ সুলতান কলেজ চত্বরে বেশ কয়েকজন অধ্যাপকের সঙ্গে এ ব্যাপারে আমার কথা হয়। শাহ্ সুলতান কলেজের অধ্যাপক সামছুল হক মণ্ডল, শাহ মোহাম্মদ আব্দুললাহেল কাফি ও আবদুল গোফ্ফার ছাড়াও সেখানে ছিলেন সরকারি আজিজুল হক কলেজের অধ্যাপক রেজাউন নবী, নূরুল ইসলাম খান ও বিদ্যুৎ কুমার সাহা। কথা হয় নন্দীগ্রাম মনসুর হোসেন ডিগ্রি কলেজের অধ্যাপক সাহেদুল্লাহ বিলু ও বগুড়া বাঘোপাড়া শহীদ দানেশউদ্দীন কলেজের অধ্যাপক সাজ্জাদুল আলমসহ আরও অনেকের সঙ্গেই।
নির্বাচনী ফলাফলের পেছনের কারণ হিসেবে সরল কোনো মতামত পাওয়া না গেলেও একটি ব্যাপারে প্রায় সবাই একমত পোষণ করেছেন। তাঁরা বলছেন, বগুড়ার সাধারণ মানুষের মধ্যে রাজনৈতিক বিশ্বাসের ক্ষেত্রে একটা পরিবর্তনের আভাস মিলছে এবার। এ পরিবর্তনের হাওয়া তাহলে দেশের সবচেয়ে বড় পৌরসভা বগুড়া শহরের মানুষের গায়ে লাগল না কেন? সেখানে তো দ্বিগুণের বেশি ভোটে জিতেছেন বিএনপি প্রার্থী?
এ প্রশ্নের জবাবে অধ্যাপকেরা দুটি বিষয়ের উল্লেখ করেন। প্রথমত তাঁরা বলছেন, বগুড়া পৌরসভার আওয়ামী লীগ প্রার্থীর জন্য দলের সবাই এককাট্টা হয়ে কাজ করেছেন, এমনটি তাঁদের মনে হয়নি। দ্বিতীয়ত, বগুড়ায় এবার নতুন সাতটি ওয়ার্ড যুক্ত হয়েছে এবং এসব ওয়ার্ড থেকে আওয়ামী লীগ প্রার্থী যথেষ্ট ভোট টানতে পারেননি। কথা প্রসঙ্গে বগুড়া পৌরসভার ১১টি কাউন্সিলর পদে আওয়ামী লীগ–সমর্থিত প্রার্থী এবং মাত্র আটটিতে বিএনপি প্রার্থী জিতেছেন—এ কথাও অধ্যাপকেরা স্মরণ করিয়ে দেন। প্রশ্ন ছিল, জেলায় নয়টি পৌরসভার প্রাপ্ত হিসাব থেকে দেখা যাচ্ছে, গতবারের তুলনায় আওয়ামী লীগের চেয়ে এবার বিএনপির ভোট বেড়েছে বেশি, এটা তাহলে কীভাবে সম্ভব হলো? বগুড়া পৌরসভার ভোটার সংখ্যা বিপুল। সে তুলনায় অন্য আটটি পৌরসভার ভোটার সংখ্যা একেবারেই নগণ্য এ কথা উল্লেখ করে অধ্যাপকদের অনেকেই জানালেন, মূলত গড় হিসাবের কারণে এবং নতুন সাতটি ওয়ার্ডের কারণেই এমনটা হয়েছে। এ ছাড়া গতবারের চেয়ে ভোট তো আওয়ামী লীগেরও বেড়েছে।
বগুড়ায় নির্বাচনে কারচুপি হয়েছে—এমন ঢালাও অভিযোগ পাওয়া যায়নি। উদাহরণ আবার সেই বগুড়া পৌরসভা। এখানে বিএনপির বিজয়ী প্রার্থী এবং বিদ্রোহী প্রার্থী মিলে মোট ভোট পেয়েছেন ৮ হাজার ৭৯৯টি। আর আওয়ামী লীগ প্রার্থী ভোট পেয়েছেন মাত্র ৬৯০। কারচুপি হলে এমন হওয়ার কথা ছিল না। এমন সব যুক্তির পরও বগুড়ার মানুষের মধ্যে সত্যি সত্যিই পরিবর্তনের হাওয়া লেগেছে কি না সে প্রশ্নটা থেকেই যায়।
আমরা স্মরণ করতে পারি ২০১৩ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারির পরবর্তী ঘটনার কথা। ওই দিন মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে জামাতের নায়েবে আমির দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীকে মৃত্যুদণ্ডাদেশ দেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১। এই রায়ের পরপরই দেশব্যাপী শুরু হয় নজিরবিহীন তাণ্ডব। সবার এ তথ্যও নিশ্চয়ই জানা যে, দেশের বিভিন্ন স্থানে তাণ্ডব চললেও সব ঘটনা ছাপিয়ে বগুড়া জেলার নামই গণমাধ্যমে সামনে চলে আসে। বগুড়ায় ঘটনার ব্যাপকতা কতটা ছিল, অথবা এক অন্ধবিশ্বাস থেকে কত মানুষ এই ঘটনার সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল তার পরিসংখান পাওয়া যায় ওই ঘটনায় দায়েরকৃত মামলার নথি থেকে। মামলা হয় ৩৯টি। বগুড়ায় এক দিনেই নিহত হন পুলিশসহ ১১ ব্যক্তি। এ থেকে সাধারণভাবে বগুড়ার মানুষের গড় মনোজাগতিক অবস্থাটা অনুমান করা যায়। পঁচাত্তর–পরবর্তী সময়ে বগুড়ায় জিয়াউর রহমানের জনপ্রিয়তার পেছনের রসায়নও হয়তো এই মনোজাগতিক অবস্থার মধ্যে খুঁজে পাওয়া যাবে।
ভালো হোক আর মন্দ হোক, মানুষের কোনো বিশ্বাসের শিকড় যখন অনেক গভীরে প্রোথিত থাকে, তখন সে
শিকড় খুব সহজে আলগা হয় না। মাত্র দুই বছরের মধ্যে বগুড়ার এই মানুষগুলোর চেতনায় বড় কোনো পরিবর্তন আসতে পারে—এমনটা বিশ্বাস করা তাই কঠিন। তবে সবার সঙ্গে কথা বলে এটা মনে হয়েছে, সাঈদীকে চাঁদে দেখা যাওয়ার কল্পকাহিনির সঙ্গে যঁারা যুক্ত হয়েছিলেন, তঁারা এখন নিজেদের অনেকটাই বোকা মনে করছেন। এ নিয়ে এখন সমাজে ঠাট্টা-মশকরাও কম হচ্ছে না। এরপরও সবকিছু বুঝেশুনে মানুষ নিজেকে সহজে তার অলীক বিশ্বাস থেকে মুক্ত করতে পারে না। এর জন্য প্রয়োজন হয় অনেক সময়ের।
তাহলে পরিবর্তনের বিষয়টাও কি নেহাত গালগল্প? হয়তো নয়। খুব ধীর লয়ে হলেও বগুড়ায় একটি পরিবর্তনের আবহ বোধকরি সৃষ্টি হয়েছে। না হলে ওই অধ্যাপকেরা দৃঢ়তার সঙ্গে এটা উচ্চারণ করেন কীভাবে? অবশ্য অধ্যাপকেরা এর পেছনের ব্যাখ্যাটাও দাঁড় করান। তাঁরা মনে করেন, শিক্ষার হার বৃদ্ধির পাশাপাশি দিনে দিনে সচেতনতাও বাড়ছে মানুষের মধ্যে। সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ব্যাপার হলো মানুষের আর্থিক সামর্থ্য আগের চেয়ে বেড়েছে। বিশ্বায়ন, আধুনিক যোগাযোগ প্রযুক্তি আর বাজার অর্থনীতির সুবাদে মানুষের রুচিতে পরিবর্তন আসছে। এ ছাড়া মানুষ নানা সমকালীন অভিঘাতের কারণেই এখন অনেকটা নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত। আস্তে আস্তে মানুষের পাল্টে যাওয়ার এই প্রবণতা অবশ্য ভবিষ্যতে প্রচলিত ধারার রাজনীতির ক্ষেত্রে বড় চ্যালেঞ্জ হয়েও উঠতে পারে।
বগুড়ার মানুষের মধ্যে পরিবর্তনের যে আভাস আজ পাওয়া যাচ্ছে, তা কিন্তু মিলিয়ে যেতে পারে সহজেই। অতি ধীর পরিবর্তনের এই ধারা ধরে রাখতে হলে রাজনীতিতে শুভবোধ জাগ্রত করা জরুরি। আর জরুরি এই কাজটি শুরু করতে হবে সব দায়িত্বশীল রাজনৈতিক দলকেই। বর্তমান রাজনৈতিক সংস্কৃতির পরিবর্তন না হলে মানুষের বোধের জগতেও পরিবর্তন আসবে না। সুতরাং মানুষ পাল্টে গেছে—এমন আত্মতৃপ্তির কোনো সুযোগ নেই। কাজটা দীর্ঘমেয়াদি।
মলয় ভৌমিক: অধ্যাপক, ব্যবস্থাপনা বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়; নাট্যকার।