দুদককে দাঁড়াতেই হবে
সংসদে আইনের মাধ্যমে ২০০৪ সালে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) গঠিত হয়। দুদক কমিশনারদের নিয়োগ ও অপসারণ পদ্ধতি যথেষ্ট জটিল। এ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠানটিকে আনুষ্ঠানিকভাবে একটি স্বাধীন সংস্থার রূপ দিয়েছে। এর কিছু কর্মকর্তা সরকার থেকে দুদকের সম্মতি সাপেক্ষে প্রেষণে আসেন। অর্থাৎ, দুদক না চাইলে কেউ আসতে পারেন না। আর কমিশনের নিজস্ব জনবল নিয়োগ, পদোন্নতি ও শৃঙ্খলা তাদেরই হাতে। সুতরাং কাজ করতে তাদের কোনো বাধা থাকার কথা নয়। তা-ও প্রতিষ্ঠানটি জনগণের প্রত্যাশার সঙ্গে সংগতি রেখে কাজ করতে পারছে না।
শুরুতেই ছিল স্থবির ভাব। মাঝখানে কিছুদিন জরুরি অবস্থার সুযোগ নিয়ে এটি অতি সক্রিয় হয়। আবার ঝিমিয়ে ছিল লম্বা সময়। বছর তিনেক আগে নতুন নেতৃত্ব আসায় শুরুতেই বেশ তৎপর হয় প্রতিষ্ঠানটি। সবাই আশাবাদী হন। কিন্তু এ ধরনের ক্ষমতা ও মর্যাদাসম্পন্ন প্রতিষ্ঠান গঠনের যৌক্তিকতা থেকে তারা অনেকটা পিছিয়ে রয়েছে। আর ক্রমান্বয়ে তার আরও অধোগতি হতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন অনেকেই।
দুদক প্রাসঙ্গিকতা হারিয়ে ফেলছে—এমন নির্দয় মন্তব্যও আসছে। মন্তব্যটি সর্বাংশে অমূলক না হলেও ক্ষোভের সংগত কারণ রয়েছে। তবে নৈরাশ্যবাদী হতে চাই না আমরা অনেকেই। দুর্নীতি দেশের অর্থনীতি ও সামাজিক জীবনে অনেক নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। ডালপালাও মেলছে ক্রমান্বয়ে। দেশের অর্থনীতির প্রবৃদ্ধির পাশাপাশি দুর্নীতির ব্যাপকতাও উদ্বেগের বিষয়। আর এর রাশ টেনে ধরার মূলত একমাত্র প্রতিষ্ঠান দুদক। পূর্বসূরি প্রতিষ্ঠান ছিল দুর্নীতি দমন ব্যুরো। দুর্নীতি দমনে সে ব্যুরোর শোচনীয় ব্যর্থতার মুখেই দেশের সুশীল সমাজ এবং উন্নয়ন-সহযোগীদের জোরালো দাবির মুখে গঠিত হয় স্বাধীন দুর্নীতি দমন কমিশন। এখন আর ভাঙাগড়ার খেলায় না গিয়ে দুদকের দুর্বলতাগুলো চিহ্নিত করে নিরাময়ের ব্যবস্থা করা দরকার।
দুদকের ক্ষমতার তেমন কমতি নেই। তবে তার অভ্যন্তরীণ শৃঙ্খলার বিষয়টি নতুন শঙ্কা সামনে নিয়ে আসছে। ভাবতে হচ্ছে ভিন্ন পথ। অভিযোগ রয়েছে, দুদকের কিছু কর্মকর্তা দুর্নীতির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। তাঁরা দুর্নীতির কোনো কোনো মামলায় অনুসন্ধান ও তদন্ত অকারণ বিলম্বিত ও ক্ষেত্রবিশেষে ভিন্ন খাতে পরিচালনা করেন।
সংস্থার কোনো কোনো কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ঘুষ গ্রহণের অভিযোগও আসছে। এসব অভিযোগের প্রতিকারের দায়িত্বও দুদকের হাতেই। যেমন, পুলিশের কোনো সদস্যের বিরুদ্ধে দুর্নীতি ব্যতীত অন্য কোনো অভিযোগ হলে তারাই করছে তদন্ত। প্রাসঙ্গিকভাবে সামরিক বাহিনীর শৃঙ্খলা বিধানের বিষয়টি আলোচিত হতে পারে। তাদের কোনো সদস্য ইউনিটের ভেতরে অপরাধ করলে নিজেরাই তদন্ত ও কোর্ট মার্শাল করে। আবার সে অপরাধ যদি হত্যা হয় তাহলে তাঁকে বেসামরিক কর্তৃপক্ষের কাছে বিচারের জন্য সোপর্দ করা হয়। এমনকি কোনো সদস্য ইউনিটের বাইরে ‘সিভিল লাইফ’ বিপন্ন করে, এমন কোনো অপরাধের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট হলে তাঁকেও বেসামরিক কর্তৃপক্ষের হাতে বিচারের জন্য তুলে দেওয়া হয়। ঠিক তেমনি দুদকের কোনো সদস্য শৃঙ্খলা পরিপন্থী কোনো কাজ করলে এ প্রতিষ্ঠানের নিয়ম অনুযায়ী তারাই তদন্ত ও এর আইনানুগ প্রতিবিধান করবে।
তবে দুদকের সদস্যের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ এলে পুলিশ বা ভিন্ন কোনো সংস্থা কর্তৃক তদন্ত হওয়া সংগত। তেমনি পুলিশের লোক ইয়াবা বা স্বর্ণ চোরাচালানে ধরা পড়লে, ছিনতাই বা ধর্ষণের অভিযোগ এলে, সে তদন্তও দুদক কিংবা অন্য কোনো সংস্থার পরিচালনা করা উচিত। এ আইন আমাদের দেশে নেই। তবে এ ধরনের কিছু করা এখন সময়ের দাবি। এরূপ বিধান হলে দায়বদ্ধতা কিছুটা বাড়বে।
এজাহার দায়ের করা হলেও দুদক কোনো কোনো মামলায় আসামি গ্রেপ্তারে শঙ্কিত থাকছে। সম্প্রতি একজন পদস্থ পুলিশ কর্মকর্তার ক্ষেত্রে এমনটাই লক্ষণীয় হয়েছে। হাইকোর্ট বিভাগ সে কর্মকর্তাকে গ্রেপ্তারের ব্যবস্থা নিয়েছেন। এটা প্রশংসনীয়। তবে দুদকের অসামর্থ্যও সামনে এল। অবশ্য ভারতে সিবিআই ক্ষেত্রবিশেষে কোনো ব্যবস্থা নিতে সুপ্রিম কোর্টের দ্বারস্থ হয়। এমনটা নিকট অতীতে কলকাতার সাবেক পুলিশ কমিশনারকে জিজ্ঞাসাবাদের ক্ষেত্রে দেখা গেছে। স্বয়ং রাজ্য সরকারের মুখ্যমন্ত্রী সে কর্মকর্তাকে সমর্থন দিয়ে ধরনায় বসেছিলেন। এ ক্ষেত্রে সুপ্রিম কোর্টের সমর্থন ছাড়া সিবিআইয়ের গত্যন্তর ছিল না।
তবে উল্লেখ করতে হবে, সিবিআই ভারত সরকারের অধীন একটি সংস্থা। এর নিয়োগ ও কর্মকাঠামোয় দুদকের মতো আইনি সমর্থন নেই। তা-ও তারা দুর্নীতিপরায়ণ রাজনীতিক ও কর্মকর্তাদের জন্য বিভীষিকা। বিহারের একসময়ের ডাকসাইটে নেতা লালুপ্রসাদ যাদবের রাজনৈতিক জীবনের পরিসমাপ্তি ঘটেছে এ সংস্থারই প্রচেষ্টায়। দুর্নীতির দায়ে তিনি এখন কারাদণ্ড ভোগ করছেন। অবশ্য এখানে একটি বিষয় উল্লেখ করা প্রাসঙ্গিক, দুদকের দায়িত্ব পরিচালনা করতে অন্যান্য সংস্থার সহযোগিতা প্রয়োজন। যতই ক্ষমতা থাকুক, তা প্রয়োগ করতে অন্যদের সহায়তা প্রয়োজন। এখানে প্রাসঙ্গিকভাবে আলোচনায় আসবে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের একজন নিম্নপর্যায়ের কর্মচারী ও তাঁর স্ত্রীর দুর্নীতিলব্ধ ২৮৪ কোটি টাকার বিষয়টি। এটি কিছুকাল আগে নজরে আসে। অনুসন্ধান চালিয়ে অন্যান্য আনুষ্ঠানিকতা পালন করে মামলা দায়েরে দুদকের কিছু সময় দরকার হয়। ছয় মাসের মতো সময় নিয়েছে তারা। এটা অস্বাভাবিক বলা যাবে না। তবে তাঁরা যাতে দেশ থেকে পালাতে না পারেন, তার জন্য পুলিশকে গত জানুয়ারি মাসে দুদকের পক্ষ থেকে জানানো হয় বলে একটি ইংরেজি দৈনিকে উল্লেখ রয়েছে। এজাহার হয়েছে জুনের শেষ দিকে। এর মধ্যে পত্রপত্রিকায় খবর আসছে এ দম্পতি দেশ ছেড়ে অস্ট্রেলিয়ায় পাড়ি দিয়েছেন। সে চিঠির সূত্র ধরে সরকার একটি তদন্ত পরিচালনা করে দায়ী ব্যক্তিদের শাস্তির ব্যবস্থা করা সংগত।
দুদকের আরেকটি বড় সমস্যা অসংখ্য মামলার ভারে সংস্থাটি ভারাক্রান্ত। এসব মামলার অনুসন্ধান, তদন্ত, অভিযোগপত্র প্রেরণ এবং আদালতে দুদকের পক্ষাবলম্বন খুবই শ্রম ও সময়সাপেক্ষ কাজ। ব্যাপকভাবে দুদকের জনবল বাড়িয়ে এর প্রতিকার হবে না। সংস্থাটির কর্মপরিধি ভারতের সিবিআইয়ের ধাঁচে নিয়ে আসার জন্য অনেক বলা হয়েছে। সিবিআই খুব সীমিতসংখ্যক মামলাই হাতে নেয়। দুদকের তফসিলে বড় পরিবর্তন দরকার। অন্য সব মামলার দায়িত্ব পুলিশ কিংবা ভিন্ন কোনো সংস্থাকে দেওয়া যেতে পারে। দুদক দেশের বড় কিছু দুর্নীতিপরায়ণ ব্যক্তিকে আইনের আওতায় আনা অব্যাহত রাখলে দুর্নীতিতে ভাটার টান আসবে।
দুর্নীতি দমন কমিশনের কার্যক্রমে রাজনৈতিক প্রভাব স্পষ্ট। সরকারবিরোধী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে মামলার তদন্তের গতি তীব্র। পক্ষান্তরে সরকার পক্ষে অবস্থান নেওয়া রাজনীতিক, ব্যবসায়ী এমনকি সরকারি কর্মচারীরাও বিচারহীনতার সংস্কৃতি উপভোগ করছেন। এ কথাগুলো প্রাসঙ্গিক এ কারণে যে সরকারের বিভিন্ন অঙ্গ বা প্রতিষ্ঠানের সহায়তা না পেলে দুদক যথার্থভাবে কাজ চালাতে পারে না। সুতরাং দুর্নীতির বিরুদ্ধে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হলে দুদককে সরকারের কার্যকর ও নিঃশর্ত সমর্থন দিতে হবে।
অন্যদিকে দুদক সে সমর্থন আদায়ের জন্য তৎপর না হলে দায় বর্তাবে তাদের ওপরেই। সুশীল সমাজ যে দুদক চেয়েছিল, তা খুঁজে পাচ্ছে না বলে একটি হতাশার ভাব লক্ষণীয়। এটা দুদকের জন্য ক্ষতিকর। সংকোচের বিহ্বলতার বৃত্ত থেকে তাদের বেরিয়ে আসতে হবে। এর বিপরীতে নিজেদের ক্রমান্বয়ে গুটিয়ে নিয়ে তারাও একসময়ে ব্যুরোর মতো অপ্রাসঙ্গিক হয়ে যাক—এমনটা আমরা চাই না।
আলী ইমাম মজুমদার: সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব
[email protected]