২০১৬ সালের জুন মাসে, যখন রদ্রিগো দুতার্তে ফিলিপাইনের ১৬তম প্রেসিডেন্ট হিসেবে অধিষ্ঠিত হন, যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের প্রচারণা তখন তুঙ্গে। সেই সময় কেউ কেউ তাঁকে ‘প্রাচ্যের ডোনাল্ড ট্রাম্প’ বলে আখ্যায়িত করেছিলেন। আমি মনে করি, এই তুলনা দুতার্তের জন্য ঠিক প্রযোজ্য নয়। তবে এটা সত্যি যে এক জায়গায় তাঁদের মিল রয়েছে। তাঁরা দুজনেই কথা বলেন লাগামহীনভাবে। দুজনেই ব্যক্তি অথবা অবস্থার ব্যাখ্যায় গালিগালাজ-সংবলিত বিশেষণ ব্যবহার করতে দ্বিধাবোধ করেন না। সেই ক্ষেত্রে অবশ্য দুতার্তে ডোনাল্ড ট্রাম্পকে ছাড়িয়ে যান। তাঁর দু-একটি উদাহরণ এখানে অপ্রাসঙ্গিক হবে না। যেমন দুতার্তে প্রেসিডেন্ট ওবামাকে ‘বেজন্মা’ (সান অব আ হোর) বলে আখ্যায়িত করেছেন। পরে তিনি অবশ্য তার জন্য দুঃখ প্রকাশ করেছেন, তবে উচ্চারিত বাক্য নিক্ষিপ্ত তিরের মতোই, ফিরিয়ে নেওয়া যায় না। দুঃখজনকভাবে পোপের বেলায়ও একই বিশেষণ ব্যবহার করেছেন দুতার্তে। কিন্তু বাচনে বল্গাহীন এই প্রেসিডেন্টের সবচেয়ে মুখরোচক গালিটি সংরক্ষিত রেখেছেন ফিলিপাইনে যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত ফিলিপ গোল্ডবার্গের জন্য। দুতার্তের দৃষ্টিতে গোল্ডবার্গ হচ্ছেন ‘সমকামী বেজন্মা’ (গে সান অব আ হোর) বলে। দুতার্তের কাছে জাতিসংঘ হচ্ছে একটি ‘স্টুপিড’ সংস্থা।
প্রেসিডেন্ট দুতার্তে একজন সফল রাজনীতিবিদ। তৃণমূল থেকে উঠে এসেছেন ৭১ বছর বয়সী এই রাষ্ট্রনায়ক। জনপ্রতিনিধি হিসেবে তাঁর কর্মকাণ্ডের সমালোচনা অবশ্যই রয়েছে, কিন্তু তাঁর ঝুলিতে রয়েছে দর্শনীয় সাফল্য। তাঁর লক্ষ্য অর্জনের পন্থা প্রশ্নবিদ্ধ হলেও তাঁর অর্জন সম্বন্ধে দ্বিমত খুবই কম। কদিন আগেই আমি ফিলিপাইনে তিন সপ্তাহ কাটিয়ে এলাম। সেই সময় আমার কাছে তা স্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হয়।
দুতার্তের অভ্যুদয়ের আগে ফিলিপাইনের কেন্দ্রীয় রাজনীতিতে ম্যানিলার মাত্র কয়েকটি ধনাঢ্য পরিবারেরই একচেটিয়া প্রাধান্য ছিল। সাময়িকভাবে হলেও দুতার্তে সেই আধিপত্যের অবসান ঘটিয়েছেন। বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে তিনি নির্বাচিত হয়েছেন। তাঁর প্রাপ্ত ১ কোটি ৬০ লাখ ভোটের বিপরীতে নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী পেয়েছেন ৯৯ লাখ ভোট। অর্থাৎ দুজনের প্রাপ্ত ভোটের ব্যবধান প্রায় ৬১ লাখ।
দুতার্তের জনপ্রিয়তার প্রধান কারণ হলো, মাদক ব্যবসাসহ সব ধরনের অপরাধ ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে তাঁর আপসহীন অবস্থান। প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার আগে তিনি মিন্দানাও প্রদেশের দাভাও শহরের মেয়র ছিলেন সুদীর্ঘ ২২ বছর। অপরাধপ্রবণ ও অনিরাপদ একটি শহর হিসেবে দুর্নাম ছিল দাভাওর। কিন্তু এখন তা ফিলিপাইনের শহরকুলপঞ্জিতে সবচেয়ে নিরাপদ শহর হিসেবে বিবেচিত হয়। দুর্নীতিমূলক কর্মকাণ্ড সেখানে নাটকীয়ভাবে হ্রাস পেয়েছে। এই লক্ষ্য অর্জনে দুতার্তে হাজার হাজার মানুষকে বিচারবহির্ভূতভাবে হত্যা করেছেন। তিনি মানবাধিকার লঙ্ঘন করেছেন চোখ বুজে। কিন্তু আমজনতা এবং মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্তের একটি বিরাট অংশ তা স্বাগত জানিয়েছে। রাষ্ট্রপতি হিসেবে তাঁকে দিয়েছে বিপুল সমর্থন। তাঁকে ফিলিপিনোরা সাদরে দুটি ডাকনাম ‘রুডি’ ও ‘ডিগংগ’ বলে অভিহিত করেন।
কিন্তু দুতার্তে মূলত একজন রাজনীতিবিদ। তিনি সর্বাবস্থায় ‘ডান্ডা মেরে ঠান্ডা’ করার নীতিতে বিশ্বাস করেন না, মিন্দানাওর বিদ্রোহী মরো মুসলমানদের প্রতি তাঁর মনোভাবে এটা স্পষ্ট হয়ে ওঠে। তিনি সংঘর্ষকবলিত, মুসলিম–অধ্যুষিত, বহুলাংশে স্বায়ত্তশাসিত পশ্চিম মিন্দানাওয়ে স্থায়ীভাবে শান্তি প্রতিষ্ঠার অঙ্গীকার করেছেন। সেই অঞ্চলের মুসলমানদের লক্ষ্য করে অত্যুক্তি করতেও তিনি দ্বিধাবোধ করেননি। বলেছেন, মরোরাই তাঁকে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত করেছে। তিনি অঙ্গীকার করেছেন, জাতীয় সম্পদের ন্যায্য অংশ মিন্দানাও পাবে। বলেছেন, সেই অঞ্চলের উন্নয়নের জন্য তিনি ‘অর্থ ঢেলে দেবেন’। কৃষি ও মাছ চাষপ্রধান সেই অঞ্চলের চাষি ও জেলেদের জন্য তিনি প্রয়োজনমতো মাছ ধরার নৌকা আর ট্রাক্টরের ব্যবস্থা করবেন। অবশ্য বহু দলে বিভক্ত মরোদের সেই অঞ্চলে বিদ্রোহের আগুন এখনো সম্পূর্ণভাবে প্রশমিত হয়নি। সহিংস ঘটনা এখনো ঘটছে, তবে এগুলোকে বিচ্ছিন্ন ঘটনা বলেই আখ্যায়িত করা যায়।
ফিলিপাইনে মুসলমান জনসংখ্যার হিসাব নিয়ে মতানৈক্য রয়েছে। সরকারি সমীক্ষায় সেই দেশের মুসলমানরা হচ্ছেন মোট জনসংখ্যার ৫ দশমিক ৬ শতাংশ। কিন্তু মুসলিম ফিলিপিনো নামের একটি সংস্থার হিসাবে তা ১১ শতাংশ। তা যা-ই হোক, খ্রিষ্টানদের পর মুসলমানরা সেই দেশের দ্বিতীয় ধর্মীয় গোষ্ঠী এবং তঁাদের ৯০ শতাংশের বেশি বাস করেন মিন্দানাও অঞ্চলে। তাঁদের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ দুতার্তের সমর্থক। বলা হয়ে থাকে, মায়ের দিক থেকে দুতার্তের ধমনিতে মুসলমান রক্ত রয়েছে। সংবাদমাধ্যমে প্রকাশ যে দুতার্তের আটজন নাতি-নাতনির মধ্যে চারজন ইসলাম ধর্মাবলম্বী। কিন্তু দুতার্তে নিজে কোনো ধর্মের অনুসারী নন। তবে সৃষ্টিকর্তার প্রতি তাঁর বিশ্বাস রয়েছে। বিপুল খ্রিষ্টান সংখ্যাগরিষ্ঠতার দেশে তিনি ধর্মকে রাষ্ট্র থেকে আলাদা রাখতে চান; তবে সৃষ্টিকর্তা থেকে নয়।
ওবামা দুতার্তের কর্মপদ্ধতির সমালোচনা করেছিলেন, মানবাধিকার লঙ্ঘনকারী বলে আখ্যায়িত করেছিলেন তাঁকে। ফলে অগ্রহণযোগ্য বিশেষণে ওবামাকে অভিষিক্ত করা ছাড়াও অনেকটা নাটকীয়ভাবেই লাওসে অনুষ্ঠিত আসিয়ান শীর্ষ সম্মেলনে দুতার্তে যুক্তরাষ্ট্রের কড়া সমালোচনা করেন। দুতার্তের মতে, ১৯০৬ সালে যখন ফিলিপাইন যুক্তরাষ্ট্রের শাসনাধীন ছিল, আমেরিকানরা মিন্দানাওতে ছয় হাজার মিন্দানাওবাসীকে হত্যা করেছিল। দুতার্তে বিগত সেই শীর্ষ সম্মেলনে বলেছিলেন, নিহত মিন্দানাওবাসীরা ‘আমার পূর্বপুরুষ’। তিনি বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ফিলিপাইন অতীতের মতো সামরিক মহড়ায় আর অংশ নেবে না। তিনি দুই বছরের মধ্যে ফিলিপাইনের মাটি থেকে যুক্তরাষ্ট্রের সশস্ত্র উপস্থিতির প্রত্যাহার দাবি করেছেন এবং কয়েক সপ্তাহ আগে চীন সফরকালে তিনি যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ফিলিপাইনের ‘বিচ্ছেদ’ ঘোষণা করেছেন। তাঁর সোজাসাপ্টা ও অকূটনৈতিক ভাষায় যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে চীন, রাশিয়া ও ফিলিপাইন এখন ‘এক জোট’।
দুতার্তে হালেই চীন ও জাপান সফর করেছেন। দ্বিপক্ষীয় দৃষ্টিকোণ থেকে ফিলিপাইনের জন্য তা মঙ্গলজনক হবে। দক্ষিণ চীন সাগরে কোনো কোনো এলাকার কর্তৃত্ব নিয়ে চীন ও ফিলিপাইনের মধ্যে বহু বছর ধরেই বিরোধ চলে আসছিল। সেই বিরোধে আন্তর্জাতিক বিচার আদালত ফিলিপাইনের অনুকূলে রায় দিয়েছেন। কিন্তু বাস্তববাদী দুতার্তে সেই রায়কে পুঁজি করে ক্ষমতাবান চীনের সঙ্গে বচসায় জড়াতে চান না। চীন সফরকালে প্রেসিডেন্ট সি চিন পিংয়ের সঙ্গে দুতার্তের ফলপ্রসূ আলোচনা হয়েছে এবং চীন এখন ফিলিপাইনকে একটি বৃহৎ অঙ্কের অর্থ সাহায্য দিতে অঙ্গীকারবদ্ধ। কয়েক দিন আগেই দুতার্তে পেরুর রাজধানী লিমায় এশিয়া প্যাসিফিক অর্থনৈতিক সহযোগিতা সংস্থা এপিইসির শীর্ষ সম্মেলনে যোগ দেন এবং সেখানে তিনি রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট পুতিনকে তাঁর ‘আদর্শ পুরুষ’ বলে আখ্যায়িত করেন। প্রীত হয়ে পুতিন দুতার্তেকে রাশিয়া সফরের সাদর আমন্ত্রণ জানিয়েছেন।
দুতার্তে নির্দিষ্ট মতাদর্শের রাজনীতি করেন না। তিনি বাস্তববাদী এবং যা ফিলিপাইন আর তাঁর জনপ্রিয়তার স্বার্থে, তিনি তা-ই করবেন। বাংলাদেশ ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ থেকে চুরি হওয়া অর্থ নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক এখন ফিলিপাইনের রিজাল ব্যাংকের মুখোমুখি। এই অর্থ ফেরত দেবে না বলে সম্পূর্ণ অযৌক্তিক অবস্থান নিয়েছে রিজাল ব্যাংক। আমাদের আইনমন্ত্রী উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন একটি দল নিয়ে এই অর্থ আদায়ের জন্য ফিলিপাইন সফর করলেন। আমাদের প্রতিনিধিদলের সঙ্গে দুতার্তে সাক্ষাৎ করেননি। তবে আমি মনে করি, নৈতিক ও রাজনৈতিক চাপের মুখে দুতার্তে এই বিষয়ে তাঁর দৃষ্টিভঙ্গির পুনর্বিবেচনা করতেও পারেন।
দুতার্তের বাস্তববাদিতার একটি প্রমাণ আমরা সেদিন পেয়েছি। ওবামাকে অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করলেও তিনি ডোনাল্ড ট্রাম্পের দীর্ঘ জীবন কামনা করে অভিনন্দন জানিয়েছেন। তাঁর সম্ভাব্য দুটি কারণ রয়েছে। প্রথমটি হলো, দুতার্তের বিশ্বাস, ট্রাম্প ওবামার মতো দুতার্তের কর্মপদ্ধতি নিয়ে মাতামাতি করবেন না। আর দ্বিতীয়টি ফিলিপাইনের ব্যবসায়িক স্বার্থ। হোসে আনতানও নামধারী এক ফিলিপিনো ব্যবসায়ী ট্রাম্পের ব্যবসায়িক অংশীদার। ট্রাম্পের অংশীদারত্বে এই ব্যবসায়ী ম্যানিলায় ৫৭ তলাবিশিষ্ট একটি বিলাসবহুল ‘ট্রাম্প টাওয়ার’ নির্মাণ করছেন। দুতার্তে সেই ব্যক্তিটিকে যুক্তরাষ্ট্রে ফিলিপাইনের ‘বিশেষ দূত’ হিসেবে নিয়োগ দিয়েছেন। তবে দুতার্তে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সামরিক সহযোগিতাবিরোধী যে অবস্থান নিয়েছিলেন, সেখান থেকে সহজে সরে আসতে পারবেন বলে মনে হয় না। কারণ, এই নীতি ফিলিপাইনে জনপ্রিয়; যদিও যুক্তরাষ্ট্রে এখন প্রায় ৩০ লাখ ফিলিপিনোর বাস এবং তাঁদের প্রেরিত অর্থ ফিলিপাইনের অর্জিত বৈদেশিক মুদ্রার একটি বিরাট অংশ।
ফিলিপাইনের অর্থনৈতিক অবস্থা দুতার্তের নির্বাচনের আগেই যথেষ্ট চাঙা ছিল, এখনো তা আছে। ফিলিপাইনের বার্ষিক জিডিপি প্রবৃদ্ধি প্রায় ৭ শতাংশ। দেশটি এখন একটি সম্ভাবনাময় বাজার হিসেবে আত্মপ্রকাশ করছে। ফিলিপাইনের মাথাপিছু আয় বছরে তিন হাজার মার্কিন ডলারের বেশি এবং ক্রয়ক্ষমতার ভিত্তিতে তা এখন প্রায় ৭ হাজার ৬০০ মার্কিন ডলার। দুতার্তে দেশটির অবকাঠামো আধুনিকায়নে গুরুত্ব দিচ্ছেন, ম্যানিলায় বিপুল যানজট সমস্যার সমাধানে নিচ্ছেন ব্যক্তিগত উদ্যোগ। ম্যানিলা শহরে অবতরণ করামাত্রই চোখে পড়ে, সর্বত্র নির্মাণযজ্ঞ চলছে বিপুল উদ্যমে। সুউচ্চ অট্টালিকাসংবলিত ম্যানিলার বিভিন্ন অংশকে মিনি ম্যানহাটনের মতো মনে হয়।
চীন ও রাশিয়ার সঙ্গে অর্থনৈতিক সম্পর্ক সুদৃঢ় করে দুতার্তে পূর্ব এশিয়া এবং বিশেষ করে ফিলিপাইনে একটি নতুন, শক্তিশালী ও আন্তর্জাতিক সমীকরণ সৃষ্টি করতে চান। তিনি পূর্ব এশিয়ায় ফিলিপাইনের ভূমিকা বৃদ্ধিতে সচেষ্ট রয়েছেন। এতে ডোনাল্ড ট্রাম্প সরকারের প্রতিক্রিয়া কী হবে তা অজানা; কারণ, ট্রাম্পের পররাষ্ট্রনীতি এখনো অস্বচ্ছ। ফিলিপাইনের প্রেসিডেন্টের মেয়াদ মাত্র একটি, তবে তা ছয় বছরের। অতএব অন্তত আগামী চার বছর ডোনাল্ড ট্রাম্প ও রদ্রিগো দুতার্তে নিজ দেশে প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব পালন করবেন। চীন ও রাশিয়ার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে পূর্ব এশিয়ায় এবং বিশেষ করে ফিলিপাইনে যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব অব্যাহত রাখা হবে ডোনাল্ড ট্রাম্পের পররাষ্ট্রনীতির জন্য একটি বিরাট চ্যালেঞ্জ।
ফারুক চৌধুরী: সাবেক পররাষ্ট্রসচিব। কলাম লেখক।