বাঙালি মারামারিতে অদক্ষ, এমন অপবাদ কেউ দিয়েছে বলে শোনা যায় না। নারী নির্যাতনে বাঙালি পুরুষ অন্য কোনো জাতি, এমনকি কোনো অরণ্যবাসী উপজাতি থেকে পিছিয়ে, এমন বদনামও কেউ কোনো দিন দিতে পারেনি। বউ অবশ্য আমেরিকানরাও পেটায়। কিন্তু বাঙালি পুরুষের বউ পেটানোর মধ্যে যে বৈচিত্র্য, তা অন্য কোনো সম্প্রদায়ের মধ্যে দুর্লভ। শুধু নারী-পুরুষের ব্যাপার নয়, সর্বজনীন মারামারির জন্য বাঙালির কোনো বড় উপলক্ষের প্রয়োজন হয় না। তুচ্ছতম ব্যাপারই যথেষ্ট কথা-কাটাকাটি থেকে মাথা-ফাটাফাটিতে পর্যবসিত হতে।
একই দিনের কাগজে দুটি ছবি। একটির অকুস্থল দেশের উচ্চতম শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের চত্বর। ছাত্র-শিক্ষক মারামারিরত। শিক্ষক তাঁর সবল হাতে গলা টিপে ধরছেন তাঁর ছাত্রের। কেউবা ছাত্রের টি-শার্ট টেনে ছিঁড়ে ফেলছেন। বর্তমানের সুলভ আগ্নেয়াস্ত্রের এস্তেমাল ছিল না কোনো পক্ষেরই। স্রেফ মল্লযুদ্ধ। দুখানি হাত দিয়ে যে পক্ষ যতটা পেরেছে।
আরেকটি ছবি আদিম বর্বরতার আধুনিক সংস্করণ। দুই প্রাপ্তবয়স্ক নারীর—মা ও মেয়ের একেবারে নিখুঁত কামানো মাথা। বাঙালি নারীর সৌন্দর্যের একটি প্রধান উপাদান তার চুল, যা তার খুবই প্রিয়। সেই দীর্ঘ চুল ছোট করে ছাঁটা নয়, একেবারে যাকে বলে বেল-ন্যাড়া। এই ছবি কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। বাঙালি জাতির অতীত ও বর্তমান চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের সুস্পষ্ট প্রকাশ ঘটেছে আলোকচিত্র দুটিতে।
একসময় অধিকাংশ মারামারি-খুনখারাবি হতো সম্পত্তিসংক্রান্ত বিবাদে এবং তা হতো জমিজমার শরিকদের মধ্যে। চাকরি নিয়ে কামড়াকামড়িতে মারামারি বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের আগে শোনা যায়নি। শৈশবে মারামারিতে রক্তাক্ত হতে দেখেছি পদ্মার চর অঞ্চলে ধান কাটা নিয়ে। ধান পাকার সময় দুই পক্ষ লাঠিসোঁটা, জুতি, সড়কি নিয়ে ছুটে যেত পরস্পরের দিকে। যেন প্রাচীনকালের যুদ্ধক্ষেত্র। মাথা ফাটত। বুকে সড়কি বিঁধত। ফিনকি দিয়ে রক্ত বেরোত। যে পক্ষের জোর বেশি সে পক্ষ ধান কেটে নিয়ে যেত। কার জমি, কে-বা চাষ করেছে আর কে কেটে নিয়ে যাচ্ছে—কোনো ঠিকঠিকানা ছিল না। কখনো ধানখেতে পড়ে থাকত দু-একটা লাশ। পুলিশ এসে ওগুলো ছালা দিয়ে পেঁচিয়ে মর্গে পাঠিয়ে দিত।
আর মারামারি হতে দেখেছি প্রাইমারি স্কুলের ছোট বাচ্চাদের মধ্যে। তাতে অবুঝ বাচ্চারাই মারামারি করত, শিক্ষকদের অংশগ্রহণ থাকত না। বরং শিক্ষকেরা ছাত্রদের ঝগড়া মিটিয়ে দিতেন। সেকালে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকেরাও ব্যক্তিত্বসম্পন্ন ছিলেন। তা ছাড়া ছাত্রদের মারামারিও চিমটি ও খামচির মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। হাইস্কুলের মারামারিও উগ্র প্রকৃতির খারাপ ছাত্রদের মধ্যেই হয়ে থাকে। ভালো ছাত্ররা মারামারি ঘৃণা করে। স্কুল-কলেজের ছাত্র-শিক্ষকদের মধ্যে মারামারির কিছু কিছু সংবাদ মাঝেমধ্যে পত্রিকায় আসে। স্কুলের ম্যানেজিং কমিটির নির্বাচনের সময় মারামারি অবশ্য বিরল নয়। অনেক ক্ষেত্রে নির্বাচনে দাঁড়িয়ে জয়-পরাজয় পরের কথা—দু-চারটি দাঁত খুইয়ে অথবা মাথায় ব্যান্ডেজ বেঁধে বাড়ি ফিরতে হয় কোনো প্রার্থীকে। স্কুল কমিটির সভাপতি হওয়া বা যোগ্যতা না থাকলেও বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকের চাকরি পাওয়ার মধ্যে যে মধু, তার কাছে মারপিটে জখমের ব্যথা কোনো ব্যাপারই নয়।
যে দল নির্বাচন করে সরকার গঠন করতে পারে, সে দল খুব বড় সংগঠন। সেই দলে যোগ্য লোকের সংখ্যাও খুব বেশি হওয়া স্বাভাবিক। দেশের সবচেয়ে বড় বিশ্ববিদ্যালয়ে শত শত শিক্ষক। তাঁদের মধ্যে উপাচার্য হওয়ার মতো প্রবীণ ও সুযোগ্য অধ্যাপক থাকার কথা দু-এক শর বেশি। সেখানে যদি সরকার মাত্র দু-তিনজনের ওপরই নির্ভরশীল থাকে, তাহলে বুঝতে হবে প্রতিষ্ঠানটি তার মহত্ত্ব হারিয়ে ফেলেছে। যে প্রতিষ্ঠান তার নিজের ব্যবস্থাপনার জন্য নেতৃত্ব খুঁজে পায় না, সে প্রতিষ্ঠান সমগ্র জাতিকে কী উপহার দিতে পারে? এ প্রশ্ন সাধারণ নাগরিকদের মনে আসা স্বাভাবিক।
একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে তার শিক্ষার্থীরা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার। তাঁরা প্রাপ্তবয়স্ক মেধাবী মানুষ। তাঁরা তাঁদের নিজেদের, তাঁদের প্রতিষ্ঠানের এবং তাঁদের দেশের ভালোমন্দ খুব ভালো বোঝেন। তাঁদের মতামতের মূল্য বিরাট। কোনো বিষয়ে যখন তাঁরা দ্বিমত করেন বা প্রতিবাদ করেন, তখন তাঁদের সঙ্গে বসে আলোচনার মাধ্যমে মীমাংসা করাই সহজ ও সঠিক পথ। তাঁদের ঘাড়ধাক্কা দিয়ে বা গলা টিপে বের করে দেওয়া দণ্ডনীয় অপরাধের পর্যায়ে পড়ে। গলা টেপা, ঘুষি, লাথি, চড়-থাপ্পড় প্রকৃত রোগ নয়, রোগের উপসর্গমাত্র। চাই চাকরি। সে চাকরি একেবারে সর্বোচ্চটি হতে পারে এবং এন্ট্রি লেভেলে বা শুরুর পর্যায়েও হতে পারে। এক বিশ্ববিদ্যালয়ের মারামারি নাটকে যদি অন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের জুনিয়র শিক্ষকদের পার্শ্বচরিত্রে অভিনয় করতে দেখা যায়, তাহলে ঘটনার উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য বুঝতে অসুবিধা হয় না। তাৎপর্যের বিষয় প্রহসনের প্রযোজক, পরিচালক, অভিনেতা-অভিনেত্রী, কলাকুশলী—সবাই সরকারি দলের।
দুর্নীতিতে চ্যাম্পিয়ন হওয়াও ভালো নারী নির্যাতনে চ্যাম্পিয়ন হওয়ার চেয়ে। বাংলার নারী যে কতভাবে নির্যাতিত—ঘর থেকে অফিস-আদালত পর্যন্ত তার তালিকা করে শেষ করা যাবে না। যখন আমি এই রচনাটি লিখছি, তখন সোমবারের পত্রিকায়ই দেখছি একটি প্রতিবেদন। টাঙ্গাইলের মির্জাপুর উপজেলায় স্বামীর পরকীয়ায় বাধা দেওয়ায় স্ত্রীর শরীর ব্লেড দিয়ে চিরে সেই জখমে মরিচের গুঁড়া লাগিয়ে দিয়েছেন তাঁর স্বামী। নির্যাতন করে হত্যার ঘটনা তো প্রতিদিনই ঘটছে।
রোববারের পত্রিকায় বগুড়ার ঘটনার ছবি দেখে সবচেয়ে বিচলিত বোধ করেছি। এ কোন সমাজে বাস করছি! ক্ষমতাসীন দলের মানুষের সাহস বেশি হওয়া স্বাভাবিক, কিন্তু এত দুঃসাহস। আমার মাথা কামিয়ে ন্যাড়া করে দিলেও এত কষ্ট পেতাম না। এ যেন প্রতীকী ন্যাড়া করা। ক্ষমতাদর্শী বাঙালি পুরুষের দ্বারা সমস্ত বাঙালি নারীর ওপর নির্যাতন ও প্রতিহিংসার প্রকাশ। যৌন নির্যাতন করে মানবতাবিরোধী অপরাধ করেছেন যে লোক, সেই ব্যক্তিই নির্যাতিত ও তার মায়ের মাথা ন্যাড়া করে দিয়েছেন যে দুঃসাহস থেকে, তাকে তাঁর ব্যক্তিগত অপরাধ হিসেবে গণ্য করা যায় না, যে সংগঠনের তিনি ‘নেতা’, সেই সংগঠনও তার দায় এড়াতে পারে না। অপরাধী যদি কোনো সংগঠনবহির্ভূত মানুষ হতেন, তাহলে তা হতো ব্যক্তির অপরাধ। সুপরিকল্পিতভাবে ঘটনাটি ঘটানোর সময় শ্রমিক লীগ নেতা জানতেন, তাঁর ক্ষমতার উৎস তিনি নিজে নন। কোনো সমস্যা হলে তাঁর পেছনে রাষ্ট্র থাকবে। যাহোক, তাঁকে ও তাঁর সহযোগীদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে। আমাদের দাবি, বগুড়ার ঘটনাটির অভিযুক্ত ব্যক্তিদের ‘দ্রুত’ বিচারে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি যাতে হয়, সে ব্যাপারে উচ্চ আদালতের যেন নির্দেশনা থাকে। অসহায় মানুষের এভাবে নির্যাতন এবং অপমান কোনো সুস্থ সমাজ বরদাশত করতে পারে না।
সর্বোচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের একটি সর্বোচ্চ পদের নিয়োগকে কেন্দ্র করে মারপিটের যে ঘটনা ঘটেছে, তা থেকে প্রত্যন্ত গ্রামের স্কুলের ছাত্র-শিক্ষকেরা কী শিক্ষা পেলেন? বগুড়ায় ধর্ষণের শিকার নারীর মাথা ন্যাড়া থেকে কোন সমাজের চিত্র পাওয়া গেল? এসব মারামারি ও আদিম অসভ্যতার সংস্কৃতি থেকে যদি বেরিয়ে আসা না যায়, তাহলে মধ্যম বা উচ্চ আয়ের দেশ হলেও গর্বিত জাতি হিসেবে আমরা পরিচয় দিতে পারব না।
সৈয়দ আবুল মকসুদ: লেখক ও গবেষক।