দুই বুড়োর শেষ যুদ্ধ

বার্নি স্যান্ডার্স ও জেরেমি করবিন
বার্নি স্যান্ডার্স ও জেরেমি করবিন

সচরাচর গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্রী বলা হয় তাঁদের উভয়কে। ক্রমে মধ্যপন্থী অবস্থা থেকে বাম দিকে সরে এসেছেন তাঁরা। এ রকম প্রভাবশালী রাজনীতিবিদ ইউরোপ-আমেরিকায় আগেও ছিল। তবে গত পাঁচ-ছয় বছর জেরেমি করবিন ও বার্নি স্যান্ডার্সের উত্থান আলাদাভাবে নজর কেড়েছে।

এ লেখা তৈরির সময় যুক্তরাষ্ট্রে বিলিয়নিয়ার রয়েছেন ৫৮৫ জন এবং যুক্তরাজ্যে ৫৪ জন। উভয় দেশ মিলিয়ে মিলিয়নিয়ার ৮ হাজারের বেশি। তাঁরা বিশ্ব পুঁজিতন্ত্রের অভিভাবকতুল্য। এ রকম দুই জনপদে বসে মুনাফাবাদের কাঠামোগত সংস্কারের কথা বলছেন স্যান্ডার্স ও করবিন। এ সাহস ও ঔদ্ধত্য দেখছে পুরো বিশ্ব। কিন্তু করবিন ও স্যান্ডার্সের আবির্ভাব কি আদৌ ইউরোপ-আমেরিকার সমাজজীবনে কোনো পরিবর্তন আনতে পারল? করবিনের মতো স্যান্ডার্সও কি আশার মরীচিকা দেখিয়ে শেষ পর্যন্ত হারিয়ে যাবেন? এসব নিয়ে পর্যালোচনার শেষ নেই।

অদম্য স্যান্ডার্স

করবিন ও স্যান্ডার্সের মধ্যে দ্বিতীয়জনকে নিয়েই বিশ্ব সংবাদমাধ্যম মেতে আছে এ মুহূর্তে। যুক্তরাষ্ট্রের বছর শেষের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ডেমোক্র্যাটদের মনোনয়ন পেতে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন তিনি। গতবার যে যুদ্ধে তিনি হিলারির কাছে হেরেছিলেন।

এ লেখা তৈরির সময় পর্যন্ত ডেমোক্র্যাটদের শিবিরের ১৯টি ‘প্রাইমারি’ ও ‘ককাস’-এর ৭টিতে জিতেছেন স্যান্ডার্স। ১০টিতে ভিন্ন প্রার্থীরা জিতেছেন। দুটি প্রায় সমান সমান। মনোনয়নের চূড়ান্ত লড়াইয়ে জন্য প্রায় দুই হাজার ‘ডেলিগেট’ জোগাড় করার লক্ষ্য থাকে একজন প্রার্থীর। সেই দৌড়ে দলের ভেতর প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী জো বাইডেন আর স্যান্ডার্সের ব্যবধান এখন সামান্য। ১০–এর বেশি প্রার্থী থাকলেও ইতিমধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতাকে দুজনের লড়াইয়ে পরিণত করেছেন স্যান্ডার্স। জানুয়ারি থেকে ফেব্রুয়ারিতে দলে তাঁর প্রতি সমর্থন ৮ ভাগ বেড়েছে। ‘প্রাইমারি’তে গুরুত্বপূর্ণ রাজ্য ক্যালিফোর্নিয়াতে জিতে চমক দেখিয়েছেন। ক্যালিফোর্নিয়ার বিজয় ডেলিগেটের হিসাবও বদলে দিচ্ছে। তারপরও স্যান্ডার্সকে নিয়ে তুমুল বিতর্ক চলছে দলটিতে। তিনি এমন সব অর্থনৈতিক সংস্কারের আওয়াজ তুলেছেন, যা ধনীদের জন্য অস্বস্তিকর। রিপাবলিকানদের মতোই ডেমোক্রেটিক দলও ওই জগৎকে চটাতে অনিচ্ছুক। কিন্তু স্যান্ডার্স মুখর। তাঁর বয়স এখন ৭৮। কয়েক দিন আগেই এক দফা হৃদ্‌রোগে পড়েছেন। থামতে নারাজ এই অদম্য বুড়ো। তিনি পুরোনো ডেমোক্র্যাট নন। কিন্তু ‘বহিরাগত’ হলেও দলটির নিচুতলার সমর্থকভিত্তি এখন তাঁর সঙ্গে বলেই মনে হচ্ছে। ডেমোক্র্যাটদের রক্ষণশীল অংশ তাঁকে হারাতে সব ভেদাভেদ ভুলে বাইডেনকে সামনে রেখে জোট বাঁধতে শুরু করেছে। স্যান্ডার্সের সামনে সমস্যাটি কেবল ডেমোক্র্যাটদের মনোনয়ন পাওয়া নয়, ট্রাম্পকে তিনি হারাতে সক্ষম কি না, সে প্রশ্নেরও উত্তর দিতে হচ্ছে তাঁকে। ট্রাম্পকে নিয়ে ক্লান্ত বিশ্ব চাইছে ২০২১-এ হোয়াইট হাউসে ভিন্ন মুখ আসুক। তবে এই প্রত্যাশায় খানিকটা পানি ঢেলে দিয়েছে যুক্তরাজ্যের নির্বাচনের ফলাফল।

স্যান্ডার্স ও ব্রিটিশ নির্বাচন

তবে করবিন এখনো যুক্তরাজ্যে প্রধান বিরোধীদলীয় নেতা। লেবার দলের প্রধান হিসেবে আছেন এখনো। পরিবর্তনবাদী রাজনীতিবিদ হিসেবে ইউরোপের ইতিহাস তাঁকে বহুকাল স্মরণে রাখবে। কিন্তু তাঁর আমলের শেষে দলের ভোট কমেছে প্রায় ৮ শতাংশ। আসন কমেছে ৬০টি। ফলে তাঁকে যেতে হবে। দলটি নতুন কাউকে নেতা নির্বাচন করা মাত্র করবিনের বিদায় ঘটবে। লেবারদের ১২০ বছর পূর্তি হচ্ছে এ মাসে। আগামী মাসের প্রথম সপ্তাহেই নতুন নেতা বেছে নেবে তারা। ফলে স্যান্ডার্সের মতো বিশ্ব প্রচারমাধ্যমের মনোযোগে নেই করবিন এখন। একজন সাধারণ সংসদ সদস্যের জীবনে চলে যাচ্ছেন তিনি। হয়তো পুরোনো অতীতের মতো মানবাধিকার বিষয়ে উচ্চকিত থাকবেন, কিন্তু ২০১৯-এর ব্রিটেনে তিনি প্রগতিশীল আর্থসামাজিক কর্মসূচির পক্ষে যে রাজনৈতিক মনোযোগ তৈরি করেছিলেন, তাকে হারিয়ে দেওয়া গেছে।

ফরেন পলিসি জার্নাল বলছে, করবিন এতটাই বাম দিকে মোড় নিয়েছিলেন, তাঁর সঙ্গে তাল মেলানো ব্রিটেনবাসীর পক্ষে কঠিন ছিল। দলেও ঐকমত্যের অভাব ছিল। ভবিষ্যতে যিনিই লেবার দলের নেতা হবেন, তাঁর ওপর চাপ তৈরি হয়ে আছে দলকে নির্বাচনে জয়ের উপযোগী করার। করবিনের ছায়া থেকে বের হতে চাইবে লেবার নেতৃত্ব। বাজার জরিপ প্রতিষ্ঠান ‘ইউগভ’ সদ্য দেখাল, ১৪ শতাংশ লেবার সদস্য কর্মসূচি নিয়ে কোনো আপসে রাজি নন। কিন্তু দলকে ক্ষমতায় দেখতে আদর্শ নিয়ে অল্পবিস্তর আপস করতে তৈরি প্রায় ৮২ শতাংশ। স্পষ্ট যে করবিনের পর লেবার দলে নীতিগত পরিবর্তন ঘটতে থাকবে। পরাজয়ে পরাজয়ে ক্লান্ত তারা। করবিনবাদের ভবিষ্যৎ তাই আপাতত উজ্জ্বল নয় আর। এমনকি তাঁর অনুসারী রেবেকা লং-বেইলে নেতা হলেও।

তবে স্যান্ডার্সের ভবিষ্যৎ নিয়ে কথা উঠলেই করবিনের প্রসঙ্গ আসছে। আমেরিকার আগামী নির্বাচন পর্যন্ত এমন ঘটবে। ওই নির্বাচনের ফল দ্বারা ব্রিটেনে করবিনবাদের ভাগ্য নির্ধারিত হবে আরেকবার। ব্রিটেনের নির্বাচনী ফল স্যান্ডার্সের জন্যও খারাপ হয়েছে। তবে বিস্ময়করভাবে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমকে ব্যবহার করে মাত্র দুই মাসে সেই ধাক্কা সামলে উঠেছে তাঁর প্রচার দল।

করবিনবাদ-স্যান্ডার্সবাদ

২০১৭ সালে ব্রিটেনে এক সফরে এসে বক্তৃতাকালে করবিনের প্রশংসা করেছিলেন ৮ বছরের জ্যেষ্ঠ স্যান্ডার্স। করবিন তখন দেশ-বিদেশে ব্রিটেনের নীতিকৌশল নিয়ে প্রবল প্রশ্ন তুলছিলেন। লেবার দলকেও ভেতর থেকে পাল্টাতে শুরু করেন। স্যান্ডার্সের জন্য সেটাই ছিল সংহতির জায়গা। তাঁকেও আমেরিকায় ‘ডেমোক্র্যাট’ এলিটদের বিরুদ্ধে লড়ে দলে জায়গা করতে হয়েছে।

দুজনের প্রধান মিলের জায়গা তাঁরা কাজটিতে কিছুটা সফল। মাঠপর্যায়ে শ্রমজীবী জনগোষ্ঠীগুলো এবং কালো ও মিশ্র বর্ণের মানুষদের সংগঠিত করে এ পরিবর্তন ঘটানো গেছে। করবিন তরুণদের ব্যাপক হারে রাজনীতিতে এনেছেন। ২০১৫-এর আগস্টে দলটিতে পূর্ণ সদস্য ছিল ৩ লাখের কম। এখন ৫ লাখের বেশি। স্যান্ডার্সও আমেরিকার শ্রমজীবীদের একাংশকে আবার ডেমোক্র্যাট শিবিরে জড়ো করছেন। যাঁরা করপোরেটবান্ধব নীতির কারণে এ দল থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিলেন একদা। স্যান্ডার্সের লক্ষ্য দুই কোটি নতুন ভোটার।

করবিন ও স্যান্ডার্সের এ কৌশলের সাংগঠনিক তাৎপর্য অনেক। ডেমোক্রেটিক পার্টি ও লেবার পার্টিতে কাঠামোগত গণতন্ত্রায়ণ বেড়েছে। এর আর্থিক ফলাফলও ইতিবাচক। ২০১৭ সালে লেবারদের সদস্য চাঁদা ছিল রক্ষণশীল দলের চেয়ে ১০ গুণ বেশি। পরের বছর সদস্যদের থেকে দলের আয় আগের চেয়ে প্রায় ২০ লাখ পাউন্ড বেড়েছে। সদস্য চাঁদা দিয়েই ইউরোপের অন্যতম সচ্ছল পার্টি এখন তারা।

স্যান্ডার্সও ‘গরিব’ সমর্থকদের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দানে বিশাল এক নির্বাচনী তহবিল গড়ে তুলেছেন। জানুয়ারিতে তিনি ২৫ মিলিয়ন ডলার তহবিল পেয়েছেন। ফেব্রুয়ারিতে ৪৬ দশমিক ৫ মিলিয়ন ডলার। বৃদ্ধিটি চোখে পড়ার মতো। করবিনের মতো স্যান্ডার্সের টিমে রয়েছে নিবেদিতপ্রাণ একদল কর্মীগোষ্ঠী। তবে অনেক সময় এই কর্মীরা ‘গোত্র’-এর মতো রক্ষণশীল আচরণ করে ফেলে, যার ফলে দলে গোষ্ঠী–সংঘাতও বাড়ে। এ কারণেই হিলারি ক্লিনটনের সমর্থক গোষ্ঠীসহ ডেমোক্র্যাটদের রক্ষণশীল ধারা স্যান্ডার্সবাদকে ‘প্রতিবিপ্লব’ হিসেবে দেখছে এখন। করবিনবাদ যেভাবে লেবার দলে অভ্যন্তরীণ আদর্শিক সংঘাত বাড়িয়েছে, স্যান্ডার্সবাদও তাই।

তবে সমাজের নিচুতলায় করবিন ও স্যান্ডার্সের আবেদন অনেক। এর কারণ, উভয়ে অর্থনৈতিক অসাম্য ও শ্রেণিভেদ নিয়ে আলাপ তুলতে পছন্দ করেন। উভয়ে নিম্নবিত্ত-মধ্যবিত্তের জীবনযাত্রার মান বাড়াতে চান। শিক্ষার্থীদের বেতন কমানো বা তুলে দেওয়ারও পক্ষে উভয়ে। স্যান্ডার্স মনে করেন, ‘এগুলো কেবল আমেরিকার বিষয় নয়, অন্যান্য দেশেরও বিষয়; বিশ্বের ৯৯ শতাংশের স্বার্থ আছে এতে।’ করবিন রেলওয়ের জাতীয়করণ চেয়েছিলেন। জনস্বাস্থ্যের দায়িত্বও রাষ্ট্রের বলে মনে করতেন। স্যান্ডার্সের বড় ইস্যু নিম্নতম মজুরি হার বাড়ানো। এভাবেই দুজন রাজনৈতিক বিতর্কের জায়গা ‘মধ্য-ডান’ থেকে ‘মধ্য-বাম’ অবস্থানে টেনে আনায় সফল। তবে উভয়ের রয়েছে একই রকম শক্তিশালী প্রতিপক্ষ।

পিউ গবেষণা কেন্দ্রের হিসাবে আমেরিকার ২৭ শতাংশ মানুষ এখন নিজেদের ডেমোক্রেটিক সমর্থক হিসেবে পরিচয় দেয়। রিপাবলিকান পরিচয় দেওয়া মানুষের সংখ্যা ৩০ শতাংশ। ৪২ শতাংশ বলেছেন তাঁরা স্বতন্ত্র ও সিদ্ধান্তহীন। আদর্শিক দিক থেকে আমেরিকা একটা মধ্য-ডান চরিত্রের দেশ। বহুকাল ধরে এখানে সমাজতন্ত্রকে ভীতিকর বিষয় হিসেবে প্রচার চালানো হয়। মার্টিন লুথার কিংকেও ‘কমিউনিস্ট’ বলে কোণঠাসা করা হতো। এ রকম দেশে স্যান্ডার্সের মতো বামদের প্রেসিডেন্ট হওয়া দুরূহ। যেভাবে রক্ষণশীল ভাবাদর্শের ব্রিটেন করবিনকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে মেনে নেয়নি। ফলে করবিনের আদর্শ আসলে অজনপ্রিয় বরিস জনসনকে সাহায্য করেছে কি না, সে প্রশ্ন আছে। যেভাবে স্যান্ডার্সের মনোনয়নও ট্রাম্পের জন্য উপহারস্বরূপ হয়ে উঠতে পারে। অনেক ডেমোক্র্যাট তাই বলছেন, স্যান্ডার্সকে মনোনয়ন দেওয়া আসলে ট্রাম্পকে আগাম জেতানো। এসব অভিমত অবশ্যই অতি বিতর্কিত। তবে সারবত্তা আছে তাতে।

করবিনের সঙ্গে স্যান্ডার্সের আরেক মিল নির্বাচনী প্রচারণায় করপোরেট জগতের পাশাপাশি উভয়ের বিরুদ্ধে রয়েছে রাষ্ট্র হিসেবে ইসরায়েল ও ভারত। যদিও যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যে থাকা সব ইহুদি ও ভারতীয় বংশজাত ট্রাম্পের সমর্থক নন, কিন্তু বিজেপি ইতিমধ্যে স্যান্ডার্সের বিরুদ্ধে নামার হুমকি দিয়ে রেখেছে। বিজেপির সাংগঠনিক সম্পাদক বি এল সন্তোষ ২৭ ফেব্রুয়ারি টুইটারে এ হুমকি দেন। স্যান্ডার্স দিল্লির সাম্প্রতিক সহিংসতার নিন্দা করতে ট্রাম্পের ব্যর্থতায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছিলেন। সে কারণে বিজেপি ক্ষুব্ধ। ২০১৯-এর নভেম্বরে একইভাবে করবিনের বিরুদ্ধে প্রচারে নামে ওএফবিজেপি (ওভারসিজ ফ্রেন্ড অব বিজেপি)। অন্তত অল্প কয়েকটি আসনে লেবার দলের পরাজয়ে ব্রিটেনের ১৪ লাখ ভারতীয় বংশজাত ভোটারের মৃদু ভূমিকা ছিল। সেই তুলনায় ইসরায়েল করবিনকে ভুগিয়েছে বিপুলভাবে।

স্যান্ডার্স সম্প্রতি নির্বাচনী এক বিতর্কে ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহুকে ‘প্রতিক্রিয়াশীল বর্ণবাদী’ বলে যেন মৌচাকে ঢিল মারলেন। তিনি যুক্তরাষ্ট্রের দূতাবাস জেরুজালেম থেকে তেলআবিবে ফেরানোরও পক্ষে। এটা শোনা ইসরায়েলের পক্ষে দুঃসহ। লেবার দলের অনেকে মনে করেন, নির্বাচনের আগে করবিন ইসরায়েলের সঙ্গে সংঘাতে না জড়ালেই ভালো করতেন। সংবাদমাধ্যম জগতে ইসরায়েলের প্রভাব বিপুল। করবিনের মতো স্যান্ডার্সকেও এখন বিশাল এ প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে লড়তে হচ্ছে।

বিদেশনীতি বনাম অর্থনীতি

দেশ-বিদেশের সব প্রতিপক্ষের মিলিত চেষ্টায় করবিনের রাজনৈতিক ভাগ্য আপাতত নির্ধারিত হয়ে গেছে। স্যান্ডার্স সম্পর্কে এখনো সে রকম চূড়ান্ত কথা বলার সময় আসেনি। করবিন লেবার দলে টনি ব্লেয়ারের মতো প্রভাবশালী পুরোনোদের অনুসারী দ্বারা বারবার আক্রান্ত হয়েছেন। যাঁরা মনে করেন, করবিনের রাজনীতি ‘পশ্চিমা মূল্যবোধের বিরোধী’। স্যান্ডার্সও একই আদর্শিক কারণে হিলারি-ওবামার মতো প্রভাবশালী ডেমোক্র্যাটদের অসহযোগিতার মুখে আছেন।

করবিনকে দলের ভেতর থেকে অনেক অন্তর্ঘাত সামলাতে হলেও লেবার দলে প্রচুর বামপন্থী সংগঠক আছেন এখনো। কিন্তু স্যান্ডার্স এমন একটি দলের মনোনয়ন চাইছেন, যেটা মোটেই বামপন্থীদের দল নয়। পিউ রিসার্চ সেন্টারের উপাত্ত অনুযায়ী ডেমোক্রেটিক পার্টিতে মধ্যপন্থীরা সংখ্যাগরিষ্ঠ। এমনকি অন্তত ১৫ শতাংশ সদস্য রক্ষণশীল আদর্শের। এ রকম সদস্যরা স্যান্ডার্সের ‘বিনা খরচের স্বাস্থ্যসেবা’ ও ‘বিনা মূল্যের শিক্ষা’য় কতটা আগ্রহী হবেন, তা প্রশ্নসাপেক্ষ। এখন পর্যন্ত স্যান্ডার্স মনোনয়নের দৌড়ে ডেমোক্র্যাট শিবিরে মূল প্রতিদ্বন্দ্বিতায় থাকলেও তাঁর পক্ষে এমন কোনো জনজোয়ার বইছে না, যা ট্রাম্পকে নিশ্চিতভাবে ধরাশায়ী করবে। তবে স্যান্ডার্স মনে করেন, তাঁর নির্বাচনী প্রচারণা একধরনের ‘চলমান বিপ্লব’।

করবিন ‘বৈপ্লবিক পরিবর্তন’ আনতে চেয়েছিলেন মুখ্যত ব্রিটেনের বিদেশনীতিতে। আন্তর্জাতিক রাজনীতির বিভিন্ন বিষয়ে স্যান্ডার্সের চেয়ে তাঁকে বেশি আগ্রহী ও র‍্যাডিক্যাল মনে হয়েছিল। ভোটাররা তাতে আগ্রহ দেখাননি। কিন্তু তাতে যুদ্ধ থামছে না। নেতৃত্ব ছেড়ে চলে যাওয়ার মুহূর্তেও লেবার দলকে ‘করবিনবাদ’ থেকে পরিশুদ্ধ করতে ব্রিটেন-আমেরিকার প্রধান প্রধান প্রচারমাধ্যমে চেষ্টায় কমতি নেই আজও। বোঝা যাচ্ছে, করবিনের ছায়ার সঙ্গেও যুদ্ধ চলবে। সে কারণেই হয়তো, স্যান্ডার্স বিদেশনীতি নিয়ে দেশটির প্রভাবশালী সামরিক আমলাতন্ত্রকে খ্যাপাচ্ছেন কম। তাঁর প্রচার আন্দোলনের মূল মনোযোগ অর্থনৈতিক।

শ্বেতাঙ্গ ‘পরিচয়ের রাজনীতি’

আমেরিকার ধনীদের সংগঠনগুলো স্যান্ডার্সসূচিত ‘বিপ্লব’-এর বিপরীতে দাঁড়াবেন, এটা বোধগম্য। কিন্তু ডেমোক্র্যাটদের বড় একাংশও তাঁর বিরুদ্ধে সর্বোচ্চ শক্তিতে যে সোচ্চার, এটা বেশ কৌতূহলময়। প্রাইমারির আগে আগে তাঁরা দলের মাঠপর্যায়ের কর্মীদের ভয় দেখিয়ে বলছেন, বেশি বামপন্থী কাউকে সমর্থন দিয়ো না। স্যান্ডার্সকে মনোনীত করলে ব্রিটেনের মতো ঘটনা হবে। করবিনের অধীনে লেবার দল যেভাবে কয়েক দশকের মধ্যে সবচেয়ে খারাপ ফল করেছে, সেভাবেই ট্রাম্পের কাছে ডেমোক্র্যাটরা হেরে যাবেন স্যান্ডার্সের কারণে। বড় ধনীরাও দলটি থেকে মুখ ফিরিয়ে নিতে পারেন। প্রভাবশালী সংবাদমাধ্যমও একই আচরণ করবে। এসব যুক্তি দিয়েই স্যান্ডার্সবিরোধী ডেমোক্র্যাটরা তাঁকে ‘ক্ষতিকর’ মনে করছেন। ডেমোক্র্যাট দলকে ‘মধ্যপন্থী’ কোনো প্রার্থী প্রেসিডেন্ট পদের লড়াইয়ে নামানো উচিত, এ রকম প্রার্থীই রিপাবলিকান ট্রাম্পকে হারাতে পারবেন বলে ডেমোক্র্যাটদের একাংশের যুক্তি।

তাঁদের বক্তব্যের সামাজিক সত্যতা খুঁজতে গিয়ে এক জরিপে (গ্যালাপ, মে ২০১৯) দেখা গেল, এ মুহূর্তে একজন সমকামী বা নাস্তিক এমনকি একজন মুসলমানকেও প্রেসিডেন্ট হিসেবে মেনে নিতে পারে সংখ্যাগরিষ্ঠ আমেরিকা; কিন্তু ৫৩ শতাংশ নাগরিক সমাজতন্ত্রীদের ওই পদে দেখতে অনিচ্ছুক।

সম্ভবত এ কারণেই ট্রাম্প ও রিপাবলিকান শিবির চাইছে স্যান্ডার্সের মতো প্রার্থীই প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে ভালো। ব্রিটেনে করবিনের পরিণতি তাদের উৎসাহ দিয়েছে। তবে করবিন কেবল উচ্চ ধনীদের বিদ্বেষের শিকার নন, পাশাপাশি শ্রমজীবীরাও তাঁকে ভোট দেননি। এ হিসাবটা বড় অদ্ভুত। করবিন যাঁদের জন্য এবং যাঁদের স্বার্থে গত কটি বছর লড়েছেন, তাঁরা লেবারদের ভোট দেননি। তিনি মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্তদের স্বাস্থ্য, শিক্ষা, বাসস্থান প্রশ্নে ছিলেন সবচেয়ে সোচ্চার। বেকারত্ব কমানো তাঁর বড় কর্মসূচি ছিল। কিন্তু ব্রিটেনের যেসব এলাকায় এ রকম ভোটার বেশি, সেখানে লেবার দল হেরেছে বিপুল ভোটে। এই ভোটাররা প্রভাবিত হয়েছেন শ্বেতাঙ্গ ‘পরিচয়ের রাজনীতি’ দ্বারা। আমেরিকায়ও শ্বেতাঙ্গ শ্রেষ্ঠত্বের আবেগ প্রবল এ মুহূর্তে। সমাজে রিপাবলিকানদের সংখ্যাও কম নয়। ট্রাম্প–শিবির যে শরণার্থীবিরোধী রাজনীতি করছে, সেটা ভেবেচিন্তেই।

করবিন ইরাক থেকে কাশ্মীর পর্যন্ত বিদেশনীতি পাল্টানোর কথা জানাচ্ছিলেন বারবার। কিন্তু সেসব কর্মসূচির চেয়ে ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে বের হয়ে ‘ব্রিটেনের গৌরব পুনরুদ্ধারে’র রক্ষণশীল রাজনীতি বেশি পছন্দ করেছে নিম্নবিত্ত সমাজ। রাজনীতিবিদ্যার জন্য এটা এক নতুন শিক্ষা। প্রশ্ন উঠেছে, স্যান্ডার্সও একই আবেগের কাছে পরাস্ত হবেন কি না। এ বিষয়ে চূড়ান্ত কথা বলার সময় আসেনি অবশ্য এখনো।

যুক্তরাষ্ট্রে ইহুদি প্রেসিডেন্ট?

ডেমোক্রেটিক পার্টির প্রাইমারি ও ককাসের ভোটাভুটি শেষ হবে জুন নাগাদ। তখনই কেবল স্যান্ডার্সের ভাগ্য নির্ধারিত হবে। মনোনয়ন পেলে, তারপর থাকছে চূড়ান্ত ভোটের হিসাব। ফলে ব্যক্তি স্যান্ডার্সের জন্য ইনিংসের অনেকখানি এখনো বাকি। করবিন হেরে যাওয়ার পেছনে বড় কারণ ছিল ইইউ থেকে ব্রিটেনের বেরিয়ে যাওয়ার বিষয়ে একধরনের অস্পষ্ট ও মধ্যপন্থী দোদুল্যমানতা। তিনি সামাজিক ইস্যুগুলোতে যতটা স্পষ্ট ছিলেন নির্বাচনের প্রধান প্রসঙ্গে, ততটাই ছিলেন সিদ্ধান্তহীন। অথচ এটাই ছিল নির্বাচনের প্রধান ইস্যু।

স্যান্ডার্স অধিকাংশ প্রধান নীতিগত বিষয়ে দ্বিধাহীন। ডেমোক্রেটিক পার্টির পুরোনো ভুলগুলোর বোঝা বইতে একদম নারাজ তিনি। এমনকি গত নির্বাচনী যুদ্ধে নিজের ভুলগুলো থেকে শিখেছেন অনেক। ২০১৬–তে হিলারির বিরুদ্ধে তিনি ভরসা করেছিলেন মূলত শ্বেতাঙ্গ ভোটারদের ওপর। কাজ হয়নি। এবার প্রাইমারি ও ককাস জিততে স্প্যানিশ ও কালোদের কাছে টানতে চাইছেন বেশি। এখনো দলে কালোদের মধ্যে তাঁর সমর্থন আশানুরূপ নয়। তাঁরা জো বাইডেনকে পছন্দ করছেন।

স্যান্ডার্সের প্রধান বৈশিষ্ট্য, পরিবর্তন প্রশ্নে অতি উচ্চাভিলাষ। তবে তাঁর মধ্যে মধ্যপন্থী অস্পষ্টতা কম। নিজের রাজনৈতিক অবস্থান নিয়ে লুকোচুরি করেন না। যেমন, জলবায়ু বিপর্যয় মোকাবিলায় অর্থনীতির আমূল রূপান্তরের জন্য ‘গ্রিন টেকনোলজি’র পক্ষে বলছে তিনি। যেখানে অর্থনীতি হবে প্রকৃতি ও ভবিষ্যৎবান্ধব। এ কর্মসূচির জন্য ৫০ ট্রিলিয়ন ডলার দরকার। এ বিনিয়োগ যে নানা উপায়ে বিত্তশালীদের ওপর বাড়তি কর থেকে আসবে, তা–ও হিসাবপত্তর করে জানিয়ে দিয়েছেন ইতিমধ্যে।

এ রকম বহুমুখী করের পদধ্বনি আছে তাঁর প্রচারে। এতে করবিনের মতোই তিনিও ক্রমে চারদিক থেকে আক্রমণে পড়ছেন। গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্রে যে উচ্চবিত্তদের অসুবিধা, সেটা বোঝা গিয়েছিল করবিনের বিরুদ্ধে বহুপক্ষীয় আক্রমণ দেখে। স্যান্ডার্সের বিরুদ্ধেও খোদ ডেমোক্রেটিক পার্টিতে ধনীরা ক্রমে জোটবদ্ধ এখন।

খোদ দলের ভেতর স্যান্ডার্সের কোণঠাসা দৃশ্য আমাজনের মতো বিশাল বিশাল করপোরেটের জন্য বিশেষ উপভোগ্য। আমেরিকার মিডিয়া জগতের দিকে তাকালে বোঝা যায়, স্যান্ডার্সবিরোধিতা কীভাবে শ্রেণিযুদ্ধে রূপ নিয়েছে। মিলিয়নিয়ার-বিলিয়নিয়ার ক্ষমতা, সম্পদ এবং অসাম্যের বর্তমান স্থিতিশীল অবস্থা সহজে বদলাতে দেবে, এটা ভাবা হাস্যকর। এমনকি তারা ডেমোক্র্যাট শিবিরের হলেও। ইতিমধ্যে শেষ হওয়া ডেমোক্রেটিক প্রাইমারি ও ককাসগুলোর ভোট উপাত্ত বিশ্লেষণে দেখা যাচ্ছে, উচ্চ আয়ের সদস্যরা স্যান্ডার্সকে সমর্থন করছেন না। কিন্তু তিনিও হাল ছাড়ার পাত্র নন। ঘণ্টায় ন্যূনতম ১৫ ডলার মজুরির দাবিটি ইতিমধ্যে আমেরিকাজুড়ে এতটা গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে যে স্যান্ডার্স ইতিহাস থেকে হারিয়ে গেলেও এ দাবির ফয়সালা করতে হবে করপোরেটদের। স্যান্ডার্সের ‘সবার জন্য কাজ’ ও ‘সবার জন্য স্বাস্থ্য’-এর দাবি এবং জলবায়ু পরিবর্তন ঠেকানোর জন্য প্রস্তাবিত অর্থনৈতিক সংস্কার কর্মসূচি উত্তর আমেরিকাজুড়ে জনপ্রিয়তা পেয়েছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও তাঁর পক্ষে প্রাধান্য সুস্পষ্ট। তবে এ–ও সাক্ষ্য মেলে, আমেরিকা আদর্শ দেখে ভোট দেয় না, কথা ও কাজের মিল খোঁজে। আর দলীয় কর্মীরা প্রেসিডেন্ট পদে মনোনয়ন দেন কে প্রতিপক্ষকে হারাতে সক্ষম, সেটা দেখে।

স্যান্ডার্স বরাবরই আশ্বস্ত করছেন, নতুন ভোটারদের নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় শামিল করে তিনি ভোটের পুরোনো অঙ্ক পাল্টাবেন। তবে এখনো তিনি রাজনীতিতে অনাগ্রহীদের নির্বাচনী উৎসবে টেনে আনতে পারছেন বলে মনে হচ্ছে না। এমনও মনে হয়নি, ট্রাম্পের ওপর ক্ষুব্ধ মধ্যপন্থী রিপাবলিকানদের তিনি হাতির বদলে ডেমোক্র্যাটদের গাধা প্রতীক পছন্দ করাতে পারবেন। সে রকম নতুন সমর্থক ছাড়া ডেমোক্র্যাটদের বিদ্যমান ভোটব্যাংকের মধ্যে দাঁড়িয়ে ট্রাম্পের বিরুদ্ধে জিতে আসার মতো তরঙ্গ তৈরি স্যান্ডার্সের জন্য কঠিন। সবকিছু মিলিয়ে বিজয়ের সম্ভাবনা তাঁর নেই, এটা যেমন বলা যাচ্ছে না তেমনি সম্ভাব্য বিজয়ী প্রার্থীও বলা যাচ্ছে না তাঁকে।

‘কমরেড’ করবিন যেভাবে রিপাবলিকানদের ছড়ানো জাতীয়তাবাদী আবেগ রুখতে পারেননি, স্যান্ডার্সের সামনে রয়েছে সে রকম সাদা শ্রেষ্ঠত্বের ঢেউ। ডেমোক্র্যাটদের মনোনয়ন নিয়ে ট্রাম্পকে হারাতে পারলে তিনি হবেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রথম ইহুদি প্রেসিডেন্ট।

৭০ শতাংশের বেশি খ্রিষ্টানের দেশ আমেরিকায় ইহুদিরা ৩ শতাংশের কম। দেশটি এখনো তার এ সৌন্দর্য ধরে রেখেছে যে রাজনীতির সর্বোচ্চ পরিসরে আদর্শিক ভিন্নতা নিয়ে লড়তে ধর্ম, জাতি ও লিঙ্গগত পরিচয় সমস্যা হচ্ছে না। এ বহুত্ববাদ অবশ্যই অনন্য এক সাংস্কৃতিক সম্পদ।

আলতাফ পারভেজ: ইতিহাস গবেষক