দুঃসংবাদ দিকে দিকে
রংপুর অঞ্চলের বন্যাদুর্গত অনেক এলাকায় আমি প্রায় প্রতিবছর যাই। একটি বিষয় লক্ষ করেছি, বর্ষা মৌসুমের শেষে বন্যা হলে বন্যার পর নতুন করে ধান রোপণ করলেও ফলন ভালো হয় না। কারণ ধান লাগানোর মৌসুম তত দিনে শেষ হয়ে যায়। তারপরও কৃষকেরা জমি ফেলে রাখেন না। অনেককে জিজ্ঞাসা করেছি, কেন এই সময়েও ধান রোপণ করছে। অনেকের মতো একজন কৃষক বলছিলেন, ‘জমি খালি পড়ি থাকলে মনে হয় বুকটাও খালি পড়ি আছে। ধান হউক আর না হউক, জমি খালি রাইখপার নই।’ সে রকমই টাঙ্গাইলের এক কৃষক ধানের ন্যায্যমূল্য না পাওয়ায় ফসল ঘরে তোলার পরিবর্তে পাকা ধানে আগুন লাগিয়েছেন। বুঝতে হবে, ফসলে যে আগুন দেওয়া হয়েছে সেই আগুন দেওয়ার অবস্থা দেশের প্রায় সব কৃষকের। এই আগুন যদি নেভানো না যায়, তাহলে আমাদের কপালে দুর্গতি থাকা অসম্ভব কিছু নয়।
আমাদের দেশে কৃষকেরা বঞ্চিত হওয়ার ইতিহাস অনেক পুরোনো। শত শত বছর ধরে কৃষকেরা বঞ্চিত। সরকার প্রতিবছর একটি নির্দিষ্ট উচ্চমূল্যে মূল্যে ধান কেনে। এই ধান সারা দেশে একজন ছোট কৃষকও উচ্চমূল্যে সরকারের কাছে বিক্রি করতে পারেন বলে মনে হয় না। সরকারি ধান কেনায় প্রকাশ্য সিন্ডিকেট থাকে। যখন যারা ক্ষমতায় থাকে, সেই দলীয়রা সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণ করে। বড় বড় বক্তব্যে এসব কৃষককে কৃষিনায়ক কিংবা উন্নয়নের নায়ক বলতে আমরা কম করি না। কিন্তু কৃষক যখন ধান, গম, আলুর ন্যায্য মূল্য পান না, তখন তাদের পাশে কাউকে পাওয়া যায় না। প্রত্যেকে মনে করেন কৃষকের সমস্যা আমার সমস্যা নয়। এভাবে মানুষ ব্যক্তিক হতে হতে কুয়োর মধ্যে ডুবে পড়েছে। মানুষের বিপদে মানুষ পাশে নেই। দেশ যদি ভালো না থাকে, তাহলে ঘরের কোণে পালিয়ে বন্দী থাকলেও ভালো থাকা যাবে না। সবাই মিলে ভালো থাকার পথ দিনের পর দিন কমে আসছে। কৃষকেরা ধানের খেতে আগুন দিচ্ছেন, ধান ছিটিয়ে প্রতিবাদ করছেন আর আমরা এই সমস্যা ধানচাষিদের সমস্যা জ্ঞান করে এড়িয়ে যাচ্ছি। আমাদের দেশে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ হওয়ার স্বস্তির ঢেকুর তোলা তবে কি অশ্রুসিক্ত কৃষকের বুকের ওপর দাঁড়িয়ে?
মানবিক রাষ্ট্র কোথায়?
সম্প্রতি এক রাতে ফেসবুকে ঢুকেছি। প্রথমেই খবরের একটি লিংক দেখলাম। সেখানে ৬ বছরের শিশুকে ধর্ষণের ঘটনা। এরপর আরেকটি পত্রিকার একটি লিংক। সেখানে অন্য একজনকে ধর্ষণের ঘটনা। পরে আরেকটি লিংকে তৃতীয় আরেকজনকে ধর্ষণের ঘটনা। এত ধর্ষণের খবর দেখে ফেসবুক থেকে বের হলাম। এসব দেখতে পড়তে একটা কেমন যেন অনুভূতি হয়। অস্থির লাগে। এসব খবর দেখে নিকটাত্মীয়, সহকর্মী যাঁদের কন্যাসন্তান আছে, তাঁদের কথা মনে পড়ল। কিছুদিন আগে আমাদের এক মহিলা সহকর্মী বলছিলেন ‘ছোট্ট মেয়ে, তবুও কোথাও কারও কাছে এক বেলাও রাখার সাহস পাই না।’
আমাদের দেশে যে শিক্ষাব্যবস্থা আছে, তার সঙ্গে শিক্ষার্থীকে মানবিক মূলবোধে গড়ে তোলার কোনো ব্যবস্থা নেই। সবাই শিক্ষালয়ে ছুটছে একটি সনদ সংগ্রহ করার জন্য। যে সনদের চাকরির বাজারে দাম বেশি, সবাই সেই সনদ পেতে চায়। এই সনদধারীরা মানবিক শিক্ষা থেকে দূরে থাকছে। শিক্ষা মানুষকে আলোকিত করার পরিবর্তে দাম্ভিক হতে শেখাচ্ছে। প্রচলিত পৈশাচিকতাকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না। এই শিক্ষা নিয়ে আমরা কী করব? জাতি কি তবে এমএ পাস মূর্খ জাতিতে পরিণত হচ্ছে? আইনের যথাযথ প্রয়োগও কম হচ্ছে। মানবিক মূল্যবোধহীন শিক্ষা আর আইনের দুর্বলতা গলিয়ে ধর্ষণ দিনের পর দিন মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে।
বৈষম্যপূর্ণ পুঁজি বিকাশের বিষফোড়া
কয়েক দিন আগে রাজধানীতে এক পিতা সন্তানের জন্য দুধ চুরি করতে গিয়ে ধরা পড়েন। সহৃদয় পুলিশ কর্মকর্তা জানতে পেরে ওই দুধের মূল্য পরিশোধ করে তাঁকে ছেড়ে দেন। নিজের ফেসবুকে ওই কর্মকর্তা ঘটনার বর্ণনা দিতে গিয়ে নিজের দুই সন্তানের মুখ মনে পড়ার কথাও লিখেছেন।
এই কাহিনি পড়ে জ্যোতিপ্রকাশ দত্তের ‘কেষ্ট যাত্রা’ ছোটগল্পের কথা মনে পড়ল। গল্পের কেন্দ্রীয় চরিত্র কেষ্ট। সমাজে তাঁর ভদ্রলোক বলে একটি পরিচিতি আছে। দেশবিভাগের সময় দেশকে ‘জননী জন্মভূমিশ্চ স্বর্গাদপি গরিয়সী’ জ্ঞান করে দেশ ছেড়ে তিনি যাননি। দেশবিভাগে অনেক হিন্দু ভারতে যায় এবং অনেক মুসলমান বাংলাদেশে আসে। এতে কেষ্টর হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসার বাজার একেবারেই পড়ে যায়। নিজের পরিবারের খাবার জোটাতে মিথ্যা আশ্বাস দিয়ে অনেকের কাছে তিনি টাকা নিয়েছিলেন। একদিন পাওনাদাররা তাঁকে ধরে সালিসের ব্যবস্থা করেন। একপর্যায়ে তার ছেঁড়া ছাতা কেড়ে নেওয়া হয়। কেষ্টকে থুথু মাটিতে ফেলে জিভ দিয়ে চাটানো হয়। চারদিকে মানুষের জটলা দেখে তার ছেলে সুখেন উৎসুক হয়ে এগিয়ে যায়। গিয়ে দেখে তারই বাবা কেষ্টর শাস্তি হচ্ছে। বাবা ছেলেকে এসব ঘটনা বাড়িতে বলতে নিষেধ করেন।
দেশবিভাগ-পরবর্তী এই কাহিনি প্রায় ৭২ বছর আগের। সদ্য স্বাধীন হওয়া পাকিস্তান রাষ্ট্রের পূর্ববঙ্গের। ৭২ বছর পর দেশের উন্নয়ন হয়েছে আকাশছোঁয়া। মাথাপিছু মাসিক আয় প্রায় ৪ হাজার টাকা। ৭২ বছর পরের বাংলাদেশেও বাবাকে দুধ চুরি করতে হয়। দেশের গড় উন্নয়ন বেড়েছে। একই সঙ্গে বেড়েছে উচ্চবিত্ত নিম্নবিত্তের পার্থক্য। এটা কোনো উন্নয়ন হতে পারে না। এই উন্নয়ন সমাজে নানাবিধ সংকট তৈরি করছে, আরও করবে। বিষফোড়ার মতো সেসব সমস্যা বড় হয়ে দেখা দেবে। রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক উন্নয়ন আর উন্নত রাষ্ট্র এক নয়। আমরা উন্নত রাষ্ট্রের জন্য কোনো কিছুই করছি না। করছি রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক উন্নতি। তাও আবার গড় হিসাবে। দেশজুড়ে কতজন আছে পদপদবির মোহে। প্রতিবাদী মানুষ খুঁজে পাওয়া কঠিন হচ্ছে। কয়েক দিন আগে সহকর্মী বলছিলেন দেশে জনসংখ্যা বাড়ছে, মানুষ বাড়ছে না।
বর্তমান বাংলাদেশে কৃষক দিশাহারা। দেশের বৃহৎ জনগোষ্ঠী কৃষক। তাঁদের দিশাহারা রেখে বাংলাদেশ ঠিক পথে চলতে পারে না। উন্নয়নবৈষম্যের ব্যাধিতে আক্রান্ত বাংলাদেশ সুস্থ থাকতে পারে না। মানবিক মূল্যবোধহীন শিক্ষা যৌননিপীড়ন বন্ধ করতে পারবে না। রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ হাড়েরও ঘরখানি কবিতায় লিখেছিলেন ‘রাজনীতিকের ধমনি শিরায় সুবিধাবাদের পাপ...বুদ্ধিজীবীর রক্তে স্নায়ুতে সচেতন অপরাধ।’ রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহার কবিতায় বিধৃত বাস্তবতায় এখনো চলছে দেশ। কয়েক দিন আগে কবি হেনরী স্বপনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। ফেসবুকের যে স্ট্যাটাস দেওয়ার কারণে তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে, সেখানে গ্রেপ্তারের কোনো কারণ দেখলাম না। এখন তিনি জামিনে আছেন। তাই বলে প্রকৃত মানুষ জাগবে না? নারীরা নিরাপদ হোক, ধানচাষি হোক সম্মানিত, বৈষম্য দূর হোক, অকারণ গ্রেপ্তার বন্ধ হোক। বিপর্যস্ত মানবতা ও বৈষম্যপূর্ণ পুঁজি বিকাশের বিষফোড়া থেকে মুক্তি চাই।
তুহিন ওয়াদুদ: রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের শিক্ষক এবং রিভারাইন পিপলের পরিচালক।