আসলে ওপরওয়ালা ‘স্যারেরা’ কেউ কিছু জানতেন না। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের গাড়িচালক আবদুল মালেক যে এত ধনবান তা নাকি জানতেন না তাঁর বস স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক এনায়েত হোসেন। মহাপরিচালকের জন্য বরাদ্দ করা সরকারি পাজেরো জিপ ভোগদখল করছেন তাঁরই গাড়িচালক। এটা না জেনেই মহাপরিচালক আলাদা গাড়ি ব্যবহার করতেন? আর তাঁর দপ্তরের তিনটি গাড়ি হাঁকিয়ে বেড়াচ্ছেন আবদুল মালেক। কে যে কার কর্তা, বোঝা বড়ই মুশকিল। তবে প্রবাদে বলে, লেজ গরুকে নাড়ায় না, গরুই লেজ নাড়ায়। স্যারদের ড্রাইভার যদি এত সম্পদ গড়েন, স্যারদের না জানি আরও কত।
এক স্বাস্থ্য অধিদপ্তরেই মালেক সাহেব তাঁর পরিবারের সাতজনকে চাকরি দিয়েছেন। এঁরা কেউ তাঁর দ্বিতীয় স্ত্রী, কেউ কন্যা, কেউবা মেয়ের জামাই, কেউবা ভাগনে, কেউবা ভায়রা ভাই। কিন্তু কর্তারা কেউ কিচ্ছুটি জানতেন না। ২০০৯-১০ সালে স্বাস্থ্য সহকারী পদে শতাধিক লোককে নিয়োগ পাইয়ে দেওয়ার বিষয়ে হাত আছে মালেকের। দুদক চাইলে, পুলিশ–র্যাব যত্ন করে ধরলে আরও জানা যাবে। তখন অনেকের চোখ ছানাবড়া হয়ে যাবে। তখন গত ১০–১২ বছরে মালেকের সব বস, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক পদে আসা সকল কর্মকর্তা সমস্বরে বলবেন, ‘আমরা ধোয়া তুলসীপাতা, আমরা কিচ্ছুটি জানতাম না।’ কিছু না জানা এইসব কর্তৃপক্ষের হাতেই জনগণের জানমালের ভার।
স্বাস্থ্যের চালকের কুকীর্তির কিছই নাকি জানতেন না অধিদপ্তরের মহাপরিচালক এনায়েত হোসেন। রিজেন্ট শাহেদের কারবার নিয়েও কেউ আগে কিছু জানতেন না। বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ পরিকল্পিতভাবে চুরি করা হলো, গভর্নর বললেন ‘আগে জানতাম না’। স্বাস্থ্য খাতের কেনাকাটায় ‘মিঠু চক্রের’ বিপুল দুর্নীতির খবর হওয়ার পরও শোনা গেল, ডিজি মহোদয় কিছু জানতেন না। যেমন যুবলীগের ক্যাসিনো সম্রাট-খালেদের তেলেসমাতি নিয়েও যুবলীগের সভাপতি কিংবা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী কিছুই জানতেন না। নরসিংদীর পাপিয়ার ব্যাপারেও কর্তৃপক্ষ বেখবর ছিল, উদাসীন ছিল ফরিদপুরের দুই ভাইয়ের দিনকে রাত রাতকে দিন করার ক্ষমতাবাজির ব্যাপারেও।
ক্যাসিনো সম্রাটের তেলেসমাতি প্রকাশিত হলে যুবলীগের তখনকার সভাপতি ওমর ফারুকও এভাবে বলেছিলেন, তিনি কিছুই জানতেন না। সঙ্গে ঠেস দিয়ে বলেছিলেন, ‘আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এবং সরকারের লোকেরা কি এত দিন আঙুল চুষেছেন?’ নরসিংদীর পাপিয়ার ব্যাপারেও সবাই বেখবর ছিল, যেমন উদাসীন ছিল ফরিদপুরের দুই ভাইয়ের তুঘলকি কাণ্ডের বিষয়েও।
কক্সবাজারের সেঞ্চুরিয়ান ক্রসফায়ারকারী ওসি প্রদীপের বিশাল কর্মতালিকার কিছুই তাঁর ওপরের বসেরা জানতেন না, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানতো না, পুলিশের ওপরমহলও অন্ধকারেই ছিল। এখন আদালত তাঁর স্ত্রীর কোটি কোটি টাকার সম্পদ ক্রোক করার নির্দেশ দেওয়ার পর স্ত্রীও মনে হয় প্রথম জানলেন যে এসব ছিল অবৈধ, এই সম্পদের গায়ে মানুষের রক্ত লেগে আছে। স্বাস্থ্যের গাড়িচালকের স্ত্রী–কন্যারা অবশ্য এখনো কিছু জানতে নারাজ। তাঁদের দাবি সব মিথ্যা, সব ভুল বোঝানোর ফল।
এখন স্বাস্থ্যের গাড়িচালক আবদুল মালেকের বহু খবর বের হবে। সবাই আমরা আবদুল মালেকের শাস্তি চাইব। ভুলে যাব যে, ‘স্যারদের আড়াল করতেই ড্রাইভার নিয়ে নাটক’। শাহেদ–মালেক ইত্যাদির ধনসম্পদের খোঁজ মেলে, কারণ সেগুলি দেশে থাকে। কিন্তু স্যারেদের টাকা তো থাকে বিদেশে, অত লম্বা হাত তো আমাদের নেই।
বিপদে পড়লে টিকটিকি লেজ খসিয়ে পালায়, এভাবেই অমুক–তমুকের হাতে হাতকড়া পড়লেও স্যারেরা বহাল তবিয়তেই থেকে যাবেন। নিচুতলার লোকেরা তো খরচযোগ্য। বিভিন্ন খাতের প্রত্যেক সেয়ানা দুর্নীতিবাজের পেছনে ছিলেন কোনো না কোনো ‘স্যার’। এ রকম মিঠু, শাহেদ, মালেক, পাপিয়া, সম্রাটেরা হলো সিঁদকাঠি। চোর যে কাঠি দিয়ে মাটির ঘরের সিঁদ কাটে, তাকে বলে সিঁদকাঠি। আরেক রকম কাঠি হলো আড়কাঠি। ছেলেমেয়েদের ফুঁসলিয়ে চুরি করে দাসের বাজারে বেচে দিত আড়কাঠিরা। তবে সবার বড় হলো কলকাঠি। গোপনে থেকে যারা সব কিছু নিয়ন্ত্রণ করেন, দুর্নীতির কলের মূল কাঠিটা তাঁদের হাতেই থাকে। সংকটে পড়লে সিঁদেল চোর, আড়কাঠিদের ওপর থেকে ছায়া সরিয়ে তাঁরা চলে যান আরও গভীর কারও ছায়াতলে—ধরাছোঁয়ার বাইরে। যাবার আগে একটি সংলাপই তাঁরা দেন, ‘আমি কিছুই জানতাম না।’ এ কেমন রঙ্গ জাদু এ কেমন রঙ্গ জাদু।
আসলে সবাই সবকিছু জানতেন। কোনো দপ্তরের অফিস সহকারী, কেরানি বা অফিসার বছরের পর বছর দুর্নীতির হাটবাজার চালচ্ছেন আর কেউ কিছু জানেন না এটা অসম্ভব। তাঁরা আলবৎ জানতেন। জেনেশুনেই ডিজি মহোদয় তাঁর নামে বরাদ্দ করা গাড়ি চালকের ভোগে লাগাতে দিয়েছেন। সেই চালক আবার এতই দুর্ধর্ষ যে, র্যাবের হাতে ধরা পড়ার সময় তাঁর সঙ্গে পাওয়া যায় দামি পিস্তুল, গুলি আর নকল টাকার বান্ডিল।
জনগণ আসলেই মুখে আঙুল পুরে চুষতে চুষতে দেখছে, কত তলার মামুদ ওপরে গেল আর ওপরের মামুদ তলায় গেল; কিন্তু আড়কাঠিদের দিয়ে কলকাঠি নাড়ানোদের কিছুই হয় না। যদুমধুর হাতে হাতকড়া পড়ে, মহাজনেরা নতুন কাঠি বানিয়ে রঙ্গ জাদু চালাতেই থাকেন, চালাতেই থাকেন। কতজন আঙুল ফুলে কলাগাছ হয়ে গেল আর স্যারেরা কিছু জানি না বলে দায় খালাস করে সাধু সেজে থাকছেন। তাঁদের আঙুল কাঠি নাড়াচাড়াতেই ব্যস্ত। প্রকৃত আঙুল চোষার দল হলো আমজনতা। সব জেনেও তাদের চুপ করে থাকতে হয়। এই চুপজনতার জন্য শিল্পী গান গেয়েছেন, ‘আগে জানতাম যদি শুভংকরের ফাঁকি, আমরার ঘরে পড়ত না ভাই শূন্য’।
স্যারেরা আপন স্বার্থে সব জেনেশুনে চুপ থাকেন। কিন্তু সাড়ে দশ কোটি সাবালক নাগরিক বলতে পারেন না যে, ‘কোনো দস্যু রাতের অন্ধকারে আমাদের বস্তায় পুরে চুরি করে দিয়েছে, আমরা কিছুই জানতাম না; তাই কিছু করতে পারিনি!
বাঁচতে হলে জানতে হবে।
ফারুক ওয়াসিফ: প্রথম আলোর সহকারী সম্পাদক ও লেখক।