দারিদ্র্য ধেয়ে আসছে সৌদির দিকে
১৯৯০–এর দশকে সৌদি আরবে বড় হওয়ার সুবাদে আমি খুব ভালো করেই জানি সৌদি সমাজ কীভাবে শ্রেণিবিভক্ত হয়ে আছে। রাজকীয় পরিবার ও অতি ধনী, মধ্যবিত্ত এবং দরিদ্র—এসব শ্রেণিতে তারা বিভক্ত। সামাজিক ও সাংস্কৃতিকভাবে নিজ নিজ সম্প্রদায়কে তারা আলাদা করে রেখেছে।
অন্য অনেক শহরের মতো জেদ্দা (যেখানে আমি ২০০৫ থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত সাংবাদিক হিসেবে কাজ করেছি) শহরও দুই ভাগে বিভক্ত। এই শহরের উত্তর দিকের অংশে থাকেন রাজকীয় পরিবারভুক্ত এবং উচ্চমধ্যবিত্ত পরিবারের লোকেরা। দক্ষিণ অংশে থাকেন অভিবাসী শ্রমিক, অবৈধ অভিবাসী এবং মধ্যবিত্ত সৌদি নাগরিকেরা। আমি অভিজাত শ্রেণির কেউ ছিলাম না বলে দক্ষিণ দিকেই আমার বাস ছিল।
আল মদিনা নামের একটি সংবাদপত্রে আমি কাজ করতাম। অফিসে যাওয়ার পথে রাস্তায় এক নারীকে ফেরি করে জামাকাপড় বেচতে দেখতাম। তাঁর সঙ্গে কথা বলে জেনেছিলাম তঁার নাম ওম মোহাম্মাদ। স্বামী মারা গেছে। সংসারে পাঁচ ছেলেমেয়ে। তাঁদের খাওয়া–পরার খরচ জোগাড় করতে তাঁকে ফেরি করতে হচ্ছিল। ওম মোহাম্মাদের দুটি ছেলে অর্থের অভাবে স্কুল থেকে ঝরে গিয়েছিল। সৌদিতে অতিদরিদ্রদের জন্য সরকারের দিক থেকে কিছু সহায়তা দেওয়ার ব্যবস্থা আছে। কিন্তু তা পেতে গেলে যে আমলাতান্ত্রিক পর্যায়গুলো পার হতে হয়, তা ওম মোহাম্মাদের মতো প্রায় নিরক্ষর নারীর পক্ষে অসম্ভব। এই সহায়তা পেতে গেলে ওমকে একটি ব্যাংক হিসাব খুলতে হতো। কিন্তু হিসাব খুলতে যে নিম্নতম অঙ্কের অর্থ থাকা দরকার, তা তাঁর কাছে ছিল না। ওমের মতো প্রায় ৭০ লাখ সৌদি নাগরিকের কোনো ব্যাংক হিসাব নেই। এই ৭০ লাখের ৬০ শতাংশের বেশিই নারী।
ওম মোহাম্মাদ ছেলেমেয়েদের নিয়ে একটি বস্তিতে বাস করতেন। সেখানে না ছিল স্বাস্থ্যসম্মত পানি, না পয়োনিষ্কাশন ব্যবস্থা। বৃষ্টি হলেই ঘরে ড্রেনের পানি ঢুকে পড়ত। খাবার পানি পাশের কোনো মসজিদের অজুখানা থেকে জোগাড় করতে হতো। ওম মোহাম্মাদের মতো অন্তত ১০ লাখ মানুষ এখন সৌদি আরবে মানবেতর জীবন যাপন করছে অথচ বাকি বিশ্ব তাঁদের বিষয়ে কিছুই জানতে পারছে না।
বিভিন্ন জরিপে দেখা গেছে, সৌদির অন্তত ৩ কোটি ৪০ লাখ মানুষের মধ্যে ২০ শতাংশ এখন দরিদ্র। সরকারই এই দারিদ্র্য দূর করার পথে প্রধান বাধা হয়ে আছে। ক্ষমতাসীনেরা এসব গরিব মানুষের অস্তিত্বই স্বীকার করতে চায় না। যদি তাদের গরিব বলে মেনে নেওয়া হয়, তাহলে বৈষম্য কমানোর দিকে ঝুঁকতে হবে এবং সেটি করতে গেলে ধনীদের ওপর বেশি কর আরোপ করতে হবে। ধনীদের ওপর কর আরোপ করে সরকার তাদের খেপিয়ে তুলতে চায় না।
ক্রাউন প্রিন্স মোহাম্মাদ বিন সালমান দারিদ্র্য কমাতে রূপরেখা ২০৩০ ঘোষণা করেছেন। সেই মতো কাজও করছেন তিনি। কিন্তু শেষ পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে অবস্থার কোনো পরিবর্তন হচ্ছে না। দরিদ্র আরও দরিদ্র হচ্ছে। মধ্যবিত্তদের ভাগ্য বদল হচ্ছে না। সৌদি আরবে দারিদ্র্য হটানোর মূল উপায় হিসেবে এত দিন নাগরিকদের জাকাতের অর্থকেই ভাবা হতো। সৌদিতে অবস্থাপন্নরা শতকরা আড়াই টাকা জাকাত দিয়ে থাকেন। সেই অর্থ সরকার দরিদ্রদের মধ্যে বিতরণ করে। কিন্তু এই পদ্ধতিতে টেকসইভাবে দারিদ্র্য দূর করা সম্ভব নয়।
২০০৫ সালে তৎকালীন বাদশাহ আবদুল্লাহ দারিদ্র্য দূর করতে একটি প্রকল্প হাতে নিয়েছিলেন। কিন্তু সে প্রকল্প শেষ পর্যন্ত কাজে আসেনি। তবে দেশটিতে ‘দারিদ্র্য’ শব্দটিই উচ্চারণ কার্যত নিষিদ্ধ করে রেখেছে সরকার। সেখানকার দারিদ্র্য নিয়ে তথ্যচিত্র বানানোর জন্য এ পর্যন্ত অন্তত দুজন মানবাধিকারকর্মীকে জেলে ঢোকানো হয়েছে। ২০১৩ সালে আরব বসন্তের মধ্যে সৌদি আরবে মোহাম্মাদ আল হুরাইসি নামের এক তরমুজ বিক্রেতাকে পুলিশ রাস্তায় তরমুজ বিক্রি করতে না দেওয়ায় নিজের গায়ে আগুন ধরিয়ে আত্মাহুতি দেন। ওই ঘটনার পর সৌদির দারিদ্র্যের খবর কিছুটা জনসমক্ষে আসে।
২০১৫ সালে বাদশাহ সালমান ক্ষমতা নেওয়ার পরপরই তেলের দাম এক ধাক্কায় ব্যারেলপ্রতি এক শ ডলার থেকে ৫০ ডলারে নেমে আসে। সৌদির বাজেটের ৮৭ শতাংশই তেলনির্ভর হওয়ায় দেশটি ভয়ানকভাবে ধাক্কা খায়। এরপরই অর্থনীতিতে তেলনির্ভরতা কমাতে সরকার নানা পদক্ষেপ নিয়েছে। রাষ্ট্রীয় তেল কোম্পানি আরামকোর কিছু শেয়ার বেসরকারি খাতে ছাড়া হয়েছে। ক্রাউন প্রিন্স মোহাম্মাদ বিন সালমান এখন সরকারের রাজস্ব বাড়াতে বহু পণ্যে কর আরোপ করেছেন। মূল্য সংযোজন কর আরোপ করেছেন। এতে দরিদ্ররা তো বটেই, মধ্যবিত্তরাও বিপাকে পড়েছে। জিনিসপত্রের দাম বেড়ে গেছে। যাঁদের অবস্থা একটু ভালো, তাঁরা ভবিষ্যতে বিপদে পড়ার ভয়ে স্থাবর–অস্থাবর সম্পত্তি বিক্রি করে বিদেশে চলে যাচ্ছেন।
এ অবস্থায় বৈষম্য কমানোর জন্য সরকারকে সাহসী পথ বেছে নিতেই হবে। ধনিকশ্রেণির ওপর কর বাড়িয়ে গরিব শ্রেণিকে যতটা পারা যায় বাড়তি খরচের হাত থেকে বাঁচাতে হবে।
আল–জাজিরা থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনূদিত
হানা আল খামরি সুইডেনভিত্তিক লেখক ও সাংবাদিক