পঁচাত্তরে পা রাখা বাংলাদেশের এক চিরতরুণ বিশ্বনাগরিক, পৃথিবী থেকে দারিদ্র্য ও বেকারত্ব নিরসনের একজন কারিগর। এটা আমাদের সবার জন্য এক পরম গর্বের বিষয়। বিগত শতাব্দীর শেষার্ধে পুঁজিবাদ তত্ত্বভিত্তিক অর্থনৈতিক উন্নয়নের এক সোনালি সম্ভাবনার সময় পেরিয়েছে। চিকিৎসাবিজ্ঞানের অভাবনীয় বিকাশ, মানুষের গড় আয়ুষ্কাল বৃদ্ধি, শিক্ষার প্রসার, প্রযুক্তিগত চমকপ্রদ উদ্ভাবন, বৈশ্বিক খাদ্য উৎপাদন দ্বিগুণ হওয়া ইত্যাদির সমন্বয়ে মানুষের জীবনে সম্ভাবনার নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হওয়ার কথা থাকলেও জনপদনির্বিশেষে তা ঘটেনি; বরং মানুষে মানুষে নতুন বৈষম্যের সৃষ্টি হয়েছে। কারণ, পুঁজিবাদ তত্ত্বভিত্তিক অর্থনৈতিক উন্নয়ন ধনী দেশগুলোকে আরও ধনসমৃদ্ধ করেছে। আর সমৃদ্ধির নিচের জনগণ দারিদ্র্য উত্তরণের সুযোগগুলোর প্রবেশগম্যতা থেকে বঞ্চিত হয়ে চলেছে। উন্নয়নের চাবিকাঠি কেন্দ্রীভূত হয়েছে ব্যক্তিকেন্দ্রিক পুঁজিবাদীর হাতে। এমনকি ধনী ও দরিদ্র দেশের সরকারও ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোয় দরিদ্র জনগোষ্ঠীর অভিগম্যতা সৃষ্টি করতে ব্যর্থ হয়েছে।
পুঁজি আহরণে ব্যাংকঋণের জামানত দেওয়ার ক্ষমতা না থাকায় দরিদ্র জনগোষ্ঠীর কর্মোদ্যম ব্যবহার করে দারিদ্র্য চক্র থেকে উত্তরণের কোনো সুযোগ আমাদের অর্থনৈতিক কাঠামোর মধ্যে ছিল না। পুঁজিবাদী অর্থনীতির এই সীমাবদ্ধতাকে অতিক্রম করতে মুহাম্মদ ইউনূস ৩৯ বছর আগে জামানতবিহীন ক্ষুদ্রঋণব্যবস্থা প্রচলনের মাধ্যমে বিশ্বব্যাপী দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জন্য সম্ভাবনার নতুন দুয়ার খুলে দেন।
ক্ষুদ্রঋণের মাধ্যমে দারিদ্র্য মোকাবিলার সুযোগ সৃষ্টির জন্য মুহাম্মদ ইউনূস ও তাঁর সৃষ্ট গ্রামীণ ব্যাংক ২০০৬ সালে নোবেল শান্তি পুরস্কার লাভ করে। বর্তমানে এশিয়া, আমেরিকা, ইউরোপ, আফ্রিকাসহ পৃথিবীর প্রায় সব দেশেই গ্রামীণ ব্যাংকের মডেলে ক্ষুদ্রঋণব্যবস্থা প্রচলিত আছে। গ্রামীণ ব্যাংকের ক্ষুদ্রঋণ দারিদ্র্যের প্রথম ধাপ উত্তরণের একটি জুতসই হাতিয়ার হলেও ইউনূস তাঁর দীর্ঘ কর্ম-অভিজ্ঞতা থেকে বুঝতে পেরেছিলেন, বৃহত্তর পরিসরে বিভিন্ন সামাজিক সমস্যা সমাধানের জন্য ব্যক্তিগত লাভের আশা ছাড়াই উদ্যোক্তাকে বিনিয়োগে আগ্রহী করতে হবে, যা পুঁজিবাদী তত্ত্বের সর্বোচ্চ মুনাফা প্রণোদনাভিত্তিক উৎপাদনব্যবস্থার মাধ্যমে সম্ভব নয়। ইউনূসের সামাজিক ব্যবসার ধারণা এই চিন্তারই ফসল।
মুহাম্মদ ইউনূসের মতে, পুঁজিবাদী কাঠামোকে সম্পূর্ণতা দিতে হলে ব্যবসার মাধ্যমে এমন সুযোগ সৃষ্টি করতে হবে, যাতে করে একজন উদ্যোক্তা শুধু ব্যক্তিগত মুনাফা অর্জনের তাগিদে সীমাবদ্ধ না থেকে মানুষ হিসেবে তাঁর সহজাত সমাজকল্যাণ-স্পৃহার বশবর্তী হয়ে সামাজিক ব্যবসায় বিনিয়োগ করতে পারেন এবং ব্যবসালব্ধ মুনাফা একই উদ্দেশ্যে পুনর্বিনিয়োগ করতে পারেন। সামাজিক ব্যবসা হবে, যেখানে উদ্যোক্তা মূলত একটি সামাজিক সমস্যা সমাধানের উদ্দেশ্যে বিনিয়োগ করবেন। ইউনূস উদ্ভাবিত সামাজিক ব্যবসার মূল চালিকা শক্তি হলো বহুমাত্রিক মানুষের মধ্যে অন্তর্নিহিত পরোপকারের স্পৃহা ও সামাজিক কল্যাণ সাধনে আত্মতৃপ্তি লাভের বাসনা এবং সেই কাজে উদ্যোক্তা হিসেবে জীবিকা নির্বাহ। একই ব্যক্তি একসঙ্গে সনাতন পুঁজিবাদী ব্যক্তি মুনাফাভিত্তিক ব্যবসা ও পৃথক সামাজিক ব্যবসা করতে পারেন। পার্থক্য এই যে সামাজিক ব্যবসায়ে বিনিয়োগকারী শুধু তাঁর বিনিয়োগকৃত অর্থই ফেরত পাবেন, অর্জিত মুনাফা কোম্পানির (সামাজিক ব্যবসা) সম্প্রসারণ, শ্রমিককল্যাণ, পরিবেশবান্ধব পরিস্থিতি ইত্যাদির উন্নয়নে ব্যয় হবে। যাঁরা সামাজিক ব্যবসার উদ্যোক্তা হবেন, তাঁদের জন্য সামাজিক ব্যবসার উদ্দেশ্যে সৃষ্ট ফান্ড থেকে ঋণের ব্যবস্থা থাকবে। বর্তমানে দেশে চারটি এবং আন্তর্জাতিক পর্যায়ে নয়টি প্রতিষ্ঠান থেকে সামাজিক ব্যবসায় উদ্যোক্তারা ফান্ড পেতে পারেন।
গ্রামীণ ব্যাংক ক্ষুদ্রঋণের মতো ইউনূস উদ্ভাবিত সামাজিক ব্যবসা তত্ত্ব বিশ্বজুড়ে আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। পুঁজিবাদ ব্যবসার বিশ্বনেতারা তাঁদের চলতি ব্যবসার পাশাপাশি করপোরেট সোশ্যাল রেসপনসিবিলিটি হিসেবে সামাজিক ব্যবসার উদ্যোগ গ্রহণ করেছেন। বর্তমান বিশ্বে ক্রমবর্ধমান বৈষম্য হ্রাস করতে অনেকেই একমাত্র সামাজিক ব্যবসাকে টেকসই হাতিয়ার মনে করছেন। অক্সফামের প্রতিবেদন অনুযায়ী, আগামী বছর নাগাদ বিশ্বের অর্ধেক সম্পদ চলে যাবে মাত্র ১ শতাংশ মানুষের হাতে। পাঁচ বছরে দ্বিগুণ হয়েছে শীর্ষ ৮৫ ধনীর সম্পদ। ৮০ শতাংশ মানুষের কাছে মাত্র ৫ দশমিক ৫ শতাংশ সম্পদ। বিশ্ব অর্থনীতিকে ন্যায় ও সমতাভিত্তিক এবং টেকসই করতে হলে তাই সামাজিক ব্যবসা প্রসারের বিকল্প নেই। বেকারত্ব, দারিদ্র্য ও স্থানীয় বিশেষ সমস্যা সমাধানের লক্ষ্যে কম্বোডিয়া, ফিলিপাইন, নেপাল, ভারত, হাইতি, কলাম্বিয়া, উগান্ডা, ব্রাজিল, আলবেনিয়া প্রভৃতি দেশে সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে সামাজিক ব্যবসার প্রসার ঘটেছে এবং ইতিমধ্যেই ইতিবাচক ফল পাওয়া গেছে।
বাংলাদেশে তরুণ উদ্যোক্তাদের উদ্দেশ্যে সামাজিক ব্যবসার স্লোগান হলো ‘আমরা চাকরিপ্রার্থী নই, আমরা চাকরিদাতা’। কারণ, সামাজিক ব্যবসার মাধ্যমে প্রতীকী উদ্যোক্তা কর্মসংস্থান সৃষ্টি করেন। গ্রামীণ ব্যাংকের অনেক ঋণগ্রহীতার সন্তানেরা চাকরির জন্য দুয়ারে দুয়ারে না ঘুরে নবীন উদ্যোক্তা হিসেবে নিজের জীবিকা ও অন্যের জন্য কর্মসংস্থান সৃষ্টি করছেন। এ বছরের ইকোনমিক ইন্টেলিজেন্সের প্রতিবেদন অনুযায়ী, দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশে স্নাতক ডিগ্রিধারী বেকারের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। বছরে বাংলাদেশে প্রায় ২২ লাখ তরুণ চাকরির খোঁজে শ্রমবাজারে প্রবেশ করেন, সামাজিক ব্যবসার মাধ্যমে তাঁদের উদ্যোক্তা সৃষ্টি করতে পারলেই কেবল এই বেকারত্ব মোচন সম্ভব। বৈশ্বিক টেকসই উন্নয়ন প্রসঙ্গে ইউনূসের তিন শূন্য ও চার করণীয় থিওরি ইতিমধ্যে সুধী সমাজের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে: ১. শূন্য দারিদ্র্য ২. শূন্য বেকারত্ব এবং ৩. শূন্য কার্বন নিঃসরণ এবং এই তিন শূন্য অর্জন করতে চার করণীয় ১. তরুণ উদ্যম, শক্তি ও সৃজনশীলতাকে সঞ্চিত করা ২. প্রযুক্তির সর্বোচ্চ ব্যবহার করা ৩. ব্যবসাকে সামাজিক ব্যবসায় পরিণত করা এবং ৪. সুশাসন নিশ্চিত করা।
দারিদ্র্য দূরীকরণে গ্রামীণ ব্যাংকের ক্ষুদ্রঋণের সাফল্য এবং সামাজিক ব্যবসার মানবিক অর্থনৈতিক তত্ত্ব ইউনূসকে ভূষিত করেছে ১১২টি আন্তর্জাতিক পুরস্কারে। যার মধ্যে রয়েছে আমেরিকার প্রেসিডেন্সিয়াল মেডেল অব ফ্রিডম, আমেরিকার কংগ্রেসনাল গোল্ড মেডেল, র্যামন ম্যাগসাইসাই অ্যাওয়ার্ড, ওয়ার্ল্ড ফুড প্রাইজ, আগা খান অ্যাওয়ার্ড, সিডনি পিস প্রাইজ, সিউল পিস প্রাইজ প্রভৃতি। বাংলাদেশও তাঁকে ভূষিত করেছে প্রেসিডেন্ট পুরস্কার, কেন্দ্রীয় ব্যাংক পুরস্কার ও স্বাধীনতা পুরস্কারে। পৃথিবীর ২০টি দেশের নামকরা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনি লাভ করেছেন ৫৫টি সম্মানসূচক ডক্টরেট ডিগ্রি। বিখ্যাত টাইমম্যাগাজিনইউনূসকে একজন এশিয়ান হিরো এবং ২০০৮ সালে বিশ্বের ১০০ জন পাবলিক ইন্টেলেকচুয়ালের মধ্যে অন্যতম হিসেবে আখ্যায়িত করেছে।
ইউনূস রচিত বইগুলোর মধ্যে তাঁর আত্মজীবনী ব্যাংকার টু দ্য পুওর, ক্রিয়েটিং আ ওয়ার্ল্ড উইদাউট পোভার্টি ও বিল্ডিং সোশ্যাল বিজনেস আন্তর্জাতিকভাবে ব্যাপক স্বীকৃতি লাভ করেছে এবং ১৫ থেকে ২০টি ভাষায় অনূদিত হয়েছে। ২০১২ সালে গ্লাসগোর ক্যালিডোনিয়ান ইউনিভার্সিটি তাঁকে বিশ্ববিদ্যালয়ের চ্যান্সেলর নিযুক্ত করেছে।
ইউনূসের কর্মের ব্যাপ্তি আজ সারা বিশ্ব হলেও বাংলাদেশ নিয়েই তাঁর সমগ্র জীবন ও স্বপ্ন। বিগত চার দশকে বাংলাদেশে মানব উন্নয়ন সূচকে যে অভাবনীয় ইতিবাচক পরিবর্তন হয়েছে, তার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ অর্থনৈতিক কাঠামোগত পরিবর্তন হয়নি। ইউনূসের সামাজিক ব্যবসা প্রসারের মাধ্যমে দেশের লাখ লাখ তরুণ চাকরি খোঁজার পরিবর্তে উদ্যোক্তা হয়ে দারিদ্র্য ও বেকারত্ব দূর করতে অনুপ্রাণিত হবেন—এ আশায় ইউনূসের সুস্থ ও কর্মময় জীবন কামনা করছি। বাংলাদেশের স্বপ্নপূরণে ইউনূস দীর্ঘজীবী হোক। শুভ জন্মদিন।
তথ্যসূত্র: সামাজিক ব্যবসা, মুহাম্মদ ইউনূস ও ইউনূস সেন্টার।
সালমা খান: অর্থনীতিবিদ ও নারীনেত্রী।