২০০৮ সালের ১২ অক্টোবর, সেদিন রংপুরবাসী ভীষণ উল্লসিত হয়েছিলেন। দীর্ঘদিনের আন্দোলন শেষে তাঁরা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কাছ থেকে পেয়েছিলেন রংপুর বিশ্ববিদ্যালয়। মিছিল-মিটিং-সভা এমনকি নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে লেগে থাকার ফল ছিল এই অর্জন। সে কারণে বিশ্ববিদ্যালয়টি রংপুরবাসীর কাছে আবেগের-ভালোবাসার। এ বিশ্ববিদ্যালয়ে ভালো কিছু হলে রংপুরবাসীর কাছে তা গভীর আনন্দ বয়ে আনে। খারাপ কিছুর খবর তাঁদের আহত করে।
প্রতিষ্ঠার কয়েক মাস পরই ৮ এপ্রিল ২০০৯ গেজেট প্রকাশের মাধ্যমে মহাজোট সরকার রংপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম পরিবর্তন করে। তার নতুন নাম হয় বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়। বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগের বিজ্ঞপ্তি দেখে প্রতিষ্ঠার বছরে আবেদন ফরম নেওয়ার জন্য কুড়িগ্রাম থেকে রংপুরে আসি। বাসস্ট্যান্ডে নেমে রিকশার জন্য অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে ছিলাম। পাশেই অনেকের মতো একজন ছাত্রও দাঁড়িয়ে ছিল। যখন রিকশা পেলাম, অপেক্ষমাণ ছাত্রটিকেও রিকশায় তুলে নিই। পরিচয় হলো, তার নাম বনফুল রায়। জানলাম, সে রংপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছে। কিন্তু পড়বে কি না ঠিক করতে পারছে না। কেন পড়তে চায় না, জিজ্ঞাসা করতেই সে জানাল, এ বিশ্ববিদ্যালয়ে ৩০০ জন শিক্ষার্থী ভর্তি হয়েছে, কিন্তু কোনো শিক্ষক এখনো নিয়োগ হয়নি। বিশ্ববিদ্যালয়টি বন্ধ হয়ে যাবে কি না, এই আশঙ্কাও তার মধ্যে ছিল। শেষ পর্যন্ত অবশ্য সে এ বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়ে যায়নি। মার্কেটিং বিভাগ থেকে সে এমবিএ পাস করেছে।
শুধু যে বনফুলের মনে বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ হওয়ার আশঙ্কা ছিল তা নয়, যাঁরা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার জন্য আন্দোলন করেছেন, তাঁদের মনেও সে আশঙ্কা ছিল। ২০০১ সালে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা রংপুরে একটি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিত্তি স্থাপন করেছিলেন। বিএনপিসহ চারদলীয় জোট সরকার তা বন্ধ করে দিয়েছিল। সেই অনিশ্চয়তা তাঁদের মধ্যে ছিল।
২০০৮ সালের অক্টোবর মাস। আর মাত্র দুই মাস পর তত্ত্বাবধায়ক সরকার নির্বাচিত সরকারের কাছে দায়িত্ব হস্তান্তর করবে। কোন দল সরকার গঠন করবে, তা–ও জানার উপায় নেই। সে কারণে বিশ্ববিদ্যালয় বাস্তবায়ন পরিষদ, রংপুরবাসী, এমনকি তৎকালীন উপাচার্য এম লুৎফর রহমানও চেয়েছিলেন যত দ্রুত সম্ভব শিক্ষার্থী ভর্তি করানো হোক। সবার বিশ্বাস, শিক্ষার্থী ভর্তি হলে আর বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ হবে না। তখনো কোনো শিক্ষক নিয়োগ করা হয়নি। শেষাবধি কারমাইকেল কলেজকে দায়িত্ব দেওয়া হয় এ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম ব্যাচের শিক্ষার্থী ভর্তি করানোর। অত্যন্ত দায়িত্বশীলতার সঙ্গে কারমাইকেল কলেজের শিক্ষকেরা বিনা পারিশ্রমিকে এই বড় কাজ করে দেন। শিক্ষার্থী ভর্তি হওয়ার প্রায় তিন মাস পর শিক্ষক নিয়োগ হয়। শিক্ষার্থীদের অভিভাবকেরাও তখন কিছুটা ভরসা পান। সব অনিশ্চয়তা কাটিয়ে ২০০৯ সালের ৪ এপ্রিল বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক কার্যক্রমের উদ্বোধন হয়।
শিক্ষক প্রশিক্ষণ মহাবিদ্যালয়ের পরিত্যক্ত ভবন পরিষ্কার করে সেখানে শিক্ষা কার্যক্রম শুরু হয়। ওই কলেজের অনেক শিক্ষক নিজ হাতে পরিত্যক্ত ভবন পরিষ্কার করেছেন। এ বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম দিন যোগদান করা দুজন শিক্ষকের একজন আমি। অন্যজন অধ্যাপক তাজুল ইসলাম। প্রথম দিন শিক্ষকদের বসার কক্ষে গিয়ে দেখি, দেয়ালের দিকে মুখ করে চেয়ার-টেবিল দেওয়া। উল্টো দিকে দেওয়ার ব্যাখ্যা উপাচার্য এম লুৎফর রহমান নিজেই দিলেন, ‘আলাদা আলাদা কক্ষ যেহেতু নেই, তাই এ রকম ব্যবস্থা। শিক্ষকগণ মুখোমুখি বসলে গল্প হবে, শিক্ষকদের পড়াশোনা হবে না। সে জন্য উল্টো দিকে চেয়ার-টেবিল। কেউ কারও মুখ দেখতে পারবেন না।’
প্রথম উপাচার্য অফিস শুরু করেন দুই ফুট বাই দুই ফুট করে দুটি টেবিল জোড়া দিয়ে। জনতা ব্যাংক লালবাগ শাখার ম্যানেজার এ অবস্থা দেখে ব্যাংকের পক্ষ থেকে ভালো মানের টেবিল-চেয়ারের ব্যবস্থা করেন। প্রথম উপাচার্য শুরুতে রিকশায় এসে অফিস করতেন। এ খবর শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে পৌঁছালে তাঁকে একটি গাড়ি ভাড়া করে নেওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়। ২০০৮ থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত শিক্ষক প্রশিক্ষণ মহাবিদ্যালয়ে চলে কার্যক্রম।
শিক্ষক প্রশিক্ষণ মহাবিদ্যালয়ের সেই পরিত্যক্ত ভবন এখন শুধুই স্মৃতি। এখন স্থায়ী ক্যাম্পাসে চারটি একাডেমিক ভবন, প্রশাসনিক ভবন, তিনটি হল, লাইব্রেরি, ক্যাফেটেরিয়া হয়েছে। দশতলা একটি ছাত্রী হল এবং দশতলা ড. ওয়াজেদ ইন্টারন্যাশনাল রিসার্চ অ্যান্ড ট্রেনিং ইনস্টিটিউটের নির্মাণকাজ চলছে। এখন আর উপাচার্যের ভাড়া করা গাড়ির প্রয়োজন হয় না। উপাচার্য নিজেই কয়েকটি গাড়ি ব্যবহার করেন। দশম ব্যাচে শিক্ষার্থী ভর্তির বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হয়েছে। ছয়টি অনুষদে ২১টি বিভাগে চলছে পাঠদান। ৩০০ শিক্ষার্থী নিয়ে যাত্রা শুরু করলেও এখন শিক্ষার্থীর সংখ্যা প্রায় আট হাজার। প্রথম তিন-চারটি ব্যাচের অনেক বিভাগের শিক্ষার্থীরা পাস করে গেছে। অনেকে বিদেশে গেছে উচ্চতর শিক্ষা গ্রহণ করতে। অনেকেই চাকরির পরীক্ষায় যোগ্যতার পরিচয় দিচ্ছে।
২০১৩ সাল পর্যন্ত ক্যাম্পাসে কয়েকটি দেবদারু, কৃষ্ণচূড়া, বকুলগাছ ছাড়া আর কোনো গাছই ছিল না। বিভিন্ন ব্যক্তি-প্রতিষ্ঠান-সংস্থার কাছ থেকে প্রায় ৩৩ হাজার গাছের চারা নিয়ে কয়েকজন বৃক্ষপ্রেমী শিক্ষার্থী ও কর্মচারীর সহায়তায় আমরা সেগুলো রোপণ করি। এখন কিশোর বৃক্ষে শোভিত ক্যাম্পাস।
এ পর্যন্ত এই বিশ্ববিদ্যালয়ে চারজন উপাচার্য এসেছেন। প্রথম উপাচার্য এক বছরও পূর্ণ করতে পারেননি। তিনি বলতেন, ‘কোনো এমপি-মন্ত্রীর সুপারিশে একজনেরও চাকরি আমার হাতে হবে না। যোগ্যতার ভিত্তিতে হবে।’ দ্বিতীয় উপাচার্য হিসেবে যিনি এসেছিলেন, সীমাহীন দুর্নীতির দায়ে মেয়াদ পূর্তির আগে সরকার তাঁকে অব্যাহতি দিয়েছিল। তাঁর চলে যাওয়ার সময় ব্যাংক অ্যাকাউন্টে ছিল মাত্র ১৩০ টাকা। তৃতীয় উপাচার্য মেয়াদ পূর্ণ করলেও তাঁর চলে যাওয়াটা ততটা সম্মানের ছিল না। চতুর্থ উপাচার্য হিসেবে এসেছেন নাজমুল আহসান কলিমউল্লাহ। তিনি কোনো রকম বিতর্কে না জড়িয়ে বিশ্ববিদ্যালয়কে এগিয়ে নেবেন, এটাই সবার প্রত্যাশা।
দশম বছরে পড়ল বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়। এখন যাঁরা নতুন ভর্তি হচ্ছেন কিংবা চাকরি করতে আসছেন, তাঁরা কি জানেন এ বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস? তাঁদের কাছে আহ্বান, তাঁরা যেন এ বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার এবং ক্রমবিকাশের ইতিহাসটুকু নিজ আগ্রহে জানার চেষ্টা করেন। এ বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় এবং উন্নয়নে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে যাঁরা সামান্য ভূমিকাও রেখেছেন, এ দিনে তাঁদের প্রতি গভীর ভালোবাসা।
তুহিন ওয়াদুদ: শিক্ষক, বাংলা বিভাগ, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়, রংপুর।