কয়েক সপ্তাহ আগে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ঢাকা সফরে এসেছিলেন। তাঁর দলের মুখপাত্র হিসেবে প্রখ্যাত সাংবাদিক এম জে আকবরও প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে এসেছিলেন এবং যেখানে কথা বলা প্রয়োজন, সেখানে কথা বলেছেন। এই প্রসঙ্গে আমরা একটি প্রশ্ন তুলতে চাই। বাংলাদেশ সরকারের মুখপাত্র কে? আমরা যতটুকু জানি, বাংলাদেশ সরকারের কোনো আনুষ্ঠানিক মুখপাত্র নেই। কেন নেই? আমাদের ধারণা, সরকার কোনো মুখপাত্র রাখার প্রয়োজন মনে করেনি।
প্রথমে বলতে চাই, সরকারের একজন মুখপাত্রের প্রয়োজন কেন। এখন পর্যন্ত দেশের প্রধানমন্ত্রীই সরকারের মুখপাত্রের ভূমিকা পালন করেন। এর পেছনে প্রধান কারণ হলো: আমাদের রুগ্ণ রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে সরকারে প্রধানমন্ত্রীই সর্বেসর্বা, তিনিই আসলে ‘সরকার’। ক্ষমতাসীন বা প্রধান বিরোধী দলেও চেয়ারপারসনই একক কণ্ঠ। তাঁর সিদ্ধান্তই দলের সিদ্ধান্ত।
কিন্তু প্রধানমন্ত্রীকে তাঁর সরকারের বা দলের সব কথা একা বলতে হবে কেন? এতে তাঁর বক্তব্যের সমালোচনা করার সুযোগ বেড়ে যায়। তাঁর ওজন অনেক বেশি। যদি সরকারের একজন মুখপাত্র থাকতেন তাহলে সরকারের অনেক বক্তব্য, বিভিন্ন ইস্যুতে সরকারের অবস্থান, বিভিন্ন সমালোচনার জবাব এই মুখপাত্র দিতে পারতেন। দেশে হঠাৎ বড় কোনো ঘটনা বা দুর্ঘটনা ঘটে গেলে তার ব্যাখ্যা, সরকারের ত্বরিত সিদ্ধান্ত ঘটনার কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই মিডিয়ার মাধ্যমে জনগণকে জানানো সম্ভব। এমনকি সরকার দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে না পারলেও সরকারের মুখপাত্র মিডিয়ার সামনে বলতে পারেন, ‘সরকার বিষয়টা পর্যালোচনা করছে। আজ রাত ১০টায় আমরা সরকারের অবস্থান জনগণকে জানাব।’
এসব নানা কারণে সরকারের একজন মুখপাত্রের খুব প্রয়োজন। প্রধানমন্ত্রী বিভিন্ন বিষয়ে তাঁর বক্তব্য, সমালোচনার উত্তর, ভবিষ্যৎ দিকনির্দেশনা সংসদ অধিবেশনে বললেই ভালো হয়। প্রধানমন্ত্রী সেতু উদ্বোধন বা বৃক্ষরোপণ সপ্তাহ উদ্বোধন করতে গিয়ে বিরোধী দলের সমালোচনার জবাব দেওয়াটা শোভন নয়। এ ধরনের অনুষ্ঠানে তিনি দেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে বক্তব্য দিতে যান। ক্ষমতাসীন দলের সভাপতি হিসেবে বক্তব্য দিতে যান না। এই পার্থক্যটা সবাইকে বুঝতে হবে।
সরকারের কথা বলার জন্য যেমন সরকারের মুখপাত্র প্রয়োজন, তেমনি ক্ষমতাসীন দলের বক্তব্য, বিরোধী দলের সমালোচনার জবাব দেওয়ার জন্য দলেরও একজন মুখপাত্রের প্রয়োজন। আমাদের বড় রাজনৈতিক দলে দলের মুখপাত্রও নেই। অনেকে বলতে পারেন, দলের সাধারণ সম্পাদকই দলের মুখপাত্র। আপাতদৃষ্টিতে সেটাই আমাদের মেনে নেওয়া উচিত। কিন্তু দলের প্রধান সবকিছু এককভাবে নিয়ন্ত্রণ করলে দলের সাধারণ সম্পাদক ঠিকমতো কাজ করতে পারেন না। অনেক সময় সাধারণ সম্পাদকের ওপর দলের প্রধানের এক শ ভাগ আস্থাও থাকে না। আওয়ামী লীগ ও বিএনপির সাধারণ সম্পাদকদ্বয়ের গত কয়েক বছরের ভূমিকা পর্যালোচনা করলে আমাদের উপরিউক্ত ধারণার সত্যতা পাওয়া যাবে। তবে একটি প্রকৃত গণতান্ত্রিক দলে সাধারণ সম্পাদকই দলের মুখপাত্র হিসেবে ভূমিকা পালন করেন। সেটাই প্রত্যাশিত। অথচ আজকাল আমরা মিডিয়ায় দেখছি, দলের যে কারও বক্তব্য মিডিয়া ফলাও করে প্রচার করে। বাস্তবে সেটা ওই নেতার ব্যক্তিগত মত; দলের মত নয়। এখন মিডিয়াকে ঠিক করতে হবে, তারা দলের বক্তব্য প্রচার করবে না কোনো নেতার ব্যক্তিগত বক্তব্য প্রচার করবে।
আমাদের ধারণা, তথ্যমন্ত্রীই হতে পারেন সরকারের মুখপাত্র। প্রতিটি সরকারপ্রধানের উচিত দলের একজন রাজনীতিমনস্ক ঝানু নেতাকে তথ্যমন্ত্রীর পদ দেওয়া, যিনি তথ্য মন্ত্রণালয় সামলাবেন এবং বিভিন্ন ইস্যুতে সরকারের অবস্থান বা বক্তব্য তুলে ধরবেন। প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে তাঁর থাকবে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ এবং তিনি হবেন প্রধানমন্ত্রীর খুবই আস্থাভাজন। বাংলাদেশে মিডিয়ার শতকরা আশি ভাগই হলো বেসরকারি। নীতি প্রণয়ন ও মনিটরিংই তথ্য মন্ত্রণালয়ের প্রধান কাজ। কাজেই তথ্যমন্ত্রী অনায়াসে সরকারের মুখপাত্রের দায়িত্ব পালন করতে পারেন।
প্রতিটি মন্ত্রণালয়েও একজন মুখপাত্র থাকা উচিত, যিনি মন্ত্রী ও সচিবের তথা মন্ত্রণালয়ের পক্ষে কোনো ইস্যুতে সরকারের বক্তব্য মিডিয়ার সামনে তুলে ধরবেন। মন্ত্রণালয়ের কোনো কাজের সমালোচনা হলে তার জবাব দেবেন যুক্তি, তথ্য, পরিসংখ্যান ও নীতি দিয়ে। রাজনৈতিক বক্তব্য বলা তাঁর কাজ নয়।
আমাদের সরকারের (সব আমলের) প্রবণতা হলো: মিডিয়া এড়িয়ে যাওয়া। সমালোচনার মুখোমুখি না হওয়া বা সমালোচনার জবাব না দেওয়া। এটা দুর্বলতার লক্ষণ। আত্মবিশ্বাসের অভাব ঘটলে এ রকম হয়। তা ছাড়া, বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, মন্ত্রী, সচিব অনেকেই চান সমালোচনার দায়টা প্রধানমন্ত্রী নিজে নিক। জবাব তিনিই দেবেন। এতে মন্ত্রী বা সচিবেরা নিরাপদ দূরত্বে থাকতে পারেন। অবশ্য সবাই এমন নন। প্রধানমন্ত্রীও এটা উপভোগ করেন বলেই মনে হয়। কারণ, তিনি এমন একটা ধারণা প্রতিষ্ঠা করতে চান, সব কাজই তাঁর নির্দেশে হচ্ছে। সবই তাঁর চিন্তাপ্রসূত। কাজেই সমালোচনার জবাব তিনি দিতে পারলে এই ধারণটা আরও ভালোভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়। রামপাল বিদ্যুৎ প্রকল্প থেকে পদ্মা সেতু—সবই প্রধানমন্ত্রীর ‘স্বপ্ন’। মন্ত্রণালয়, মন্ত্রী, সচিব এঁরা নিমিত্ত মাত্র। এটাও রুগ্ণ রাজনীতির প্রতিফলন। আমরা সবাই প্রায় ভুলতে বসেছি, সংসদীয় গণতন্ত্রে মন্ত্রীই তাঁর দপ্তর ও কাজের প্রধান নায়ক।
বাংলাদেশ সরকারের একজন প্রধান তথ্য অফিসার (পিআইও) রয়েছেন। তাঁর ভূমিকা খুব দৃষ্টিগোচর হয় না। ক্ষেত্রবিশেষে তিনিও সরকারের মুখপাত্র হতে পারতেন। কিন্তু সরকারি আমলার পক্ষে এই দায়িত্ব পালন করা সম্ভব হবে না। মুখপাত্রের পদটা রাজনৈতিক। কিন্তু প্রধান তথ্য অফিসারকে আরও কার্যকর ভূমিকা দেওয়া উচিত। তথ্য মন্ত্রণালয় এ ব্যাপারে চিন্তা করতে পারে।
বাংলাদেশে কোনো সরকারি দপ্তরেও মুখপাত্র পদটি নেই বললে চলে। প্রতিষ্ঠানের প্রধান বা সচিব এ ক্ষেত্রে মুখপাত্রের দায়িত্ব পালন করতে পারেন। কারণ, তাঁর কাজের এলাকা সীমিত। কাজেই তাঁর প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে তাঁর চেয়ে ভালো কে বলতে পারেন? কিন্তু সমস্যা হলো: প্রতিষ্ঠানপ্রধানেরা (সবাই নন) মিডিয়ার সামনে সচরাচর আসতে চান না। কিন্তু আসতে না চাইলে তাঁর প্রতিষ্ঠানের ব্যর্থতা বা অভিযোগের জবাব কে দেবেন? এ ব্যাপারে কোনো সরকারি নির্দেশনাও নেই। তবে সরকারের নির্দেশনা থাকা প্রয়োজন। এটা গণতান্ত্রিক সরকার। প্রত্যেক নির্বাচিত প্রতিনিধি ও সরকারি প্রতিষ্ঠানের প্রধানকে জনগণের কাছে জবাবদিহি করতে হবে। এর কোনো ব্যত্যয় হওয়ার সুযোগ নেই। সব জবাবদিহি প্রধানমন্ত্রী বা মন্ত্রীকে কেন দিতে হবে? প্রতিষ্ঠানপ্রধানেরা আছেন কেন? কোনো প্রতিষ্ঠানের প্রধান যদি মিডিয়া-ভীতিতে আক্রান্ত হন, তিনি তাঁর প্রতিষ্ঠানের একজন দক্ষ ও চৌকস ব্যক্তিকে প্রতিষ্ঠানের মুখপাত্র বলে ঘোষণা দিতে পারেন।
কয়েকটি টিভি চ্যানেলের বার্তাপ্রধানেরা আমাদের বলেছেন, কোনো সরকারি কাজের ব্যর্থতা বা সাফল্য নিয়ে আলোচনার জন্য (টক শো) সরকারি প্রতিষ্ঠানের প্রধান বা কোনো মনোনীত ব্যক্তি আসতে চান না। এর ফলে আলোচনা অসম্পূর্ণ থেকে যায়। আলোচ্য বিষয়ে প্রতিষ্ঠানের বক্তব্য বা সমালোচনার জবাব দর্শক-শ্রোতারা জানতে পারেন না। টিভি তো মন্ত্রী, সচিব বা প্রতিষ্ঠানপ্রধানের ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে আলোচনা করছে না। অনুষ্ঠানের মডারেটর শুধু জানতে চাইবেন, যে ঘটনাটি ঘটেছে সে ব্যাপারে মন্ত্রণালয় বা প্রতিষ্ঠানের বক্তব্য কী। নিজেদের অবস্থান বা বক্তব্য বলতে এত ভয় কেন? আত্মবিশ্বাসের অভাব?
আমরা যদি গণতন্ত্র, জবাবদিহি ও স্বচ্ছতার কথা বলি তাহলে সরকার, মন্ত্রণালয়, সরকারি প্রতিষ্ঠান সবারই একজন করে মুখপাত্র থাকতে হবে। মুখপাত্রের ভূমিকাকে ইতিবাচকভাবে দেখতে হবে। একজন চৌকস ও সক্রিয় মুখপাত্র থাকলে অনেক ভুল–বোঝাবুঝি এড়ানো সম্ভব হয়।
মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর: মিডিয়া ও উন্নয়নকর্মী।