শেষ পর্যন্ত ক্ষমতা ধরে রাখতে না-পারলেও নয় বছরের শাসনামলে একটি কাজ কিন্তু খুব সাফল্যের সঙ্গে করেছেন এরশাদ, আর তা হলো, একচ্ছত্র বিপুল ক্ষমতা দিয়ে বিনা ভোটের সংসদে ইসলামি, শাহজালাল ও খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের অগণতান্ত্রিক আইন পাস করানো, ভিসিদের দিয়েই যেন বিশ্ববিদ্যালয়গুলো নিয়ন্ত্রণ করা যায়।
১৯৯০-পরবর্তী সব সরকারই এরশাদের ধারাবাহিকতা বজায় রেখে বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা ৫০-এর বেশি বাড়িয়েছে। একাডেমিক যোগ্যতার চেয়ে দলীয় আনুগত্যকে প্রাধান্য দিয়ে কম শিক্ষিত, দলকানাদের উপাচার্য নিয়োগের এরশাদের ধারাকে তারা আরও বেগবান করেছে।
এই উপাচার্যরা নিজেদের বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজা-মহারাজা ভেবে একনায়কতান্ত্রিক কর্মকাণ্ড নির্বিঘ্ন করতে কম যোগ্য ব্যক্তিদের নিয়ে রাজসভা বানান। রাজসভার এই সভ্যরা শিক্ষকতার কথা ভুলে গিয়ে ‘রাজা মশায় ঠিক, রাজা মশায় ঠিক/মহারাজার জয়, মহারাজার জয়’ বলাকেই প্রধান কাজ মনে করেন। বিনিময়ে উপাচার্য তাঁদের বিভিন্ন পদে (সিন্ডিকেট সদস্য, ডিন, বিভাগীয় প্রধান, ছাত্র কল্যাণ দপ্তর, প্রভোস্ট ইত্যাদি) মাসিক ৫-৬ হাজার টাকা ভাতায় নিয়োগ দেন।
প্রতিদিনের ২০০ টাকার মজুরিতে এই শিক্ষকেরা দিনের পর দিন বিশ্ববিদ্যালয়ের পবিত্র অঙ্গনকে কলুষিত করেন, ভিসিদের সব অনৈতিক কর্মকাণ্ড বাস্তবায়নে সহায়তা করেন, কখনো কখনো চরের লাঠিয়ালদের মতো ভিসিদের বডিগার্ডের কাজ করেন। কাজের পুরস্কার হিসেবে পান অযোগ্য পরিবার-পরিজনদের জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের চাকরি আর নিজে পান একাধিক পদ।
অবশ্যই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের ভেতর থেকেই দিতে হবে সেই বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি-সহ-উপাচার্য নিয়োগ, এতে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতি তাদের দরদ কিছুটা হলেও বেশি থাকবে, দলাদলিও কমে আসবে।
বিশ্ববিদ্যালয় জমিদারিতে একচ্ছত্র ক্ষমতার অধিকারী এসব উপাচার্য এবং তাঁদের বাহিনীর মন-মর্জি এবং দয়ার ওপর নির্ভর করে সাধারণ শিক্ষকদের প্রমোশন, শিক্ষাছুটি ও সব ন্যায্য পাওনা। ফলে মুক্তচিন্তা ও মুক্তবুদ্ধি চর্চার কেন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসেই শিক্ষকেরা থাকেন সদা তটস্থ। উপাচার্য এবং তার বাহিনীর অবৈধ নিয়োগ-বাণিজ্য, ঠিকাদারিসহ নানা অনৈতিক কাজের কোনো রকম সমালোচনা করলে বা রোষানলে পড়লে ভোগ করতে হয় চরম শাস্তি, যার জ্বলন্ত প্রমাণ খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের তিন শিক্ষকের চাকরিচ্যুতি।
খুলনা শহর ও আশপাশের প্রায় অর্ধশতাধিক মিষ্টির দোকানের নাম ‘সাতক্ষীরা ঘোষ ডেইরি’। কোনটি যে আসল ঘোষ ডেইরি, বোঝা মুশকিল। প্রত্যেকটার নামের আগে লেখা আছে আসল, আদি, অরিজিনাল, নিউ বা মূল। ঠিক তেমনিভাবে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের সরকারি ও সরকারবিরোধী শিক্ষক-সমর্থকদের রয়েছে একই বা কাছাকাছি নামের একাধিক দল-উপদল। এগুলো যতটা না আদর্শিক তার চেয়ে বেশি আর্থিক সুবিধা, পদ-পদবি ভাগ-বাঁটোয়ারা, ব্যক্তিগত প্রতিহিংসা চরিতার্থ করার কারখানা। ভিসিরা হলেন এসব শিক্ষক দল-উপদলের প্রধান মদদদাতা। শিক্ষকদের মধ্যে অনৈক্য থাকলে ভিসিদের দুষ্কর্ম করা সহজ হয়; তাই যত বেশি দল-উপদল, তত বেশি লাভ।
আবার বেশির ভাগ বিশ্ববিদ্যালয়েই উপাচার্য হচ্ছেন অন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, নিজের মসনদ টিকিয়ে রাখতে সব সময়ই যাঁরা কম যোগ্য, উচ্ছিষ্টভোগী ও অশিক্ষক মনোভাবের ব্যক্তিদের দিয়ে বাহিনী গড়েন। আবার এসব উচ্ছিষ্টভোগীরা নিজ থেকেই মাছির মতো সব সময় ভিসিদের কাছাকাছি ভন ভন করে। ভিসিরা সহজেই এদের ব্যবহার করতে পারেন। দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের একসময়কার সর্বহারা রাজনীতির নামে শ্রেণিশত্রু খতমের প্রক্রিয়াকে অনুসরণ করে অপকর্মের বিরোধিতাকারী শিক্ষকদের নানাভাবে হেনস্তা করে, সাধারণ শিক্ষকদের দমিয়ে রাখে।
ফলে ক্ষতির হাত থেকে বাঁচতে এবং নিজের ন্যায্য অধিকার আদায়ে যাতে হয়রানির শিকার হতে না–হয়, তার জন্য বেশির ভাগ সাধারণ শিক্ষকই ভিসিপন্থী দলে নাম লেখান। এভাবেই ভারী হতে থাকে ভিসির দল। ভিসিরাও এই ভারী দল দেখিয়ে সরকার বাহাদুরকে খুশি রাখেন, বিনিময়ে জোটে দ্বিতীয় মেয়াদের ভিসিগিরি।
পত্রিকা মারফত জানতে পারলাম, ১২টি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য পদ খালি বা শিগগিরই খালি হবে। এসব ভিসি নিয়োগে কোনোভাবেই দলীয় রাজনীতিকে প্রাধান্য দেওয়া যাবে না, অনুসরণ করতে হবে উপাচার্য নিয়োগের আদর্শ পদ্ধতি, সারা দুনিয়ার ভালো বিশ্ববিদ্যালয়গুলো যা করে।
তা না হলে শুধু শিক্ষক-ছাত্রছাত্রীই না, ক্ষতিগ্রস্ত হবে দেশ ও জাতি। নিয়োগের সময় গুরুত্ব দিতে হবে ন্যায়-নীতিবান, আদর্শ, গুণী শিক্ষককে, যাঁর আছে দীর্ঘ শিক্ষকতা ও গবেষণার অভিজ্ঞতা, ভালো মানের প্রকাশনা; যাঁর নেই দলবাজির মানসিকতা; যাঁর মেধা-মনন বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার সুন্দর স্বাভাবিক পরিবেশ বজায় রাখতে সাহায্য করবে। শিক্ষকেরা নির্ভয়ে শিক্ষকতা-গবেষণা করবেন, দিতে হবে না দলবাজিতে সময়, তাদের মধ্যে থাকবে না অধিকার থেকে বঞ্চিত হওয়ার ভাবনা।
আর অবশ্যই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের ভেতর থেকেই দিতে হবে সেই বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি-সহ-উপাচার্য নিয়োগ, এতে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতি তাদের দরদ কিছুটা হলেও বেশি থাকবে, দলাদলিও কমে আসবে। যোগ্য ব্যক্তি ভিসি হলে অবশ্যই যোগ্য ব্যক্তিদেরই বিভিন্ন পদ-পদবি এবং নীতিনির্ধারণ কাজে দায়িত্ব দেবেন তিনি, কিছুটা হলেও যা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য-উদ্দেশ্যকে সমুন্নত রাখবে।
ড. আবদুল্লাহ হারুন চৌধুরী: অধ্যাপক, এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্স ডিসিপ্লিন, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়, খুলনা