কট্টরপন্থী ইসলামি সংগঠন হেফাজতে ইসলামের বিরুদ্ধে বাংলাদেশ সরকার একদম ঠিক সময়ে একেবারে মোক্ষম অভিযান চালিয়েছে। সংগঠনটিতে সন্ত্রাসমূলক তৎপরতা বিস্তার লাভ করার আগেই সরকার সেটিকে অঙ্কুরে বিনাশ করতে পেরেছে। ঠিক সময়ে যদি হেফাজতের তৎপরতাকে রুখে দেওয়া না হতো, তাহলে তাদের বাড়বাড়ন্ত বাংলাদেশের সাম্প্রদায়িক শান্তিকে বিঘ্নিত করত এবং তার প্রভাব প্রতিবেশী ভারতের ওপর গিয়েও পড়ত। হেফাজতে ইসলামের মধ্যে সন্ত্রাসী তৎপরতা ঢুকে পড়ছে বলে গোয়েন্দাদের হাতে খবর আসার পরপরই সরকার কঠোর অবস্থানে যায়।
বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উপলক্ষে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি গত মার্চের শেষে যখন ঢাকা সফর করেন, সে সময় তাঁর সফরের বিরোধিতা করে হেফাজতে ইসলাম দেশব্যাপী বিক্ষোভের নামে তাণ্ডব চালায়। বেশ কয়েকটি শহরে মসজিদের বাইরে হেফাজতের কট্টরপন্থী হাজার হাজার সদস্য ও কর্মী পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়েন। কোথাও কোথাও তাঁদের নিয়ন্ত্রণে আনতে নিরাপত্তা বাহিনীকে গুলি ছুড়তে হয়। হামলাকারীরা ভাঙচুর চালায় ও অগ্নিসংযোগ করে, যার ফলে ঢাকা, চট্টগ্রাম ও সিলেটের মধ্যে ট্রেন চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। এসব সহিংসতায় প্রায় এক ডজন লোক মারা যান।
ধর্মীয় প্রচার সংগঠন থেকে রীতিমতো রাজনৈতিক চাপ সৃষ্টি করা শক্তি হিসেবে পরিণত হওয়া হেফাজতে ইসলামের বিরুদ্ধে শেষ পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। এপ্রিলে সংসদে দাঁড়িয়ে প্রধানমন্ত্রী ঘোষণা করেন, ইসলামের নামে এসব ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ বরদাশত করা হবে না। এরপরই মে মাসে হেফাজতের নেতাদের বিরুদ্ধে অভিযান চালানো হয়। তাঁদের অনেককে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তাঁদের বিরুদ্ধে মামলা হচ্ছে এবং অভিযোগপত্র দাখিলের কার্যক্রমও চলছে। এ পর্যন্ত হেফাজতের শীর্ষস্থানীয় সব নেতা এবং এক হাজারের বেশি কর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। সারা দেশে হেফাজতের নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে ১৪২টি মামলা হয়েছে।
গোয়েন্দা সংস্থাগুলো এমন তথ্য নিশ্চিত করেছে যে কিছু জঙ্গি ও সন্ত্রাসী সংগঠন হেফাজতের সঙ্গে যুক্ততা বজায় রেখে চলেছে। এদের বেশির ভাগই আফগানিস্তানফেরত। এদের মধ্যে সবচেয়ে ভয়ানক গোষ্ঠীটি হরকাতুল জিহাদ বা হুজি হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে।
সরকারের অভিযানের পর হেফাজতের প্রধান জুনায়েদ বাবুনগরী সংগঠনের কেন্দ্রীয় কমিটি ভেঙে দিতে বাধ্য হন। তিনি সংগঠনের ভেতরকার নমনীয় ভাবমূর্তিসম্পন্ন কয়েকজনকে নিয়ে নতুন কমিটি করেন। গ্রেপ্তার হেফাজত নেতাদের যাতে ছেড়ে দেওয়া হয়, সে জন্য তাঁরা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করেন এবং তাঁদের যেন হয়রানি করা না হয়, সে অনুরোধ করেন। গোয়েন্দা সংস্থাগুলো এমন তথ্য নিশ্চিত করেছে যে কিছু জঙ্গি ও সন্ত্রাসী সংগঠন হেফাজতের সঙ্গে যুক্ততা বজায় রেখে চলেছে। এদের বেশির ভাগই আফগানিস্তানফেরত। এদের মধ্যে সবচেয়ে ভয়ানক গোষ্ঠীটি হরকাতুল জিহাদ বা হুজি হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। গোয়েন্দাদের হাতে থাকা তথ্য অনুযায়ী, আফগানিস্তানফেরত কমপক্ষে ৩০ ব্যক্তিকে এখনো ধরার চেষ্টা করা হচ্ছে, যাঁদের সঙ্গে হুজির সংশ্লিষ্টতা রয়েছে।
দ্য ডিপ্লোম্যাট ম্যাগাজিনের একটি বিশেষ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এই সদস্যরা (হুজির) হয়তো পুনরায় সংগঠিত হওয়ার জন্য গোপনে কাজ করছেন এবং সৌদি আরব, পাকিস্তান, ওমান ও কাতারে বসবাসরত তাঁদের সম্ভাব্য নেতারা নিয়মিত আর্থিক সহায়তা করে যাচ্ছেন।
দ্য ডিপ্লোম্যাট-এর ওই প্রতিবেদনের যে তথ্য চমকে দেওয়ার মতো সেটি হলো, মোদির ঢাকা সফরের সময় যে বিক্ষোভ হয়েছিল, তার সংগঠকদের কয়েকজন ছিলেন হুজি সদস্য। প্রতিবেদনটিতে বলা হয়েছে, পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন বলেছে, চলমান ১৬টি মামলা তদন্ত করতে গিয়ে তারা জানতে পেরেছে, ২৬ মার্চের সহিংসতার পেছনে হুজির লোকজন থাকতে পারেন। ডেইলি স্টার-এর হাতে আসা গোয়েন্দা প্রতিবেদন অনুযায়ী ২৫ এপ্রিলে বিলুপ্ত করা হেফাজতের কেন্দ্রীয় কমিটিতে থাকা ২৪৯ জন সদস্যের মধ্যে কমপক্ষে ৮ জন হয় হুজির কর্মী ছিলেন, নয়তো এই জঙ্গি সংগঠনটির সঙ্গে কোনো না কোনো যোগসাজশ ছিল।
সর্বশেষ ঘটনায় সরকার হেফাজতের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থানে চলে যায়। ধর্মীয় উগ্রবাদ ও সন্ত্রাসকে উৎসাহিত না করার নীতিগত সিদ্ধান্ত থেকেই বাংলাদেশ সরকার হেফাজতের বিরুদ্ধে কড়া অবস্থানে গিয়েছে। দক্ষিণ এশিয়ায় সন্ত্রাসবিরোধী ব্যবস্থা জোরদার করার জন্য বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতের সঙ্গে সহযোগিতামূলক সম্পর্ক বাড়াচ্ছে।
২০১০ সালে বাংলাদেশ সরকার ধর্মনিরপেক্ষ মূল্যবোধের প্রসার ও ধর্মীয় গোঁড়ামিকে চাপে রাখতে কয়েকটি পদক্ষেপ নেওয়ার পর মূলত হেফাজতে ইসলাম দৃশ্যপটে আসে। তখনকার সরকার পিতার সম্পত্তিতে মেয়েদের সমানাধিকার প্রতিষ্ঠায় একটি বিল আনে। ধর্মভিত্তিক রাজনীতিকে সংকুচিত করার কয়েকটি পদক্ষেপও নেওয়া হয়। কট্টরপন্থী ধর্মীয় নেতারা এসবের বিরোধিতা করতে এক জোট হন এবং হেফাজতে ইসলাম প্রতিষ্ঠা করেন। শিগগিরই দেখা গেল, সৌদি আরবের সালাফি-ওহাবি মতাদর্শীরা হেফাজতকে তহবিল সরবরাহ করছে। তারা নানান দাবিদাওয়া পেশ করতে লাগল। সরকারও মানতে লাগল। কিন্তু পর্যায়ক্রমে তাদের দাবি বাড়তেই থাকল। তারা ধর্মদ্রোহের বিচার নিশ্চিত করে আইন করা, নারীর অধিকারসংক্রান্ত আইন বাতিল করা এবং সর্বোপরি উন্মুক্ত জায়গায় কোনো ধরনের ভাস্কর্য না বসানোর দাবি তোলে।
কয়েক বছর আগে হেফাজতের কর্মীরা ঢাকাকে অবরুদ্ধ করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু সরকার তা বরদাশত করেনি এবং শক্তি প্রয়োগ করে তাঁদের অবস্থানস্থল থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছিল। তখন থেকেই তাঁরা বিক্ষোভ সংগঠিত করছিলেন, কিন্তু তাঁদের সেসব কর্মকাণ্ড তখনো সরকারকে রাগিয়ে দেয়নি। প্রথম দিকে সরকার নিজেও হেফাজতকে মোকাবিলা করতে চাচ্ছিল না এবং সরকারের ক্ষতি হবে না, এমন দাবিদাওয়া মেনে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে রেখেছিল। যেমন তাদের দাবির মধ্যে ছিল, হেফাজতনিয়ন্ত্রিত মাদ্রাসার ডিগ্রির স্বীকৃতি দেওয়া এবং পাঠ্যক্রম থেকে প্রগতিশীল কয়েকজনের লেখা বাদ দেওয়া।
তবে সর্বশেষ ঘটনায় সরকার হেফাজতের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থানে চলে যায়। ধর্মীয় উগ্রবাদ ও সন্ত্রাসকে উৎসাহিত না করার নীতিগত সিদ্ধান্ত থেকেই বাংলাদেশ সরকার হেফাজতের বিরুদ্ধে কড়া অবস্থানে গিয়েছে। দক্ষিণ এশিয়ায় সন্ত্রাসবিরোধী ব্যবস্থা জোরদার করার জন্য বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতের সঙ্গে সহযোগিতামূলক সম্পর্ক বাড়াচ্ছে। হেফাজতের বিরুদ্ধে সরকারের এই অভিযানকে সন্ত্রাস প্রতিরোধের আদর্শের বাস্তবায়নের সর্বশেষ প্রয়োগ হিসেবে দেখা হচ্ছে।
বাংলাদেশ যখন ধর্মীয় উগ্রতা ও মৌলবাদকে রুখে দেওয়ার জন্য সর্বশেষ সক্রিয় ভূমিকা দেখাল, ঠিক সে সময় দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলো পাকিস্তানের দিকে উদ্বেগের সঙ্গে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছে। কারণ, দেশটি তেহরিক-ই-লাব্বাইক, পাকিস্তানের (টিএলপি) মতো উগ্র সংগঠনকে মদদ দিচ্ছে। এটি একটি কট্টর ও রক্ষণশীল সংগঠন, যারা ধর্মদ্রোহের অভিযোগ থেকে একজন আসামিকে খালাস দেওয়ায় বিচারকদের বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তুলেছিল এবং তাদের হত্যার হুমকি দিয়েছিল। পাকিস্তান সরকার টিএলপির দিক থেকে একের পর এক চাপ আসতে থাকায় তিতিবিরক্ত হয়ে গিয়েছিল। একসময় সরকার এটিকে নিষিদ্ধও করার চেষ্টা করেছিল। তবে শেষ পর্যন্ত সরকার সে অবস্থান থেকে পুরো উল্টো অবস্থানে এসেছে এবং তাদের তুষ্ট করার চেষ্টা করে যাচ্ছে।
ইংরেজি থেকে অনূদিত
সাজ্জাদ ইউসুফ শাহ কাশ্মীর থান্ডার পত্রিকার সম্পাদক ও সমাজকর্মী